সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ পূর্বাহ্ন

শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

শ্রীলঙ্কার চারদিকে সমুদ্র থাকার কারণে এর আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এখানে অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়। তাই পর্যটকদের এই সময়টা এড়িয়ে চলাই ভালো। শ্রীলংকা ভ্রমণ করার জন্য বছরের সবচেয়ে ভালো সময় হলো ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস। শ্রীলংকা ভারত মহাসাগরের এবং উপমহাদেশের দ্বীপ রাষ্ট্র। শ্রীলংকায় যাওয়াটা হুট করেই। আমরা ব্যাংকক থেকে শ্রীলংকা যাই। দেশটা খুবই নিরিবিলি এবং পরিচ্ছন্ন। আমার মনে হয়েছে, মানুষের আচরণে ভদ্রতা-সভ্যতার বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকাই এগিয়ে; যদিও এখন অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। নিকট প্রতিবেশী এত সুন্দর একটা দেশে অন্তত একবার ভ্রমণ করা উচিত।

ঢাকা ব্যাংকক-কলম্বো আবার ঢাকা-কলকাতা-চেন্নাই-কলম্বো যাওয়া যায়। বিমানবন্দরে পৌঁছেই আমরা রওনা দিই উজফেটাকাইয়াবার হোটেল পাম ভিলেজের উদ্দেশ্যে। হোটেলটি কলম্বো সমুদ্র বন্দরের কাছে এবং সমুদ্র পাড়েই গল ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সাথেই। শ্রীলংকার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আবহাওয়া বেশ চমৎকার। চারদিকে সমুদ্র থাকার কারণে এর আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। উপমহাদেশের দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে যেতে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা বাধ্যতামূলক। ঢাকাস্থ শ্রীলংকা দূতাবাসে গিয়ে আগে থেকেই ভিসা সংগ্রহ করে নেয়া ভালো। কারণ কলম্বো বিমানবন্দরে গিয়ে ভিসা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যায় না। সময়ভেদে জনপ্রতি রাউন্ড ট্রিপ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা পড়বে। খরচ কমাতে চাইলে ভারত হয়েও যাওয়া যায়। এভাবে গেলে খরচ কমবেশি ২০ হাজার টাকা লাগে। শ্রীলংকায় ৪০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে ভালো হোটেল পাওয়া যাবে সব জায়গায়। খাওয়া দাওয়া, যাতায়াত সবকিছুর খরচ অনেক কম।

কলম্বো আসার পর বাসে বা ট্রেনে শ্রীলংকার যে কোনো জায়গায় যেতে পারবেন। পর্যটন এদেশের প্রধান ব্যবসা হওয়াতে সবাই আপনাকে সহযোগিতা করবে। আর যদি কোনো ক্যাব বা থ্রিহুইলারে চড়তে চান মিটার যুক্ত বাহন ব্যবহার করুন। আগে মিটার যুক্ত বাহন কম ছিল। এখন অনেক মিটারযুক্ত বাহন পাবেন। এতে করে ঝামেলা এড়ানো যাবে। থাকার জন্য সব দামের হোটেল পাবেন। আর একটি কথা। কলম্বোতে নেমে একটি লোকাল সিম কার্ড নিতে পারলে ভালো। কারণ আপনার মোবাইলে হয়তো রোমিং করা আছে। কিন্তু তাতে খরচ পড়বে অনেক। দরকার কি অযথা অপচয় করার। বিমান বন্দরের এরাইভাল লাউঞ্জের বাইরে আসার আগে দেখবেন ২টি সিম কার্ডের বুথ। একটি হল ডায়ালগ আরেকটি মোবিটেল।

শ্রীলঙ্কা একটি আশ্চর্য দ্বীপ, যেখানে আপনি হিক্কাডুয়া সমুদ্র সৈকতে কচ্ছপদের খাওয়াতে পারেন, সিলন প্ল্যান্টেশনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে পারেন, লিটল অ্যাডাম এবং এলা রক পিকসের চূড়া জয় করতে পারেন, মিরিসা স্পটে ঢেউ ধরতে পারেন এবং ট্রেনের যাত্রা উপভোগ করতে পারেন। দ্বীপের চারপাশে ভ্রমণের জন্য রেলওয়ে হল সবচেয়ে সুবিধাজনক, সস্তা এবং খুব সুন্দর বিকল্প। কোনও ট্র্যাফিক জ্যাম নেই। ক্যান্ডি থেকে কলম্বো পর্যন্ত ভয়ানক ট্র্যাফিক জ্যাম হয় অনেক সময়, আপনি প্রায় যে কোনও শহরে যেতে পারেন, তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভ্রমণের সময় যে দৃশ্যগুলি দেখা যায়, ট্র্রেনের খোলা জানালা থেকে আপনি পাহাড়, বন, গাছপালা, সৈকত এবং গ্রামসহ দ্বীপের প্রকৃতি দেখতে পাবেন যেখানে আপনি স্থানীয়দের জীবন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

আপনি কলম্বো আসছেন, রাজধানীতে অনেক সময় ব্যয় করবেন না। শহরটি দ্বীপের আকর্ষণকে প্রতিফলিত করে না। সরাসরি স্টেশনে যান এবং ক্যান্ডির টিকিট কিনুন। প্রায় তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করুন। এই শহর, যা একসময় রাজাদের আবাসস্থল ছিল, দ্বীপের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত এবং এটি এর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র। টুথ রিলিকের মন্দিরে যান, যা যাদুঘর। আপনি যদি আগস্টের জন্য ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন তবে এসালা পেরাহেরা পবিত্র দাঁতের উৎসব-এ যেতে পারেন। ক্যান্ডি লেকের চারপাশে হাঁটুন। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ এই কৃত্রিম হ্রদটি ১৯ শতকের শুরুতে ক্যান্ডির শেষ রাজা শ্রী বিক্রম রাজাসিংহের নির্দেশে আবির্ভূত হয়েছিল। শাসকের হারেমটি হ্রদের মাঝখানে একটি ছোট দ্বীপে অবস্থিত ছিল। আপনি মঠ এবং রাজকীয় স্নানও দেখতে পাবেন। পুকুরের চারপাশে গিজ, পেলিকান এবং হেরন পাওয়া যায়। শ্রীলঙ্কার উদ্ভিদ এবং প্রাণিজগতের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য প্রকৃতি সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে হাঁটুন: ৩০০ বছরের পুরানো লতা, মিনি বেত পাম, অর্কিড, লতা, সিলন ম্যাকাক, সজারু, মংগুস, পান্না তোতা এবং ঘুঘু। ক্যান্ডির বিখ্যাত চা মন ভরিয়ে দেবে আপনার। শ্রীলঙ্কা তার চায়ের জন্য বিখ্যাত, তাই এটি কীভাবে তৈরি হয় তা জানতে পেড্রো এস্টেটের মতো স্থানীয় বাগান পরিদর্শন করা জরুরি।

ক্যান্ডির কাছেই পথে অবশ্য ‘পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ’-এ থেমেছিলাম। এটা মূলত হাতির আশ্রম; সেখানে প্রবেশ করতে এক হাজার রুপি দিতে হয় জনপ্রতি। এ যেন হাতিদের জন্য এক জলসাঘর। এক পাল হাতি জলে আর পাথুরে ডাঙ্গায় নানা রকম অদ্ভুত কর্মকা-ে ব্যস্ত থাকে। শ্রীলংকায় এলে অসাধারণ সুন্দর স্থানটিতে আসতে ভুলবেন না। এখানে এলে হাতির প্রতি শুধু ভালোবাসা জন্মাবে না, জায়গাটার প্রেমে পড়বেন নিশ্চিত। একটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আমার বিশেষ মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিলো, দেখতে পায় না কিন্তু সব আচরণ স্বাভাবিক। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর চলে যাই একদম উপরের ঢালে। বাতাসে উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! চূড়া থেকে যতদূর চোখ যায়, শুধু বন আর বন। সীমানা ঘেঁষে কয়েকটা পাহাড়ের সারিও আছে। ঠিক মাঝখানে সিগিরিয়া আর পিদুরাঙ্গালা। সিগিরিয়ার সূর্যাস্ত আসলেই মুগ্ধ হওয়ার মতো। এমন নিরবিচ্ছিন্ন আকাশে সূর্যাস্তের উৎসব আবেগে ভারি করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ক্যান্ডির ক্রিকেট স্টেডিয়াম খুব বিখ্যাত সবাই আসে ক্রিকেট দেখতে।

ক্যান্ডি শহরের মাঝখানে বিশাল হ্র্রদ। হ্রদের চারপাশে বুদ্ধের দাঁতের মন্দির, সিংহল সংস্কৃতি কেন্দ্র এখানে নিয়মিত ঐতিহ্যবাহী নাচ দেখা যায়, উডাওয়াত্তাকেলে অভয়ারণ্যসহ আরও অনেক কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সময় নিয়ে ঘুরে দেখার মতো। উডাওয়াত্তাকেলে অভয়ারণ্যে প্রচুর জীবজন্তু আছে। প্রবেশ পথের কাছেই একটা জায়গায় বানরের দল ঘোরাফেরা করে। তবে এরা খুব নিরীহ বানর। ক্যান্ডিতে ভাল থাকার জায়গা আছে স্বার্নানাঙ্কারা মাওয়াথায় বাংলায় হবে স্বর্ণালঙ্কার সড়কে। এখানে ব্যাকপ্যাকারের জন্য উপযুক্ত বাজেটে ঘর পাওয়া যায়, ঘরের মান বেশ ভালই। কোনো কোনো হোটেলে ফ্রী রিভর আছে। হ্রদের পাশ ঘেঁষে একটা রাস্তা চলে গেছে শহরের মধ্যে। সেই রাস্তা ধরে, দাঁতের মন্দির পাশ কাটিয়ে আরও কিছুদূর গেলে একটা মসজিদ আছে। এখানে আমার জানা মতে ক্যান্ডির সেরা স্ট্রিং হপার পাওয়া যায়। সাথে লুনু-মিরিছ, নারিকেলের চাটনি ইত্যাদি।

সিগিরিয়া রক ফোর্ট্রেস দেখতে যাই পরদিন ভোরেই। প্রথমে মিউজিয়াম দেখে সিগিরিয়া পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাই রক ফোর্ট্রেস। পাথর আর লোহার সিঁড়ি দিয়ে এর চূড়ায় যেতে প্রায় ৪৫ মিনিটের মতো লাগে। মাঝপথে পাথরে খোদাই করে সিংহ দরজা বানানো আছে। আরো কিছু প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে এর বিভিন্ন জায়গায়। অনেক রোদ থাকায় বেশিক্ষণ চূড়ায় থাকা হয়নি।

শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের জন্য খুবই উপযুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন দেশ শ্রীলঙ্কা। আমাদের নিকট প্রতিবেশী এত সুন্দর একটা দেশ অবশ্যই ভ্রমণ করা উচিত। বাংলাদেশের সাথে শ্রীলঙ্কার আবহাওয়ার মিল অনেক। একই রকম উষ্ণ এবং আর্র্দ্র আবহাওয়া সেখানে। তবে বাংলাদেশে ঋতু বৈচিত্র্য যেরকম টের পাওয়া যায়, শ্রীলঙ্কায় সেটা ঘটে না। বিষুব রেখার কাছাকাছি বলে সেখানে ঋতুভেদে তাপমাত্রার খুব একটা পরিবর্তন হয় না। তবে সেখানেও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষাকাল আসে। দ্বীপের দুই দিকে বর্ষা আসে বছরের দুই সময়ে। কাজেই কোন অংশে বেড়াতে যেতে চান, সেখানের আবহাওয়া কখন কেমন সেটা বুঝেশুনে গেলে ভাল হবে। শ্রীলংকায় সনাতন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেল পেতে চাইলে কলম্বো ঘুরে দেখার কোনও বিকল্প নেই। এখানে যেমন আছে ঐতিহ্যগত নিস্তব্ধতা, তেমনি আধুনিক উজ্জ্বলতাও। ইতিহাস, সংস্কৃতি, বৌদ্ধ দর্শন ইত্যাদিতে আগ্রহী হলে একটা গোটা দিন রেখে দিন জাতীয় যাদুঘরের জন্য।

তবে শ্রীলংকায় নারীরা অনেক স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন মনে হলো। কারণ রাত এগারোটা বা বারোটার সময় সাইকেল চালিয়ে মেয়েদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে দেখেছি, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে, যা ভালো লেগেছে। সহিংসতার তেমন কোনো আশঙ্কা নেই মনে হলো।

কলম্বো শহর থেকে একটু দূরে সাগর পাড়ের ছোট শহর নিগোম্বোতে সস্তায় অনেক হোটেল আছে। আকাশ ছোঁয়া দামের হোটেলও আছে, তবে দামীগুলো আগে থেকেই ট্যুর গাইদের বুকিং দিয়ে ভরা। ব্যাকপ্যাকারদের জন্য ছোটখাট সস্তাগুলোই ভাল। সাগর এখানে প্রায় শান্তই থাকে। যাদের সাগরে সাঁতারের অভ্যাস আছে তারা আরামে সাঁতরাতে পারবেন। আবহাওয়া ঠিক থাকলে তীর থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরেও সাঁতরানো যায়। অভিজ্ঞরা ১০০ মিটারেও যেতে পারবেন। নিগোম্বোতে একটা মিশনারি স্কুল আছে। স্কুলের ঠিক পাশেই ছোট্ট একটা মুদি দোকানে সকালে নারিকেলের পাটিসাপটা পিঠা বিক্রি করে। এর নাম কোকোনাট হপার। খেতে খুব সুস্বাদু।

জাতীয় যাদুঘর দালানটা খুব সুন্দর, সম্ভবত ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি। যাদুঘরের সামনে বট গাছের নিচে শ্বেতশুভ্র ধ্যানরত বুদ্ধের মূর্তি আছে। যারা বৌদ্ধ দর্শনে আগ্রহী তাদের জন্য শ্রীলঙ্কাজুড়ে দেখার, শোনার, শেখার অনেক কিছু আছে। বৌদ্ধ দর্শনের ঘাঁটি হিসেবে মনে করা হয় শ্রীলঙ্কাকে। কলম্বোতে গেলে গলফেস এলাকায় যেতে পারেন। সাগরের পাশেই বিশাল মাঠে বিকালবেলা লোকে ঘুড়ি ওড়ায়, যুবক-যুবতিরা বসে গল্প করে, বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে আসে। খুব মনোরম পরিবেশ। কলম্বোতে কেনাকাটা করতে গেলে চলে যাবেন হাউজ অব ফ্যাশনসে, সব কিছু পাওয়া যায় ওখানে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com