গত কয়েক মাস আগে কে ভেবেছিল পৃথিবী এমন থমকে যাবে প্রাণঘাতী ভাইরাসের আক্রমণে! হাজারও পর্যটকে মুখরিত দর্শনীয় স্থানগুলো একরকম খাঁ খাঁ করছে মানুষের অভাবে। যদিও এই শূন্যতায় প্রকৃতির মোটেও ক্ষতি হয়নি, বরং আচমকা বিরতিতে আরও যেন ঢেলে সেজেছে স্বমহিমায়। করোনার প্রকোপ কমে আসায় পৃথিবীর অনেক দেশ আস্তে আস্তে শিথিল করছে মানুষের চলাচল। আবার হয়তো শিগগিরই মুখর হবে জনসমাগমে। এই ঘরবন্দি জীবনে অনেকেই পরিকল্পনা করছেন করোনার প্রকোপ কমলেই নতুন-নতুন গন্তব্যে বেরিয়ে পড়ার। ভ্রমণ ডায়েরি থেকে আজ থাকছে করোনাকালের আগে ঘুরে আসা রবীন্দ্রচর্চার তীর্থভূমি শান্তিনিকেতনের গল্প। আশা করছি, পাঠক বেশ উপভোগ করবেন পশ্চিমবঙ্গের পথে ঘোরার এই অনিশ্চিত যাত্রা—
মুর্শিদাবাদ থেকে সাতসকালেই রওয়ানা হলাম আজিমগঞ্জ স্টেশনে। এখান থেকে যে ট্রেনটি সরাসরি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বোলপুর যায় তার নামও কবিগুরু। দুর্ভাগ্যবশত মেরামতজনিত কারণে আজ তা বাতিল হয়েছে। অগত্যা রামপুরহাটের লোকাল ট্রেন ধরেই শান্তিনিকেতনের পথে যাত্রা শুরু করলাম।
যদিও ভিনদেশে তা ক্ষেত্রবিশেষে ঝুঁকিপূর্ণ, তবু একাকী এই যাত্রা আমার কাছে সব সময়ই ভিন্ন আমেজের। আশপাশের মানুষ দেখতে-দেখতে চলে যাওয়া যায়। লোকাল ট্রেনেও তাই। মুখোমুখি ১০ জন বসা এই সিট অ্যারেঞ্জমেন্টে আমার পাশেই বসেছে এক সাঁওতাল পরিবারের ল্যাদাগ্যাদা মিলিয়ে ১৩ জন। দারিদ্র্য তাদের জীর্ণ শরীরে, পোশাকে লেগে থাকলেও চোখেমুখে আনন্দের ছটা। বাড়ি থেকে দলবেঁধে সবাই এসেছিল গঙ্গাস্নানের উদ্দেশে। পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলে ভাষার ভিন্নতার পাশাপাশি জীবনযাপনে সরলতার ছাপ স্পষ্ট। আসলে পৃথিবীর সব দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের মুখ আমার কাছে একই রকম লাগে, মনে হয় যেন একটু বেশিই আপন।
রামপুরহাট পৌঁছাতেই সাড়ে ১১টা বেজে গেল। আশা ছিল এখান থেকেই বোলপুরের টিকেট পাব। পাওয়া গেল, তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো ঘণ্টাদুয়েক। অগত্যা লম্বা সময়ের অপেক্ষা ছেড়ে লোকজনের কাছে খোঁজখবর নিয়ে বাস স্টেশনের পথে রওয়ানা হলাম। যদিও বাসযাত্রায় হ্যাপাটা অনেক বেশি, তবু ক্ষুদ্র এ জীবনে এই সুবিশাল পৃথিবীর যতটা দেখে যেতে পারি ততটাই তো লাভ।
ব্যাটারিচালিত অটোতে করে রামপুরহাট ঘুরে ছুটলাম বাস স্টেশনের দিকে। স্টেশনের পাশেই মিষ্টির দোকান দেখে আর লোভ সামলানো গেল না। ছয়-সাত রকম প্লেটভরা সুস্বাদু মিষ্টির দাম অবিশ্বাস্যভাবে ৪৫ রুপি। পুরো পশ্চিমবঙ্গেই মিষ্টির দাম অত্যন্ত সুলভ। আমার মতো মিষ্টিপ্রেমীদের জন্য তা এক চমৎকার ব্যাপারই বটে।
স্টেশনে গিয়ে বোলপুরের বাস পেলেও তা প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে। বীরভূমের সিউরি স্টপেজের দিকে একটা বাস তখনই ছেড়ে যাচ্ছিল। সিউরি হয়েও বোলপুর যাওয়া যায়, জানতে পেরেই আর সাতপাঁচ না ভেবে টিকেট কেটে রওয়ানা হয়ে গেলাম। বিশাল হাইওয়ে ধরে বাস ছুটতে লাগল সিউরির পথে। বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম ভিনদেশের পথঘাট আর মানুষ।
রামপুরহাট থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগল সিউরি পৌঁছাতে। বাস থেকে নেমেই আগে কলা-রুটি খেয়ে দুপুরের খাবারের দুশ্চিন্তা মেটালাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বোলপুরের বাস খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কিছুক্ষণের অপেক্ষাতেই যাত্রা শুরু হলে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম গন্তব্যের পথে এগোচ্ছি ভেবে।
পশ্চিমবঙ্গের এই দিককার বাসগুলোর সিট একটু আঁটোসাটো, তাই চাপাচাপি করে বসতে হয় খানিকটা। এমনিতেই ভাড়ার পার্থক্যের কারণে স্থানীয়রা অগত্যা বাসে চড়ে, আর যেখানে ট্রেন সার্ভিস আছে সেখানে তো বাসের প্রশ্নই আসে না খুব জরুরি না হলে। পাশের সিটের বয়স্কা মহিলার সঙ্গে বেশ আলাপ হলো। একা-একাই ঘুরছি শুনে বেশ আশ্চর্য হলেন। শান্তিনিকেতনের কথা শুনে জানালেন তাঁর নাতিও সেখানে ভর্তি হয়েছে এ বছর। আরও কিছু টুকটাক গল্প শেষে ইস্তফা দিয়ে আমি জানালা ধরে মানুষ-প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিলাম। পশ্চিমবঙ্গের এই বীরভূমের কথা কত পড়েছি, শুনেছি নানান বইপত্রে-আলোচনায়। নিজের চোখে দেখাটা তাই মুগ্ধতার ব্যাপারই বটে।
বাস ছুটতে লাগল। রাস্তা যেন আর শেষ হয় না। দুপুর হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। অথচ আজিমগঞ্জ থেকে কবিগুরু ট্রেন ধরতে পারলে মোটামুটি ১১টার মধ্যেই পৌঁছাতে পারতাম শান্তিনিকেতন। তাতে অবশ্য মাঝের এই উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি আর বাস জার্নিটুকু হতো না। অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান শেষে ভরদুপুরে এসে পৌঁছালাম বোলপুর, কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে। বাস স্ট্যান্ড থেকেই খোঁজ নিলাম কলকাতার যাতায়াত মাধ্যমের। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম এখান থেকে কলকাতাযাত্রার একমাত্র পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হলো হাওড়াগামী ট্রেন। রিকশা নিয়ে প্রথমেই চলে গেলাম ট্রেন স্টেশনে। আজকের শেষ ট্রেনের খোঁজখবর নিয়ে অটো নিয়ে পৌঁছালাম আরাধ্য শান্তিনিকেতনে।
যেহেতু কলকাতা আজই ফেরার পরিকল্পনা তাই আর দেরি না করে ঘুরেফিরে দেখছিলাম। এত শান্ত-স্নিগ্ধ এলাকা যে হাঁটলেই মন ভালো হয়ে যায়। রবীন্দ্রচর্চার তীর্থস্থান হলেও এখানে পথেঘাটেই যে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পাওয়া যাবে বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। কিছু দূর হেঁটেই টের পেলাম এত বিশাল এলাকা পায়ে হেঁটে দেখে পোষানো যাবে না। গেটের কাছ থেকেই ১৫০ রুপিতে একটা টোটো বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করলাম। মজার ব্যাপার হলো সব টোটোচালকই এখানে গাইডের কাজ করে এবং প্রত্যেকটা স্থাপনার মুখস্থ বর্ণনা বলে যায় অবলীলায়। মুর্শিদাবাদেও এই জিনিসটা দেখেছি এবং অবশ্যই তা এই পেশাজীবীদের একটা দক্ষতা বটে।
শান্তিনিকেতনের যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৮৬৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। আশ্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠা হলেও রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে এখানে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়তে থাকে। যা ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ দিকের একটা লম্বা সময় এখানে কাটিয়েছেন, তাই শান্তিনিকেতনকে মনে করা হয় রবীন্দ্রচর্চার তীর্থভূমি।
শান্তিনিকেতন ক্যাম্পাস যেন আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই। তবে আরও বেশি শান্ত এবং কোলাহলমুক্ত। অনেকটা আমাদের জাহাঙ্গীরনগরের মতো। গৌড়প্রাঙ্গণের মাঠের পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় চমৎকার বিকেল। পাশেই ঐতিহাসিক ছাতিমতলা, দৃষ্টিনন্দন উপাসনা ভবন আর অন্য সব একাডেমিক বিল্ডিং ঘুরে দেখলাম। আরও কিছুদূর এগোতেই রাস্তার পাশেই চোখে পড়ল কিছু শিক্ষক কর্মকর্তাদের বাড়ি। দেখা হলো নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের বাড়িও। প্রত্যেক বাড়িতে অসাধারণ নান্দনিকতার ছাপ স্পষ্ট। পথে যেতে-যেতে নানান শিল্পকর্ম চোখে পড়ে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই টোটো চালক নিয়ে গেলেন নবনির্মিত বাংলাদেশ ভবন দেখাতে। খুব সম্প্রতিই মনে হয় ভবনটি চালু হয়েছে।
ঘড়ি দেখে টের পেলাম ফেরার ঘণ্টা বেজে এসেছে। এত বিশাল এলাকা নিয়ে শান্তিনিকেতন যে আসলেই স্বল্প সময়ে ঘুরে দেখা সম্ভব না। যদিও ফেরার পর কেবল আফসোসই হয়েছে একটা রাত বোলপুরে না থেকে। সময় স্বল্পতায় আসলে কিছু করারও ছিল না। তবে সবচেয়ে বেশি আফসোস রয়ে গেছে কোপাই নদী আর আদিবাসী এলাকা দেখতে না পারা। আশা রাখি, বেঁচে থাকলে আবার যাব কখনও এবং অবশ্যই লম্বা।