ক্রিস গার্ডনার এমনই এক মানুষ, যিনি শূন্য থেকে শুরু করে সাম্রাজ্য গড়েছেন। একসময় ছিলেন নিঃস্ব, গৃহহীন। ফুটপাত ও রেলস্টেশনের টয়লেটে রাত কাটিয়েছেন। নিজ চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, শেয়ার ব্যবসা করে কামিয়েছেন মিলিয়ন ডলার। একসময় ব্যবসা ছেড়ে হয়েছেন পুরোদস্তুর অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা ও লেখক। সর্বাধিক বিক্রিত তালিকায় উঠেছে তার বই, জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র।
গার্ডনারের জীবনযুদ্ধ বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে তার শৈশবে। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াওকি শহরে তার জন্ম। থাকতেন মা আর সৎ বাবার সাথে। নিজের বাবার পরিচয় কখনোই জানতে পারেননি। সৎ বাবা পাঁড় মদ্যপ। প্রতিদিনই গার্ডনার ও তার মায়ের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাতেন।
গার্ডনারের মা একবার অত্যাচারী স্বামীকে খুন করার চেষ্টা করেন। এ কারণে তাকে সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। গার্ডনারকে স্থানীয় নিঃসন্তান এক দম্পতির কাছে দত্তক দেওয়া হয়। এত কিছুর পরেও তার কাছে মা একজন ‘অনুপ্রেরণাদায়ী’ মানুষ।
পারসুট অব হ্যাপিনেস সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করা উইল স্মিথের সাথেতার ভাষায়, ‘আমার মা প্রতিদিনই বলতেন, তুমি যা করতে চাও একদিন অবশ্যই তা করতে পারবে। আমি এটা বিশ্বাস করতাম এবং সে অনুযায়ী কাজ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। তিনি আমাকে বলতেন, তুমি অবশ্যই একদিন মিলিয়ন ডলারের মালিক হবে। কিন্তু তখন আমি এতটাই ছোট ছিলাম যে, তার কথাগুলোর মানে পুরোপুরি বুঝতাম না।’
পড়াশোনা শেষে চার বছর মার্কিন নেভিতে কাজ করেন গার্ডনার। ১৯৭৪ সালে চাকরি ছেড়ে সানফ্রান্সিসকো চলে আসেন। সেখানে চিকিৎসা উপকরণ বিক্রির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে লোকসান দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। আশির দশকের গোড়ার দিকে তার বয়স তখন ২৭ বছর। চাকরি নেই, পকেটে টাকা নেই, নেই কোনো থাকার জায়গা। বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়ে বসবাসের জন্য শহরের ফুটপাতকে বেছে নেন গৃহহীন গার্ডনার।
একদিন পার্কিংয়ে একজন লোককে লাল রঙের একটি ‘ফেরারি’ গাড়ি রাখতে দেখে তিনি তার পেশা জিজ্ঞেস করেন। জবাবে লোকটি নিজেকে বব ব্রিজ নামে পরিচয় দিয়ে জানান, তিনি একজন স্টক ব্রোকার। এসময় গার্ডনারও এ পেশার বিষয়ে আগ্রহী হন। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ববই তাকে ডিন উইটার রেনল্ড (ডিডব্লিউআর) নামে একটি ব্রোকারেজ হাউজে কাজের খোঁজ দেন।
প্রতিষ্ঠানটিতে ইন্টারভিউ দেওয়ার একদিন আগে তিনি অবৈধ পার্কিংয়ের অভিযোগে গ্রেফতার হন। সেসময় তার মাত্র এক সেট পোশাক ছিল। সেই পোশাকেই সারারাত জেল খেটে সকালে ছাড়া পান। এরপর মলিন পোশাকেই ইন্টারভিউ দিতে যান। কিন্তু অবিচল মনোভাব ও উদ্যম তাকে কাজ জুটিয়ে দেয়।
তবে এ চাকরিতে বেতন এতই অল্প ছিল যে, দু’জনের পেট ভরিয়ে বাড়ি ভাড়া নেওয়া সম্ভব ছিল না। এমনও দিন গেছে ফুটপাতে, রেলস্টেশনের টয়লেটে, পার্কের বেঞ্চে, চার্চের বারান্দায় কিংবা অফিসে সবাই চলে গেলে নিজের ডেস্কের নিচে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে নিয়ে। সেসময় যখন যেখানে সুবিধা হয়েছে, সেখানেই রাত কাটিয়েছেন তিনি।
প্রশিক্ষণ শেষে ডিডব্লিউআর তাকে স্থায়ী কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়। বেতন বাড়লে, নিজের ও ছেলের জন্য ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া নেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্পসময় পরে ১৯৮৭ সালেই ‘গার্ডনার রিচ’ নামে নিজের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান খুলেন। পরের সময়গুলোতে একজন সফল শেয়ার ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে গার্ডনারের।
২০১২ সালে স্ত্রী ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ ঘটনা তাকে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়, পরিবর্তন আনে তার পেশাগত পরিচয়ে। শেয়ার বাজারে আড়াই দশকের সফল ক্যারিয়ার পেছনে ফেলে তিনি মোটিভেশনাল বক্তা ও লেখক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
গার্ডনার এখন মোটিভেশনাল বক্তাতার ভাষায়, ‘আমার স্ত্রীর সাথে শেষ কথোপকথনে আমার জীবন সম্পর্কে ভাবনা পাল্টে যায়। আমি বুঝতে পারি, জীবন আসলেই ছোট। এ ছোট্ট জীবনে আপনি আসলেই যা করতে চান, তা করতে না পারলে প্রতিদিনই নিজের সাথে আপোষ করে চলতে হবে। এটা খুবই বেদনাদায়ক।’
গার্ডনারের বয়স এখন ৬২ বছর। তার সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি ডলার। মোটিভেশনাল বক্তা হিসেবে বিশ্বের ৫০টি দেশ ঘুরেছেন। বক্তব্য দিয়েছেন হাজারো আয়োজনে। বছরে ২০০ দিন বরাদ্দ রেখেছেন এ কাজে। নিজের অতীত মনে রেখে অসংখ্য গৃহহীন মানুষকে সাহায্য করেন। কাজ করেন নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে। গার্ডনারের মতে, অন্যকে ভালোবাসা ও সাহায্য করার মতো ইতিবাচক মানসিকতা তিনি তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন।
‘দ্য পারসুইট অব হ্যাপিনেস’ নামে আত্মজীবনী লিখেছেন গার্ডনার। বইটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেস্ট সেলারের মর্যাদা পেয়েছে। এ বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই একই নামে সিনেমা হয়েছে হলিউডে। ২০০৬ সালে মুক্তি পাওয়া এ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন শক্তিমান অভিনেতা উইল স্মিথ। এ চরিত্র স্মিথকে এনে দেয় সেরা অভিনেতা ক্যাটাগরিতে অস্কার মনোনয়ন।
যুক্তররাষ্ট্রের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মর্নিংস্টারের পরিচালক স্কট বার্নস গার্ডনার সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি হলেন সহিষ্ণুতার অনন্য উদাহরণ। তিনি কখনোই হার মানতে চান না। এ কারণেই তিনি আজ সফল একজন ব্যক্তি।’
আজ অনেকের কাছেই গার্ডনারকে আদর্শ। তার আত্মজীবনী পড়ে, তার ওপর নির্মিত সিনেমা দেখে অনেকেই নিজের জীবনে অনুপ্রেরণা পান। গৃহহীন অবস্থা থেকে তিনি আজ মিলিওনিয়ার। তবে গার্ডনারের ধনী হওয়ার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। সাধনা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য্য ও কঠোর পরিশ্রমের কারণে তিনি শূন্য থেকে শুরু করে সফলভাবে অর্জনের খাতা ভরেছেন।
তথ্যসূত্র: বিবিসি