যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত এলিয়েন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরী হয়েছে অবৈধ ও বৈধ অভিবাসীদের মধ্যে। কারা এ নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় বাধ্যতামূলক সেটি নিয়ে স্পষ্টতা না থাকায় দ্বিধাগ্রস্ত অভিবাসীরা। এ নিবন্ধন করলেই যে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদে থাকতে পারবেন তেমন কোন নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়নি। এটি কেবল একটি আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ করার প্রক্রিয়া। এমন পরিস্থিতিতে নিবন্ধন করলেও কতটুকু নিরাপদ আবার না করলে জেল জরিমানা, এমন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তা ভর করেছে অবৈধ ও বৈধ অভিবাসীদের মধ্যে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক বিদেশী শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি কারণে তাদের শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি। এদিকে ভিসা বাতিলের ঘটনায় বিদেশী শিক্ষার্থীসহ ১৩৩ জন আদালতে ট্রাম্প প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। আর এসব শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিলে ফিলিস্তিনপন্থী কিংবা আমেরিকা কর্তৃক চিহ্নিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির সমর্থনের অভিযোগ এবং ইহুদি বিদ্বেষী অভিযোগ আনা হয়। এছাড়াও লঘু অপরাধেও ভিসা বাতিলের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
গত ১ মাসে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর হাজারের বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করেছে। এতে তবে এসব ভিসা বাতিলের সুনির্দিষ্ট কারণ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই জানেনা। যেসব শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
এদিকে ভিসা বাতিলের ঘটনায় শিক্ষার্থী সহ ১৩৩ জন বিদেশী নাগরিক আটলান্টার উত্তর জর্জিয়ার জেলা আদালতে মামলা করেছেন। এতে অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডী, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি ক্রিস্টি নোয়েম এবং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক টড লিওনসকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে এ মামলায় আক্রোশের শিকার না হন সেজন্য বাদিদের প্রকৃত নামের বদলে ছদ্মনামে চিহ্নিত করা হয়ছে।
মামলাটিতে বলা হয়েছে, যে আইস হঠাৎ করে গ্রেপ্তার চালায় যা যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশী শিক্ষার্থীদের আইনি মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। প্রশাসন মূলত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং দেশে তাদের অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য বজায় রাখার জন্য ডিপার্টমেন্ট হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দ্বারা ব্যবহৃত স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেম (এসইভিআইএস) থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে তাদের মর্যাদা বাতিল করেছে।
সিএনএন ও লসএঞ্জেলসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসী দমন-পীড়নের অংশ হিসাবে দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করেছে। তবে এসব ভিসা বাতিলের সুনির্দিষ্ট কারণ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই জানেনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবৃতি এবং মুখপাত্রদের বরাত দিয়ে সিএনএন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৩০ টিরও বেশি বিদ্যালয়ের এক হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং সাম্প্রতিক স্নাতকদের এই বছর স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেমে তাদের ভিসা বা স্ট্যাটাস বাতিল করা হয়েছে। ৪০টি রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাদের শিক্ষার্থীদের ভিসা এবং স্ট্যাটাস সমাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
মিডল টেনেসি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র জিমি হার্ট জানিয়েছেন, মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয়জন শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভিসা স্ট্যাটাস পরিবর্তনের নির্দিষ্ট কারণ জানে না।
বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে সরকার তার পদক্ষেপের কারণ জানায়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ব্যবস্থাটি যাচাই করে ভিসা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে যে তারা জানে কেন তাদের শিক্ষার্থীদের ভিসা বা সেভিস অ্যাকাউন্ট বাতিল করা হয়েছে।
ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র এরিক হাওয়াল্ড বলেন, ‘অনির্দিষ্ট ফৌজদারি অভিযোগের ভিত্তিতে গত কয়েক সপ্তাহে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ ইউওতে চারজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসার মর্যাদা বাতিল করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে আগে থেকে জানানো হয়নি এবং ফৌজদারি অভিযোগের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়নি।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অবৈধ ও বৈধ অভিবাসী রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রন্তি ও শঙ্কা তৈরী হয়েছে অভিবাসন প্রত্যাশীদেরও মধ্যে। ট্রাম্প প্রশাসন এলিয়েন রেজিস্টেশন অ্যাক্ট এর অধীনে অবৈধ অভিবাসী রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়। ১১ এপ্রিল থেকে চালু হয় রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া। রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলকের পর দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে লাখ লাখ অভিবাসীদের। এই নিবন্ধন করলে একজনের ব্যক্তিগত সকল তথ্য সরকারের কাছে জমা পড়বে। এ নিবন্ধন করলেই যে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদে থাকতে পারবেন তেমন কোন নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়নি। এটি কেবল একটি আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ করার প্রক্রিয়া। এমন পরিস্থিতিতে নিবন্ধন করা বা না করাই দুটোই যেন বিপদ। এতে অভিবাসীদের যেকোন মুহূর্তেই ট্র্যাক বা আটক করতে পারবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অপরদিকে নিবন্ধন না করলে ৬ মাসের জেল এবং ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানার বিধান করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এই নিবন্ধন কোনোভাবেই বৈধ বসবাসের অনুমতি প্রদান করে না। বরং ফর্মে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিবাসন বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবস্থান নির্ধারণ করে গ্রেপ্তার ও ডিপোর্ট করার কাজ শুরু করতে পারে। নিবন্ধনে বসবাসের ঠিকানা, অভিবাসন অবস্থা সকল তথ্য দিতে হয়। যা ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।
ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক অভিবাসী হয়তো নিজের অজান্তেই ইতোমধ্যে নিবন্ধিত আছেন। যেমন, যারা গ্রিন কার্ড, কাজের অনুমতিপত্র, আই-৯৪ অথবা ইমিগ্রেশন কোর্টের নোটিশ পেয়েছেন। তারা আইনত নিবন্ধিত হিসেবে বিবেচিত হন এবং নতুন করে এই ফর্ম পূরণের দরকার নেই।
ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি জানিয়েছে, এই আইনের আওতায় ১৮ বছরের বেশি বয়সী অভিবাসীদের যাদের কোন বৈধ নিবন্ধন নেই তারা সরকার নির্ধারিত ফর্ম পূরণ করে নিবন্ধন করতে হবে। এছাড়া অভিবাসী কেউ ঠিকানা পরিবর্তন করলে ১০ দিনের মধ্যে তা জানাতে হবে। অন্যথায় উচ্চ জরিমানা কিংবা কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হতে পারেন তারা।
বৈধ ভিসায় যারা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন, যেমন বি১/বি২, এইচওয়ান ভিসায়। তাদের এদেশে ৩০ দিনের বেশি অবস্থান করলে নিবন্ধন করতে হবে। যদি কেউ নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের চূড়ান্ত নির্দেশ পাওয়ার পর প্রতিদিনের জন্য ৯৯৮ ডলার করে জরিমানা দিতে হবে।
আর যদি কোনো বিদেশি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করবে এমন ঘোষণা দেওয়ার পরও তা না করেন, তাহলে তাকে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হবে। এমনকি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে অভিবাসনের ক্ষেত্রে তাদের আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
নিবন্ধনের জন ‘জি-৩২৫আর’ নামের একটি ফর্ম চালু করা হয়েছে। যার মাধ্যমে অনিবন্ধিত বিদেশিরা অনলাইনে আবেদন করে বায়োমেট্রিক তথ্য জমা দিতে পারবেন। যদিও গ্রিন কার্ডধারী বা বৈধ ভিসার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিবাসীরা ইতোমধ্যে নিবন্ধিত বলে বিবেচিত হবেন। তবে তাদেরও সব সময় বৈধ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। প্রশাসনের মতে, এটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে কার্যকর করা হচ্ছে।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সেক্রেটারী ক্রিস্টি নোয়েম বলেন, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব অভিবাসীর উচিত তাদের বৈধ অবস্থানের প্রমাণ সব সময় সঙ্গে রাখা। কেউ যদি নিয়ম লঙ্ঘন করেন, তাহলে তার জন্য এই দেশে কোনো নিরাপদ স্থান থাকবে না।