শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৬ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

শ্রীলংকা ভ্রমন

  • আপডেট সময় সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২

শ্রীলংকা!! ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় পাঠ্যপুস্তকে “সমুদ্রের প্রতি রাবন” কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের দাঁত ভাঙ্গা ভাষায় প্রথম লংকার সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে কিঞ্চিত অবগত হই। কিন্তু মালদ্বীপের সেই পাঁচদিনের রোমাঞ্চকর এবং মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার পর তিনদিনের এই শ্রীলংকা ট্যুরটির প্রতি আমাদের কোন এক্সপেক্টশনই ছিলনা। ভেবেছিলাম যা দেখব , অভিজ্ঞতার ঝুলি পুর্ণ হতে তা সাহায্য করবে কিন্তু তাতে সেই ঝুলি কতটা সমৃদ্ধ হবে সে সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই ছিলনা আমাদের। 

যাই হোক, মালদ্বীপ এয়ারপোর্ট থেকে আকাশযানে উড়াল দিয়ে প্রায় একঘন্টা পঁচিশ মিনিট পর বেলা এগারটায় আমরা অবতরণ করলাম কলম্বো বান্দারনায়েক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই আমাদের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড প্রিয়ান এগিয়ে এল। ওর সাথে করে নিয়ে আসা এলিওন গাড়িতেই আমরা রওনা দিলাম ক্যান্ডির পথে। ও হ্যা এই ফাঁকে আমরা আমাদের শ্রীলংকা ট্যুর প্ল্যানটা বলি। আমাদের প্ল্যানটি ছিল এরকম, এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ক্যান্ডি। কলম্বো থেকে ক্যান্ডি প্রায় চার ঘন্টার ড্রাইভ। যাওয়ার পথে পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ দেখব। তারপর ক্যান্ডি রাত থেকে পরের দিন ক্যান্ডির দুই একটি সাইট সিয়িং করে দুপুরে কলম্বোর পথে যাত্রা। রাতে কলম্বো থেকে পরের দিন সারাদিন কলম্বো সিটি ঘোরাঘুরি করে রাতে ইন্ডিয়া ব্যাক। ফ্লাইট রাত একটায় ছিল বলে ঘুরাঘুরির জন্য সারাটাদিনই পরে আছে।

কলম্বো থেকে ক্যান্ডির ড্রাইভটি বেশ ভালই লাগছিল আমাদের । কোথাও কোন চড়াই উতরাই নেই, বেশ মসৃন। এলিফ্যান্ট অরফানেজের কিছু আগেই চানাহ নামক একটি রেস্টুরেন্ট এ লাঞ্চ করলাম। এখানে শ্রীলংকার ফুড ট্রাই করলাম প্রথম এবং আমার কাছে বেশ ভালই লাগল। শুনেছিলাম তারা নারিকেল তেল দিয়ে রাধে, খাবার মুখে দেয়া যায়না, আমার তেমন কিছুই মনে হলনা। এর কারণ হতে পারে এই যে, রেস্টুরেন্টটি বেশ পপুলার হওয়ার কারণে তারা ট্যুরিস্টদের টেস্টের কথা চিন্তা করে রান্নায় বৈচিত্র এনেছে। দুইঘন্টার ড্রাইভের পর গাড়ি এসে থামল পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ এ। এখানে এসে টিকিট কেটে শুনলাম হাতীগুলো সব নদীতে গোসল করতে গেছে আমরা তাই তাদের পিছু পিছু সেই নদীতে। ওখানে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ঐরাবতগণের জলকেলি দেখে আবার ফিরে এলাম অরফানেজ এ।

এখন বলি এই অরফানেজ আসলে কি। শ্রীলংকা সরকার হস্তী প্রজাতির বিলুপ্তি রোধে তাদের রক্ষনাবেক্ষনের জন্য এই অনাথ আশ্রমটি গড়ে তুলেছেন। একশ হাতীর মত এখন ওখানে রয়েছে। একসাথে এত হাতী এর আগে কখনো দেখা হয়নি। ভালই লাগছিল আমাদের। আর একটু অপেক্ষা করলে টাকা পে করে বেবি হাতীদের ফিডিং করানোও যেত কিন্তু আমাদের হাতে বেশি সময় ছিলনা বলে কন্যার আবদার আর রক্ষা করা সম্ভব হলনা। আবার গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা । লক্ষ্য এবার ক্যান্ডি। গাড়ি এবার আপ হিল ওঠা শুরু করেছে। সাথে সাথেই ভিউ চেঞ্জ হয়ে গেল রাস্তার। দূর আকাশের গায়ে পাহাড়ের সারি, সুর্য্য কিরণ গায়ে মেখে তারা নানা বর্ণে বর্ণিত। মালদ্বীপের এই পাঁচদিনে সাগরের নীলে মন ভাসিয়েছি বহুবার । এবার পাহাড়ের নীল সবুজে মন রাঙ্গানোর পালা। প্রকৃতির রঙ রুপের এই পরিবর্তনের সাথে নিজেদের রাঙ্গাতে প্রস্তত হলাম আমরা এবার।
ক্যান্ডির কাছাকাছি পৌছে ভিউ পয়েন্টে নামলাম আমরা। এখান থেকে পুরো লেক পাহাড় আর বৃক্ষ ছাওয়া পুরো ক্যান্ডি শহরের চমৎকার একটি ভিউ পাওয়া যায়। আমরা সেই দৃশ্য আত্মস্ত করে চলে এলাম আমাদের হোটেলে। আমাদের হোটেলটি ছিল আসলে একটি ব্যাক্তি মালিকানাধীন গেস্ট হাউজ। ক্যান্ডি লেকের গা ঘেসা এই হোম স্টেটি ( প্রনবা হোম স্টে) আসলেই দারুন। আমরা রুমে ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরলাম নগর পরিদর্শনে। আমাদের গাইড অন্য কোথাও গাড়ি পার্ক করতে চলে গেল। আমরা পদব্রজেই তাই বেড়িয়ে পরলাম।

পাহাড় বেস্টিত, সমুদ্র সমতল থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত এই শহরটি বেশ পরিস্কার, ছিমছাম, সুন্দর। এই শহরে বুদ্ধিস্ট দের অত্যন্ত পবিত্র একটি টেম্পল রয়েছে যার নাম “ টেম্পল অফ টুথ রেলিক” । গৌতম বুদ্ধের দাঁত এখানে রাখা আছে বলে এই মন্দিরটি তাদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র স্থান। প্রতি বছর জুলাই থেকে অগাস্টের মধ্যে কোন এক সময় পেরাহেরা নামক এক সপ্তাহ ব্যাপী এক বিশাল ফেস্টিভেবল এখানে অনুষ্ঠিত হয়। সৌভাগ্যজনকভাবে আমরা যখন ক্যান্ডিতে অবস্থান করছিলাম তখন তাদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবটি চলছিল। উৎসবকে কেন্দ্র করে সাজ সাজ রব শহরের চারিদিকে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ট্যুরিস্টদের সংখ্যা অগুনতি। শুধু এই উৎসবে সামিল হওয়ার জন্যেই তাদের আনাগোনা যে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমাদের হো্টেলটি এই টেম্পলের একদম কাছেই। তাই রাতের ক্যান্ডিতে হাঁটতে হাঁটতে আমরা উৎসবের সেই কেন্দ্রস্থলে চলে গেলাম। নানা রঙ্গে ও অলংকারে সজ্জিত বিরাটাকায় হাতী আর সুসজ্জিত কয়েক শত মানুষ রাজপথ এ নেমে এসে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহকারে নানারকম নৃত্যকলা প্রদর্শন করে চলেছে।

পুরো এলাকা জুড়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের তৎপরতা চোখে পরার মত। আমরা সেই জন অরণ্যের মাঝে ঢুকে গিয়ে এদিক ওদিক উকিঝুকি মেরে একটু হাতীর শুঁড় কিংবা লেজের কিয়দংশ নয়ত নৃত্যরত মানুষদের দুই তিনটি ঠ্যাং থুক্কু পদযুগলের চাক্ষুস স্বাক্ষী হয়ে বিশাল অনুষ্ঠান দেখেছি এমন একটা পরিতৃপ্ত ভাব মুখে নিয়ে ক্যান্ডি সিটি সেন্টারে এসে পৌঁছলাম। এটি ক্যান্ডির অন্যতম একটি শপিং মল। এখানে চমৎকার একটি ফুড কোর্ট রয়েছে। সেই ফুড কোর্টে ডিনার করে আবার আমরা হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের পথে পারি দিলাম।

ক্যান্ডিতে যেহেতু এক রাতই থাকব আমরা তাই অদ্যই আমাদের শেষ রজনী। ভালমত একটা ঘুম দিয়ে সকালে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল থেকে চেক আউট করে বেড়িয়ে পরলাম আমরা। ইতিমধ্যে আমাদের ড্রাইভারও এসে হাজির। প্রথমেই আমরা গেলাম সেই বিখ্যাত টেম্পল” টেম্পল অফ টুথ রেলিক” এ ।

উৎসবের কেন্দ্রস্থল এই টেম্পলটিতে যেন সাজ সাজ রব চলছে। শত শত নর নারি শুভ্র বস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে হাতে লাল নীল পদ্ম নিয়ে প্রবেশ করছে টেম্পল প্রাঙ্গনে। একসাথে এত কালারের পদ্ম আমরা আগে দেখিনি, মুগ্ধ হলাম তাদের মনোহর রঙ বৈচিত্র দেখে। আমরাও টিকেট কেটে ঢুকে পরলাম সেখানে। ভেতরে কেমন যেন মাতাল করা ঢাকের আওয়াজ আর সেই সাথে নৃত্য ঘোর লাগানো অনুভুতি নিয়ে আসে। আরো ভেতরে স্বর্ন নির্মিত গৌতম বুদ্ধের মুর্তি , তাঁর পবিত্র দন্ত এবং তাদের আরো কিছু বুদ্ধিস্ট ধর্মীয় জিনিস রক্ষিত ।

খুব বেশি ভীড় ছিল বলে আমরা আর বেশিক্ষন থাকলাম না। তবে এখানে লক্ষ্যনীয় যে, আপনারা টেম্পলে প্রবেশ করে বাহির থেকে মন্দিরের ছবি তুলতে পারবেন কিন্তু বৌদ্ধ মুর্তি বা টেম্পলকে পেছনে রেখে নিজে পোজ দিয়ে কোন ছবি তুলবেন না। এইটা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। এখান থেকে বেরিয়ে আমরা এবার ক্যান্ডি মার্কেটে। টুকটাক শপিং সেরে আবার চলে এলাম ক্যান্ডি সিটি সেন্টার। এখানে আবার সেই ফুড কোর্টে লাঞ্চ সেরে হোটেলে ফিরে লাগেজ নিয়ে এবার আমরা পারি জমালাম কলম্বোর পথে। পথে পেরাডেনিয়া বোট্যাকিন্যাল গার্ডেন দর্শন হবে।

পেরাডেনিয়া বোটানিক্যাল গার্ডেনটি কয়েকশত বছরের প্রাচীন বৃক্ষ কানন। অসংখ্য প্রজাতীর তরুরাজীর সমাহার এখানে। টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করার সময় আপনাকে একটি ম্যাপ দেয়া হবে এই গার্ডেনের। আপনি সেই ম্যাপ দেখে দেখেই প্রদক্ষিন করতে পারবেন পুরো বাগান কিন্তু এই বিশাল বাগানটি পদব্রজে পদক্ষিন করতে আপনার পা বেচারার উপর দিয়ে ধকল যে ভালই যাবে তাতে সন্দেহ নাই কোন। যদিও টাকার বিনিময়ে বাগিতেও ( এক ধরনের ছোট্ট খোলা গাড়ি) বাগান ঘুরে আসা যায় কিন্তু পর্যটকের তুলনায় এই গাড়ির সংখ্যা খুবই অপ্রতুল হওয়ায় এগুলো পাওয়াই মুশকিল হয়।

আমরাও চেস্টা করে পাইনি। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে বোট্যানিকাল গার্ডেনটি ঘুরে ঘুরে অসম্ভব সুন্দর এবং দুষ্প্রাপ্য কিছু বৃক্ষরাজি, অর্কিড, ক্যাকটাস, ব্যাম্বু( এত মোটা বাঁশ আমি জীবনেও দেখিনি), ঝুলন্ত সেতু এবং সর্বোপরি প্রতি গাছে ঝুলন্ত কয়েক কোটি বাদুর দেখে অন্তরে কিঞ্চিত ভীতি কিন্তু পরিতৃপ্তি নিয়ে নিয়ে আমরা উঠে বসলাম আমাদের গাড়িতে। সামনে নাগরিক জৌলুস আর চাকচিক্য নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে সমুদ্রের নোনা গন্ধ গায়ে মাখা, সাগর তীরে অবস্থিত রাবন রাজের সেই রাজধানী শহর কলম্বো ।

লিখেছেনঃ সাবিহা সুলতানা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com