পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ঘুরে দেখেছেন ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের ৯৭ ট্যুর অপারেটর। সমুদ্রের গর্জন আর নান্দনিক ঢেউয়ের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন তারা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নিজ নিজ দেশে গিয়ে কক্সবাজারের কথা বলবেন আর পর্যটক পাঠাবেন।
বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের আমন্ত্রণে গত ২৬ মে চারটি দেশের শীর্ষ ট্যুর অপারেটররা ঢাকায় আসেন। নেপালের ১২ জন, ভুটানের ১৪ জন, শ্রীলঙ্কার ১৯ জন এবং ভারতের ৫২ জন প্রতিনিধি আসেন। ভারতের অধিকাংশ অপারেটর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুণাচলের।
গত রোববার তাদের ঢাকা থেকে কক্সবাজারে নিয়ে যায় ট্যুরিজম বোর্ড। সেখানে কক্সবাজারের বিখ্যাত রূপচাঁদা মাছের ফ্রাই আর মুরগির রেজালা দিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়। সঙ্গে ছিল সবজি, আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা আর ডাল। দুপুরের খাবার শেষে তাদের নেওয়া হয় উত্তর মিঠাছড়ির পাহাড়চূড়ায়। সেখানে ১০০ ফুট লম্বা গৌতম বুদ্ধের সিংহশয্যা মূর্তি দেখেন অতিথিরা।
ভূটান ও শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ নাগরিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সে দেশের প্রতিনিধিদের কক্সবাজারের এই স্পটটির প্রতি বাড়তি আগ্রহ ছিল। খালি পায়ে পাহাড়ের চূড়ায় মূর্তি দেখতে ও ছবি তুলতে যান তারা।
এসময় তাদের গৌতম বুদ্ধের মূর্তি সম্পর্কে ব্রিফ করেন সিংহশয্যা বুদ্ধমূর্তির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক করুণাশ্রী মহাথের।
পরে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, দেশ-বিদেশের বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমানসহ সব সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে শান্তি লাভের জন্য আসেন। তারা এখানে এসে শান্তি লাভ করেন। জাপান ও থাইল্যান্ডের পর্যটকরাও এখানে এসে ঘুরে যান। আজ এশিয়ার যারা এলেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
মূর্তি দেখার পর প্রতিনিধি দলকে নেওয়া হয় কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ হয়ে পাটুয়ারটেক সি-বিচে। বিচে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান বিদেশি অপারেটর প্রতিনিধিরা। প্রায় দুই ঘণ্টা বিচের পানিতে পা ভিজিয়ে ছবি তোলেন তারা।
সমুদ্র দেখে মুগ্ধ আসামের ট্যুর অপারেটর নওশাদ হোসেন বলেন, আমি ছয় বছর আগে বাংলাদেশে এসেছিলাম। আগের বারের চেয়ে এবার অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। আমি আশা করি, বাংলাদেশ আরও বেশি বিদেশি পর্যটক পাবে। দেশে ফিরে আমরা বাংলাদেশকে আরও ভালোভাবে ব্র্যান্ডিং করব।
ভুটান গুরো অ্যাডভেঞ্চার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রী প্যাল্ডেন বলেন, ভুটানকে কিংডম অব হ্যাপিনেস বলা হয়। ভুটান বাংলাদেশে আপেল-কমলার মতো ফল সরবরাহ করে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো। আমরা বাংলাদেশের বিচ দেখে গেলাম। আমরা এখানে পর্যটক পাঠাব, পাশাপাশি বাংলাদেশিরাও পাহাড় দেখতে ভুটান যাবেন বলে আশা করি।
নেপালের রিভার ট্যুরিজমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিবা অধিকারি বলেন, আমি পৃথিবীর অনেক বিচ দেখেছি। তবে বাংলাদেশের বিচ অত্যন্ত মনোরম। পাশাপাশি নেপালের লোকজনের জন্য এটি অনেক কাছের একটি বিচ। অনেক কম খরচে নেপালিরা এখানে আসতে পারবে। আমরা দেশে গিয়ে বাংলাদেশের বিচকে প্রমোট করব যাতে তারা কম খরচে বিচ দেখতে পারে। পাশাপাশি চাই বাংলাদেশিরাও নেপালে গিয়ে হিমালয় পর্বত দেখে আসবেন।
আসামের ট্যুর অপারেটর বড়ুন দে বলেন, যেসব জায়গায় ঘুরেছি খুবই ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ দেখতে যেমন সুন্দর, একইভাবে এখানকার লোকজন অনেক ভালো। আমরা চেষ্টা করব আসামের লোকজনকে বাংলাদেশে ঘুরতে পাঠাতে।
ডাস্টবিন নেই, নেই আরও কিছু অনুষঙ্গ
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ঘুরে অনেক ট্যুর অপারেটর এটিকে ‘সবার জন্য উপযোগী নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলকাতার বিকন ট্যুর অপারেটরের প্রতিনিধি সন্দ্বীপ চৌরাসিয়া বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে কক্সবাজার অতুলনীয়। তবে আমি কিছু সমস্যা দেখলাম এখানে। পাটুয়ারটেক সৈকতে কোনো ডাস্টবিন আমার চোখে পড়েনি। আমি চিপসের কয়েকটা প্যাকেট দেখতে পেয়েছি। পর্যটকরা নোংরা বিচ পছন্দ করেন না। যদি ডাস্টবিন টাইপের কিছু থাকত জায়গাটা পরিষ্কার হতো।
তিনি বলেন, এখানে বিচের আশপাশে ছেলে বা মেয়েদের জামাকাপড় বদলানোর জন্য কোনো ‘চেঞ্জ রুম’ নেই। এখানকার পর্যটকরা তাহলে ড্রেস চেঞ্জ করবে কীভাবে? এটা না থাকলে কোনো নারী এখানে স্নান করবে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি এখানে টয়লেট বা বাথরুমও নেই। কর্তৃপক্ষের এখনই উচিত কিছু কিছু ইকো ফ্রেন্ডলি টেম্পোরারি টয়লেট ও বাথরুম বসানো। এছাড়া ভারতের নাগরিকদের জন্য ভিসা অন অ্যারাইভাল ব্যবস্থা চালু করে তাহলে ভালো হতো। যদিও এটা দুই দেশের সরকারের ওপর নির্ভর করে।
ভারতের ট্যুর অপারেটর গোলাম নবী বলেন, কক্সবাজার বিচ খুব সুন্দর হলেও কিছু দুর্বলতা আছে। এখানে ওয়াশরুম, চেঞ্জরুম নেই। আশপাশে প্যারা-সেইলিং, প্যারা-গ্লাইডিং বা বেলুন নেই। হর্স রাইডিং বা কেমেল রাইডিংও নেই। একজন পর্যটক শুধু বিচ আর সমুদ্র দেখবে তা নয়, তার আনুষঙ্গিক অনেক বিনোদন দরকার।
নেপালের সেইলিং হলিডেজ-এর রাজু ঢাকাল বলেন, নেপালের পর্যটকদের বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশনে কিছু ঝামেলা হয়। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাদের আচরণ নিয়ে নেপালিরা অনেক অভিযোগ করেন। এটা না থাকলে নেপালিরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যে বাংলাদেশে আসতে পারবে। কারণ, বাংলাদেশ অনেক কম খরচের ডেস্টিনেশন।
কক্সবাজারের দুর্বলতা তুলে ধরে নেপালের আরেক ট্যুর অপারেটর বলেন, আমরা সারাদিন অনেক ভালো ভালো খাবার খেলাম এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলাম। সন্ধ্যার পর এত সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। তবে কোথাও কোনো বিয়ার নেই, মদ নেই। রাত কাটানোর জন্য ড্যান্স বার বা নাইট ক্লাব নেই। এসব একজন ট্যুরিস্টের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। সারাদিন ঘুরে একজন টুরিস্ট হোটেলে গিয়ে পূজা করতে বসবে না। এসব সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।
তিনি বলেন, আমি নিজেও বাংলাদেশে আসার সময় সঙ্গে অনেক টাকা নিয়ে এসেছি। তবে খরচ করার জায়গা পাচ্ছি না। বিচ ঘুরলাম। বিচের পাশে শুধু আম পেলাম, তাও মাত্র ৫০ টাকা। আর কোথাও টাকা খরচ করার সুযোগ পাচ্ছি না। পর্যটকরা টাকা খরচ করতে আসে, তাদের টাকা খরচের জায়গা করে দিতে হবে। মালদ্বীপ-দুবাইয়ের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশে মদ পাওয়া যাচ্ছে। নেপালে আনাচে-কানাচে সব জায়গায় মদ পাওয়া যায়, মেডিকেল শপেও বিয়ার পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকারের উচিত সেসব দেশ ঘুরে এসে পর্যটকদের রাত কাটানোর বিষয়টি কীভাবে উপভোগ্য করা যায় তা নিশ্চিত করা।
কক্সবাজার ভ্রমণের আগে বিদেশি ৯৭ ট্যুর অপারেটর বাংলাদেশের ১২৫ জন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) মিটিং করে।
সার্বিক আয়োজনের বিষয়ে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) মিডিয়া ও পাবলিকেশন্স বিভাগের পরিচালক মো. ইউনুস বলেন, বাংলাদেশে এশিয়ান পর্যটক বাড়াতে চার দেশের ট্যুর অপারেটর নিয়ে ট্যুরিজম বোর্ডের এ আয়োজন। বিদেশি অপারেটরদের প্রতিনিধিরা সমুদ্র দেখে খুবই খুশি। আমরা দেখেছি ভুটানের লোকজন, যারা পাহাড় দেখে অভ্যস্ত, তারা কীভাবে সমুদ্র দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাদের অনুভূতি দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বিদেশি পর্যটক টানতে আমরা একটা সম্ভাবনার জায়গায় যাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি এ উদ্যোগের ফলে বিদেশি পর্যটকের নতুন দুয়ার খুলবে।