বিশ্বজুড়েই অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স। আর সেই ভূমিকার কথা মাথায় রেখেই জাতিসংঘ প্রতি বছর ১৬ জুন পালন করে আন্তর্জাতিক পারিবারিক রেমিট্যান্স দিবস।
সংস্থাটির হিসেবে বিশ্বজুড়ে ২০০ মিলিয়ন প্রবাসী তাদের পরিবারের প্রায় ৮০০ মিলিয়ন সদস্যের কাছে রেমিট্যান্স পাঠান।
কিন্তু এই রেমিট্যান্সের অংক বিশ্বজুড়ে আসলে কত বড়? কোন দেশে সবচেয়ে রেমিট্যান্স আসে? আর সেসব অর্থ আসে কোন সব দেশ থেকে? বিশ্বে রেমিট্যান্সের হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান কত? আর রেমিট্যান্সের ওপর অর্থনীতি কতটা নির্ভরশীল?
পরিসংখ্যানে বৈশ্বিক রেমিট্যান্স
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইএমওর হিসেবে বিশ্ব জনসংখ্যার ৩.৪% অভিবাসী। আর তাদের উপার্জিত অর্থ পুরো বিশ্বের জিডিপিতে ৯.৪% অবদান রাখে।
সংস্থাটি বলছে, সবমিলে বিশ্বের ১৪ শতাংশ মানুষ রেমিট্যান্সের সাথে যুক্ত, যাদের কেউ পাঠাচ্ছে আবার কেউ গ্রহণ করছে।
তবে বিশ্বব্যাংকের হিসেবে মোট রেমিট্যান্সের ৬০ থেকে ৯৫ শতাংশ সাধারণত যায় নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। অর্থাৎ ৪০টি ধনী দেশে কাজ করে শ্রমিকরা অন্তত ১২৫টি দেশে তাদের পরিবার ও স্বজনের কাছে রেমিট্যান্স পাঠায়। যা দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ হয়।
২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের মোট পরিমাণ ৭৯৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার। আর এর মধ্যে ৬২৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার গিয়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫৯৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
তবে সে বছর রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০.২ শতাংশ, যা গত বছর কমে দাঁড়ায় ৪.৯ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্সের দেশ
ভারত: ২০০৮ সাল থেকেই বিশ্বের শীর্ষ রেমিট্যান্স উপার্জনের দেশ ভারত। ১৪০ কোটির ওপর জনসংখ্যার এই দেশে ২০২২ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার স্পর্শ করেছে। যা আগের বছর থেকে ১৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার বেশি।
ভারতের এই বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সের পেছনে কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে দেশটির জনশক্তি এখন উপসাগরীয় দেশগুলোর অল্প বেতনের চাকরির চেয়ে প্রাধান্য দিচ্ছে ধনী দেশে উচ্চ দক্ষতার চাকরির দিকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরে প্রশিক্ষিত ভারতীয়রা প্রযুক্তি ও নানা ক্ষেত্রে বেছে নিচ্ছে উচ্চ বেতনের চাকরি।
তবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি ভারতের মোট জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ২.৯ শতাংশ।
মেক্সিকো: ২০২১ সালে রেমিট্যান্স অর্জনে চীনকে পেছনে ফেলে দুইয়ে উঠে আসে মেক্সিকো। গত বছরও সেই ধারা ধরে রাখে উত্তর আমেরিকার এই দেশটি। ২০২২ সালে তাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। যা তাদের জিডিপির ৪.২ শতাংশ। আর তাদের বেশিরভাগই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২১ সালে তাদের মোট রেমিট্যান্সের ৯৫ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠায় দেশটির অভিবাসীরা।
চীন: গত বছর চীনের মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৫১ বিলিয়ন ইউএস ডলার। রেমিট্যান্স আসা শীর্ষ দেশগুলোর তালিকার ৩ নম্বরে তারা। তবে তাদের বৃহৎ অর্থনীতির খুবই সামান্য পরিমাণ অংশ এটি। তাদের মোট জিডিপির মাত্র ০.৩ শতাংশ।
ফিলিপাইন: আগের বছরের ন্যায় ২০২২ সালেও রেমিট্যান্স অর্জনে বিশ্বে ৪র্থ স্থানে অবস্থান ফিলিপাইনের। আর প্রতিবছর দেশটির প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে। গত বছর দেশটিতে যোগ হওয়া রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এছাড়া ট্যুরিজমও দেশটির অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে। সবমিলে রেমিট্যান্স ফিলিপিন্সের জিডিপির ৯.৫ শতাংশ।
মিশর: ২০২২ সালে মিশরের মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। দেশটির জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ৬.৯%।
পাকিস্তান: নানা অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও দেশটিতে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ হয়নি, তবে পরিমাণ কিছুটা কমেছে। ২০২১ সালে যেখানে পাকিস্তানে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৩১ বিলিয়ন ইউএস ডলার। গত বছর তা কমে দাঁড়ায় ২৯ বিলিয়ন ইউএস ডলারে। যার বেশিরভাগই এসেছে সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন উপসাগরীয় দেশ থেকে। আর প্রবাসীদের আয় পাকিস্তানের মোট জিডিপির ৭.৭ শতাংশ।
ফ্রান্স: ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতির এই দেশটিতে রেমিট্যান্স আসা কিছুটা কমেছে। ২০২১ সালে যেখানে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৩২ বিলিয়ন ইউএস ডলার, গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারে। যা দেশটির মোট জিডিপির ১ শতাংশ।
বাংলাদেশ: বিশ্বব্যাংকের হিসেবে রেমিট্যান্স উপার্জনে বিশ্বে ৮ম অবস্থানে বাংলাদেশ। অবশ্য ২০২১ সালে যেখানে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার, গত বছর তা নেমে এসেছে ২১ বিলিয়ন ইউএস ডলারে। এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অনানুষ্ঠানিক উপায়ে অর্থ আসা। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা বড় উৎস হল রেমিট্যান্স। যার বড় একটা অংশ আসে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এছাড়া প্রবাসী আয় থেকে যোগ হয় দেশের মোট জিডিপির ৪.৬ শতাংশ।
প্রবাসী আয়ের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ দশের বাকি দুটি দেশ হল জার্মানি ও নাইজেরিয়া।
রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল যেসব দেশ
সাধারণত ছোট অর্থনীতির দেশগুলো অনেক বেশি রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল হয়। তাদের অর্থনীতির চাকা নির্ভর করে রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর। অনেক দেশেই তাই জিডিপির একটা বড় অংশ যোগান দেয় প্রবাসী আয়।
২০২২ সালে বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের জিডিপির অন্তত ১৫ শতাংশ এসেছে রেমিট্যান্স থেকে। তবে সবার ওপরে টোঙ্গা। পলিনেশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রের মোট জিডিপির ৫০ শতাংশই হল রেমিটেন্স।
এরপর আছে লেবানন। নানান আর্থিক ও মানবিক সংকটে থাকা এই দেশের জিডিপির ৩৮ শতাংশ যোগান দেয় রেমিট্যান্স। পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল আরেক দ্বীপ রাষ্ট্র সামোয়ার জিডিপির ৩৪ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। এছাড়া তাজিকিস্তানের মোট জিডিপিতে ৩০ শতাংশের ওপর আসে রেমিট্যান্স থেকে।
শীর্ষ দশে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ নেপাল। তাদের পর্যটন খাতের পাশাপাশি প্রবাসী শ্রমিকরা যে রেমিট্যান্স পাঠায় তা নেপালের জিডিপির ২২ শতাংশ।
রেমিট্যান্স আসে কোন দেশ থেকে?
এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের সবশেষ হিসাব আছে ২০২১ সাল পর্যন্ত। সে বছর সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, মোট ৭২ বিলিয়ন ডলার। এরপরের অবস্থানটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের। তাদের দেশ থেকে রেমিট্যান্স গিয়েছে ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স যায় বছরে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সুইজারল্যান্ড থেকে। এরপর শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় আছে যথাক্রমে চীন, কুয়েত, জার্মানি, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ ও রাশিয়া।
বাংলাদেশ থেকে ২০২১ সালে বিভিন্ন দেশে রেমিট্যান্স গিয়েছে ১০১ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি কমবে?
বিশ্বব্যাংক বলছে এ বছর রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার নির্ভর করছে ধনী দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর। তবে তাদের অনুমান চলতি বছরে প্রবৃদ্ধির হার অন্তত ২ শতাংশ কমে যাবে। ফলে নিম্ন আয়ের দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে শঙ্কা বিশ্ব ব্যাংকের।
বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। এই যুদ্ধ যদি আরও বাড়ে তাহলে তেলের দাম ও মুদ্রার বিনিময় মূল্য আরও অস্থির হবে, যা সার্বিকভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
২০২১ সালে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ইউক্রেনে। ২০২২ সালে তা অন্তত ২০ শতাংশ বাড়ার কথা জানায় বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে এশিয়ার যেসব দেশ রাশিয়া থেকে আসা রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল, সেসব দেশে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে। আর এই রেমিট্যান্স কমার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বাড়িয়েছে এসব অঞ্চলে।
আবার ডলার ও রুবলের কারণে অনেকের রেমিট্যান্স বিনিময় মূল্য বেড়ে গিয়েছে। আবার ইউরোর মূল্য কমে যাওয়ায় যারা ডলার নির্ভর কারেন্সি দিয়েছে তারা ভ্যালু কম পেয়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ বলছে রেমিট্যান্সের আসল ভ্যালু এ হিসেবের চেয়ে অন্তত ৫০% বেশি হবে যদি সঠিক পন্থায় টাকা আসে। অনেকেই নানা বিকল্প পন্থা বেছে নেয়। বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে উঠে আসে ২০২২ সালে সেই সমস্ত দেশে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে গিয়েছে যাদের ফরেন কারেন্সি স্বল্পতা আছে এবং বিনিময় মূল্য একেক রকম, সেসব দেশে প্রবাসীরা নানা বিকল্প পথে রেমিট্যান্স পাঠান।
আর টাকা পাঠানোর খরচও একটা প্রভাব রেখেছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। সাধারণ প্রচলিত উপায়ে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে গড়ে ২০০ ডলার পাঠাতে খরচ হয় ৬%। অথচ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় এই খরচ ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংক রেমিট্যান্স নিয়ে যে হিসেব দিয়েছে তাতে তারা উল্লেখ করেছে প্রবাসীদের অনানুষ্ঠানিক উপায়ে পাঠানো অর্থ এই হিসাবের বাইরে।