কল্পনা করুন, আপনি একটি জঙ্গলে বাঁশের ভেলায় ভাসছেন। দুই দিকে দালানের মতো উঠে যাওয়া খাড়া পাহাড়। নাম সিপ্পি পাহাড়। খাড়া পাহাড়ের সরু উপত্যকায় যে জলধার বা খুম গড়ে উঠেছে, সেটি পরিচিত দেবতাখুম নামে।
ঘন বনজঙ্গল আর এই খাড়া পাহাড়ের জন্য দিনের বেলা খুমের ভেতরের দিকটায় আলো ঠিকমতো পৌঁছায় না। ভেলা ভাসিয়ে যত ভেতরে যেতে থাকবেন পরিবেশ ততই ঠান্ডা আর নিস্তব্ধ হতে থাকবে। নিস্তব্ধতা এমনি থাকবে যে দূরে পাতা থেকে পানি পড়ার শব্দ, এমনকি নিজের নিশ্বাসের শব্দও ভালোভাবে শুনতে পারবেন।
এখানকার পাহাড়ি অধিবাসীদের মুখে প্রচলিত আছে, এই কুমে বিরাট একটি কচ্ছপ বা অন্য কোনো নাম না জানা প্রাণী রয়েছে। যার ওজন ২ মণের বেশি হবে। অনেকেই এই প্রাণীটি দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে এসব লোমহর্ষক গল্প আর এই কুমের ভুতুড়ে পরিবেশ এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেয়।
এটি বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অবস্থিত পং সু আং খুম, দেবতাখুমের গল্প। খুব অল্প সময়ে ও কম খরচে এখান থেকে রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে আসতে পারবেন।
দেবতাখুমের পরেই স্বর্ণখুম। অভিযাত্রী দল হিসেবে আমরাই প্রথম স্বর্ণখুমে পৌঁছাই।
রোয়াংছড়ির পর কচ্ছপতলী। সে ক্ষেত্রে অটোরিকশা নিলে সরাসরি কচ্ছপতলী চলে আসাই ভালো। যেতে সময় লাগবে আধঘণ্টার মতো। কচ্ছপতলী আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিয়ে রওনা দিন শিলবান্ধা পাড়ার দিকে। যেতে সময় লাগবে দেড় ঘণ্টার মতো।
দুভাবে যেতে পারবেন। পাহাড় অথবা তারাসা খাল দিয়ে। যাওয়ার সময় ঝিরি পথে গিয়ে আসার সময় পাহাড় দিয়ে এলে দুটি পথই দেখা যায়।
যাওয়ার পথ কিন্তু সহজ নয়। শিলবান্ধা গিয়ে ১৫ মিনিট হাঁটলেই প্রথমে পং সু আং খুম পার হতে হবে। পং সু আং খুম পার হওয়ার পর দেবতাকুমের শুরু।
স্থানীয় আদিবাসীদের মতে, দেবতাখুম ৫০ ফুট গভীর এবং লম্বায় ৬০০ ফুটের বেশি। দেবতাখুমে যাওয়ার শেষের দিকে রাস্তা খুব বিপজ্জনক। শেওলা ভরা খাড়া পাথর দিয়ে গাছের শিকড় ধরে প্রায় ঝুলে ঝুলে যেতে হয়। হাত ফসকে পড়ে গেলে সাঁতার না জানলে গভীর জলে ডুবে বা পাথরে মাথা ফেটে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। তাই নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট নিয়ে যেতে পারেন।
শিলবান্ধার আশপাশে ঘুরলে ছোট বড় ৫-৬টা ঝরনা পাবেন। শিলবান্ধা থেকে সঙ্গে গাইড নিয়ে নিন। গাইডের জন্য ৬০০ টাকা আর ভেলার জন্য জনপ্রতি ৫০টাকা লাগবে। পুরো দেবতাখুম ঘুরে আসতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগবে। দিনে বান্দরবান পৌঁছে যেতে পারবেন দেবতাখুমে। পাথর, পাহাড়, খুম, ঝর্ণা ও বনফুলের সৌরভে এই ভ্রমণ হয়ে উঠবে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ।
যেভাবে যাবেন ও খরচ:
এখানে যেতে হলে প্রথমে বান্দরবান শহর থেকে রোয়াংছড়ি উপজেলায় আসতে হবে। জনপ্রতি বাস ভাড়া ৬০ টাকা আর সিএনজি চালিত অটোরিকশা রিজার্ভ নিলে ৫০০ টাকা। সেখান থেকে গাইড নিয়ে কচ্ছপতলী আসতে হবে। এছাড়া আপনি চাইলে বান্দরবান শহর থেকে সরাসরি জিপেও কচ্ছপতলী চলে যেতে পারেন। জিপ ভাড়া ১৮০০ টাকা। এক জিপে ১২/১৩ জন বসতে পারবেন।
যেভাবে বান্দরবান যাবেন:
দেবতাখুম যেতে হলে প্রথমে বান্দরবান যেতে হবে। ঢাকা থেকে এসি/নন এসি সব ধরনের বাসই বান্দরবান যায়। নন এসির মধ্যে শ্যামলী, সৌদিয়া, ইউনিক, ডলফিন, সেন্টমার্টিন, এস আলম ইত্যাদি পরিবহনের বাস পাবেন। বাস ছাড়ে কলাবাগান, ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে। ভাড়া ৫৮০ থেকে ৬২০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।
ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো ট্রেনে উঠতে হবে। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, সূবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশীথা, চট্টলা, মহানগর ও গোধুলী সহ অনেকগুলো ট্রেইন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ট্রেন ও আসন ভেদে ভাড়া ২০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।
চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানের বাস ছাড়ে নতুন ব্রিজ, দামপাড়া ও বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে। বহদ্দারহাট থেকে ৩০ মিনিট পরপর ‘পূর্বাণী’ ও ‘পূরবী’ নামে দুটি পরিবহনের বাস ছাড়ে। ভাড়া ২২০ টাকা।
কোথায় খাবেন:
কচ্ছপতলী পৌঁছে ট্রেকিং শুরু করার আগেই দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে নিন। নয়তো পরে খাবার পাবেন না। আপনি অর্ডার করলেই মূলত তারা রান্না করবে। মুরগী মাংস, ডাল আর আলু ভর্তা পাবেন। খাবার খরচ আসবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মতো।
কোথায় থাকবেন:
আপনি সকালে বান্দরবান থেকে দেবতাখুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে সন্ধ্যার মধ্যেই আবার শহরে এসে পৌঁছাতে পারবেন। তাই আপনি চাইলে রাতের খাবার শেষে সেদিনই ঢাকা অথবা আপনার গন্তব্যে ফিরে আসতে পারেন। আর থেকে যেতে চাইলে বান্দরবান শহরে বিভিন্ন মানের বেশ কিছু হোটেল রয়েছে।
দেবতাখুম ভ্রমণ তথ্য ও সতর্কতা:
কচ্ছপতলীতে গিয়ে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে জাতীয় পরিচয়পত্র বা বিদেশি হলে পার্সপোটের ফটোকপি লাগবে। তারপরই দেবতাখুমে ঢুকতে পারবেন।
কচ্ছপতলীর পর থেকে ফোনে নেটওয়ার্ক পাবেন না। ট্রেকিংয়ের জন্য ট্রেকিং বুট ব্যবহার করুন। চাইলে প্লাস্টিক বা রাবারের স্যান্ডেল ব্যবহার করতে পারেন। ভেলায় চড়ার জন্য ওখানে লাইফ জ্যাকেট আছে, সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।