বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ০৮:০০ পূর্বাহ্ন

লাল শাপলার বিল সাতলা-বাগধা

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০২৫
বরিশালের সাতলা ও বাগধার খাল-বিলে ফোটে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা। এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আকর্ষণ সবার চেয়ে বেশী। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এ ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত বিল-ঝিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় লাল শাপলা। আবহমান কাল থেকে শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় সবজি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রতিদিন বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ভ্রমনপিসাসুরা স্ব-পরিবারে ছুটে আসছেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য শাপলার বিলের নয়নাভিরাম দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার জন্য।
শাপলার বিল ঘুরে দেখতে পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের সু-ব্যবস্থা। স্থানীয় চার উদ্যোক্তা পর্যটকদের জন্য বিলের মধ্যে খাওয়ার ও থাকার সু-ব্যবস্থা করেছেন। দেশ-বিদেশীদের কাছে শাপলার বিলের ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ও আগৈলঝাড়ার বাগধার বিলা লের স্বল্প আয়ের মানুষেরা অভাবী সংসারে এক সময় শাপলায়ই জীবিকা নির্বাহ করার কথা মানুষের মুখে এখনো শোনা যায়। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধী গুনে সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল একটি প্রিয় খেলনার পাশাপাশি অনন্ত সৌন্দর্যের আকর্ষণ।
পশ্চিম বারপাইকা গ্রামের প্রবীন ফেলু হালদার (৬০), সুধীর কীর্তনীয়া (৭৫) জানান, সাতলার জলাশয়ে দেখা যায় নয়নাভিরাম লাল শাপলা। ওইসব লাল শাপলার বিলে ছুঁটে চলেছেন প্রকৃতি প্রেমীরা। বর্ষা কাল থেকে শরৎকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত বিল এলাকায় মাইলের পর মাইল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নয়নাভিরাম রক্ত শাপলা বা লাল শাপলা। শুধু উপজেলার সাতলা গ্রামই নয় দক্ষিণ পশ্চিম বারপাইকা, আস্কর, নাঘিরপাড়, চাঁদত্রিশিরা, কড়াইবাড়ি বিল কদমবাড়ি, চৌদ্দমেধা বিল, কুড়লিয়া, রামশীল, শুয়াগ্রামসহ বিচ্ছিন্ন এলাকার জলাশয়ে লাল শাপলার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়।
বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদমাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রং-বেরঙের শাপলার বাহারী রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। মনে হত কোন এক সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ট জীব হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। এদৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। ওইসব লাল শাপলার বিলে ছুঁটে আসতেন প্রকৃতি প্রেমীরা। অনেকে আবার শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে বিক্রি কম করলেও স্বরুপকাঠির আটঘর, কুড়িয়ানা, ইন্দেরহাট, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন বর্ষা মৌসুমে বড় বড় নৌকায় করে তাদের এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। এ শাপলা শহুরে জীবনেও খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
আগৈলঝাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন জানান, সাধারণত শাপলা তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাদা, বেগুনী (হুন্দি শাপলা) ও অন্যটি লাল রংয়ের। এর মধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধী কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাক-শবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুন অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুন বেশি।
তিনি আরো বলেন, শাপলা চুলকানী ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। তাছাড়া ডায়াবেটিস, বুক জ্বালা, লিভার, ইউরিনারী সমস্যার সমাধানসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাণিজ্যিকভাবে শাপলার চাষাবাদ না হওয়ায় স্থানীয় কৃষি অফিসে এর কোন পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ওই কর্মকর্তার দাবি সাতলায় অন্তত ৫০-৬০ হেক্টর জমিতে শাপলা জন্মায়। তবে, স্থানীয় কৃষকরা আরও বেশী বলে জানিয়েছে। অনেকের কাছে শাপলা সৌন্দর্য আর আনন্দের বিষয় হলেও কৃষকের কাছে চরম বিরক্তিকর বলে দাবি করেছেন কৃষক দিনু বিশ্বাস, শ্যামল মন্ডল, জুরান বিশ্বাসসহ অনেকেই। তারা বলেন, বোরো মৌসুমের আগে জমিতে চাষাবাদের জন্য এই শাপলার কারণে জমি পরিস্কার করতে তাদের গুনতে হয় সাধারণের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ। ভাল চাষ না করতে পারলে জমিতে ফলনও কম পাওয়া যায়।
প্রতিদিন বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ভ্রমণ পিপাসুরা স্ব-পরিবারে ছুটে আসছেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য শাপলার বিলের নয়নাভিরাম দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার জন্য। শাপলার বিল ঘুরে দেখতে পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের সু-ব্যবস্থা। স্থানীয় চার উদ্যোক্তা পর্যটকদের জন্য বিলের মধ্যে খাওয়ার ও থাকার সু-ব্যবস্থা করেছেন। দেশ-বিদেশীদের কাছে শাপলার বিলের ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সাতলা গ্রামের আকর্ষণ ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিশেষখ্যাতি রয়েছে লাল শাপলার। গত কয়েক বছর থেকে ভ্রমনপিপাসুরা সাতলা গ্রামকে লাল শাপলার স্বর্গরাজ্য হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তবে সাতলা নামের সাথে শাপলার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই স্থানীয়দের কাছে। বিলে ঠিক কতো বছর আগে থেকে এভাবে শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে তারও কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেননি কেউ। এই বিলে শুধু শাপলাই ফোটে না, শীতের মৌসুমে যখন পানি কমে যায়, তখন এখানে কৃষকরা ধান চাষ করেন। সাধারণত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে এই বিলে লাল শাপলা ফুল ফোটে। সাতলার পরিচিতি: উজিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা সাতলা বর্তমানে একটি পর্যটকমুখী এলাকা হলেও এটি একটি বিলের নাম। একসময়ে বর্ষাকালে এটা সম্পূর্ণ ডুবে থাকতো। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত প্রথম সাতলায় বাঁধ দেয়ার কাজ শুরু করেন। তারপর বিল থেকে বিশাল এলাকা উত্থিত হয়ে বর্তমানে মনোরম এলাকায় পরিণত হয়েছে সাতলা গ্রাম। এই বিলে প্রাকৃতিকভাবে শাপলা ফোটে। ছোট নদী, হাওর ও বিলবেষ্টিত ছোট একটি গ্রাম সাতলা।
বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়ন। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজের মধ্যেই চোখে পরে লাল শাপলার আভা। কিছুটা সামনে গেলেই নিজ অস্তিত্বের জানান দেয় ফুটন্ত লাল শাপলা। আর আস্তে আস্তে পরিস্কার হতে থাকে সবুজের মাঝে লাল শাপলার অবস্থান। এ ইউনিয়নের উত্তর সাতলা গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ও খাজুরিয়া গ্রামের কয়েকশ’ হেক্টর জমি নিয়ে এ বিলের মূল অবস্থান। সবচেয়ে বেশি শাপলার উপস্থিতি দেখা মেলে সাতলার নয়াকান্দি ও মুড়িবাড়ি নামক এলাকায়। সাতলা শুধু লাল শাপলার উৎস নয়, বলা চলে এটি লাল শাপলার গ্রাম। স্থানীয়রা জানান, বিলের সৌন্দর্য উপভোগের উপযুক্ত সময় ভোর থেকে সকাল আটটা এবং পড়ন্ত বিকেলে শাপলার রূপ-সৌন্দর্য বেশি। সূর্যের তেজ বাড়তে থাকলে শাপলা ফুলের পাপড়ি ছোট হয়ে যায়। ভ্রমনপিপাসুরা দীর্ঘদিন থেকে সাতলা বিলকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছেন। এবিষয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়ার রহমান জানান, সাতলা বিলে পর্যটনকেন্দ্র করার বিষয়টি পর্যটন করপোরেশনকে জানানো হয়েছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com