শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:০২ অপরাহ্ন
Uncategorized

লক্ষ হ্রদের দেশ

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৬ মে, ২০২২

‘The guard blew the whistle. The train started to move. Then started running’ হেফজকৃত ইংরেজি রচনার সব ভুলে গেলেও এইটুকু মগজে রয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ে ভ্যাক্সজো রেলস্টেশনের গার্ডের বাঁশির শব্দে।

নরওয়ে থেকে কোপেনহেগেন। সুইডেনের জাতীয় (এসজে) রেলওয়ে। দৈর্ঘ্য দুই হাজার ১০০ কিলোমিটার। সময় ২৬ ঘণ্টা। বিশ্বের দীর্ঘতম রেলপথ ট্রান্স সাইবেরিয়ান। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রেলওয়ে। দৈর্ঘ্যরে দিক দিয়ে ট্রান্স সাইবেরিয়ানের সমান না হলেও গুরুত্বের দিক দিয়ে এসজে রেলওয়ে এগিয়ে রয়েছে। এসজে রেলওয়ে নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ক- এ তিনটি দেশ যুক্ত করেছে। যে তিনটি দেশ যুক্ত করেছে সে তিনটি দেশ প্রতিবারই ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস তালিকার শীর্ষ ১০ আসনের মধ্যে অবস্থান করে।

দ্বিতীয় আকর্ষণ, সুইডেনের তৃতীয় বৃহত্তর শহর মালমো। মালমোর আকর্ষণ টার্নি টরসো। মালমো থেকে কোপেনহেগেন ইউরোপের দীর্ঘতম সেতু ওরেসুন্ড (ঙৎবংঁহফ)। ট্রেন ওরেসুন্ড ব্রিজের ওপর দিয়ে চলতে চলতে পানকৌড়ির মতো সমুদ্রের জলে ডুব দেয়, ভেসে ওঠে কোপেনহেগেনে। তৎসঙ্গে রয়েছে সুইডেনের অতি পুরনো লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়, International students in Sweden with one third of all students choosing Lund University programmes.

বহুতলবিশিষ্ট কাঠের তৈরি ভ্যাক্সজো রেলস্টেশন। পায়ের তলায়, মাথার উপরে, ডানে ও বামে যে দিকে তাকাই সে দিকেই কাঠ। চোখ ঝলসানো কাঠের স্টেশন দেখা শেষ করে ট্রেনে আরোহণ। গার্ডের বাঁশির সাথে সাথে ট্রেন চলতে শুরু করতেই মনে পড়ে কবিগুরুর
‘বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা/দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু’
লক্ষ (৯৭ হাজার ৫০০টি হ্রদ রয়েছে) হ্রদের দেশ সুইডেন। সিন্ধুর দেখা না পেলেও বন-পাথর ও হ্রদ দেখে মন ভরে যায়। রাস্তার দু’পাশের বন-পাথর ও হ্রদ যেন ফুরায় না।

ঘণ্টাখানিক পরই আলবেস্তা স্টেশন। আইকিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ইঙ্গভার কামপ্রাডের জন্মস্থান আলবেস্তা। আইকিয়া (ওকঊঅ) নামটি এসেছে ওহাবৎ কধসঢ়ৎধফ ঊষসঃ অৎুফ নামের আদ্যাক্ষর থেকে। ওহাবৎ কধসঢ়ৎধফ-এর গাঁয়ের নাম ঊষসঃ অৎুফ. প্রথমবার লন্ডন এসে একটি ‘ম্যাজিক সোফা’ আমার নজর কাড়ে। ‘ম্যাজিক সোফা’ বলার কারণ, সোফা থেকে উঠে বাথরুমে যাই। বাথরুম থেকে বের হয়ে যেখানে সোফাটি দেখেছিলাম, সেখানে একটি খাট। বাথরুম থেকে বের হতে না হতে সোফাটি যে কৌশলে খাটে রূপান্তর হয়েছিল সেই কৌশলের প্রবর্তক ছিলেন ইঙ্গভার কামপ্রাড। লন্ডনের মতো অনেক দেশেই বাসস্থান সীমিত। সীমিত বাসস্থানে যে হারে লোকসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে খাট-সোফা বাড়ানো সম্ভব নয়। এ কারণেই আইকিয়ারে জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়ে। এখানে আইকিয়ারে একটি মিউজিয়ামও রয়েছে।

সর্বস্তরে ডিজিটালাইজেশন দেখে যে প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তা হলো- হিমমণ্ডলের জনমানব বিরল বন-পাথরের দেশ সুইডেন, ফসলের মাঠ নেই, মাটিতে লাঙল ধরলে বের হয়ে আসে পাথর, বাসের অযোগ্য বলে যে দেশের মানুষ পাড়ি দিত বহির্বিশে^, সে দেশটি উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাল কী করে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই সামনে চলে আসে ‘গবেষণা’। গবেষণা বা জবংবধৎপয একটি জাতিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ সুইডেন। উষ্ণমণ্ডলের মানুষ যখন চায়ের দোকানে আড্ডাসহ পরচর্চায় ব্যস্ত তখন হিমমণ্ডলের মানুষ ঘরের কোণে নিবিষ্ট মনে ব্যস্ত থাকে গবেষণায়।  যখন করোনায় হিমশিম খায়, তখনো সুইডেন অটল। আলফ্রেড নোবেলের জন্ম এই সুইডেনেই। নোবেলের ডিনামাইট পাহাড় চূর্ণ, টানেল তৈরি, নির্মাণকাজসহ চলাচলের রাস্তা তৈরি করছে। সুইডেন একের পর এক আবিষ্কার দিয়ে চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভলভোর নকশা প্রকৌশলী নিলস বোহলিন তিন পয়েন্টযুক্ত সিটবেল্ট তৈরি করেন। তিন পয়েন্ট সিটবেল্ট প্রতি ছয় মিনিটে একটি জীবন বাঁচানোর দাবি করে থাকে। ঘঐঞঝঅ (ঘধঃরড়হধষ ঐরমযধিু ঞৎধভভরপ ঝধভবঃু অফসরহরংঃৎধঃরড়হ টঝঅ) দাবি করে যে, ২০১৬ সালে সিট বেল্ট প্রায় ১৫ হাজার প্রাণ বাঁচিয়েছে। প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু হয়েছে গাড়ি দুর্ঘটনায়। সিটবেল্ট বাঁধা থাকলে অন্তত ডায়ানা বেঁচে যেতে পারতেন। সর্বশেষ, সুইডেনের ক্যারোলিস্কা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে আবিষ্কার করেছে করোনার টিকা। যে টিকা সুঁই ফোটানো ছাড়াই নেয়া যায় নাক দিয়ে। যে গবেষণাগারের অভাবে আমাদের সরকারি-বেসরকারি দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে রয়েছে।

এ বিষয়ে পৃথক প্রবন্ধে আলোচনার দাবি রেখে রাস্তার দিকে চোখ রাখি। সুইডেনের দক্ষিণ সীমান্তের শেষ শহর মালমো। যতই দক্ষিণ সীমান্তের দিকে যাচ্ছি ততই বাড়ছে ফসলের জমি, কমছে বন। এ দেশে নামমাত্র লিজে চাষ করার জন্য জমি পাওয়া যায়। সরকার বন কেটে ও পাথর সরিয়ে জমি চাষের উপযোগী করে দেয়। গাছ কেটে পরিষ্কার করার চেয়ে পাথর সরানো বড়ই কঠিন কাজ। তাই, বড় পাথর জমিতেই রেখে দেয়া হয়। জমির আইলে পাথর স্ত‚প দিয়ে রেখে দেয়ার পরও মাটির ঢেলার মতো অসংখ্য পাথর জমিতেই পড়ে থাকে। একরের পর একর সবুজ ফসলের মধ্যে সরিষার ক্ষেত দেখলেই মনে পড়ে দেশের কথা। ছড়ানো ছিটানো দু-একটা বাড়ি। কোথাও কোথাও কাঠ বোঝাই ট্রেনের বগি। প্রসেসকৃত কাঠ বোঝায় করা শত শত বগি দেশ থেকে দেশান্তরে স্থানান্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়িঘরের আদল দেখে মনে হয়, যাদের বাড়ি তারাই খামারি কিংবা খামাদের কর্মচারী। খামার এলাকায় বন-জঙ্গল কম। কখনো কখনো দূরে জমির আইলে সারিসারি গাছ ঠিক ছবির মতো। বৈদ্যুতিক লাইনের উঁচু টাওয়ার।

চলতে চলতে ট্রেনটি আন্ডারগ্রাউন্ডে প্রবেশ করে। বুঝতে পারি, মালমো পৌঁছে গেছি। মালমো না নামলে এই ট্রেনই আমাদের কোপেনহেগেন নিয়ে যেত। আমরা সরাসরি কোপেনহেগেন না গিয়ে মালমো নেমে পড়ি। গভীর মাটির তলার স্টেশন থেকে কয়েক ধাপ চলমান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই দেখি, মালমোর সেন্ট্রাল স্টেশন, সুইডেনের মতোই বড় বড় বাস, সাইকেল ও স্কুটির দৌরাত্ম্য। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সেন্টার, নয়নকাড়া বহুতল ভবন। আকাশ ভেদ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে শত বছরের পুরনো গির্জা। পেছনে বাম দিকে নীল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটি ভবন। সামনেই চোখধাঁধানো মালমো বিশ্ববিদ্যালয়ের জোড়া ভবন।

মালমোর প্রধান আকর্ষণ টার্নি টরসো। Turning Torso is a neo-futurist residential skyscraper in Sweden and the tallest building in Scandinavia. It is regarded as the first twisted skyscraper in the world.
মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখার জন্য একসময় ট্যুরিস্ট হুমড়ি খেয়ে পড়ত। মালমোর টার্নি টরসো দেখার জন্য আমরাও হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com