জার্মানির সেন্ট্রাল রেজিস্টার অব ফরেনার্স জানিয়েছে, এ বছরের জুনের শেষ দিকে এসে দেশটিতে ৩২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ আশ্রয়প্রক্রিয়ার নিবন্ধিত হয়েছেন৷ শেষ ছয় মাস আগের চেয়ে সংখ্যাটি অন্তত এক লাখ ১১ হাজার বেশি৷
নিবন্ধিতদের মধ্যে রয়েছে স্বীকৃত শরণার্থী, যুদ্ধবিধ্বস্ত উদ্বাস্তু, আশ্রয়প্রার্থী এবং বিশেষ বিবেচনায় অবস্থান করা (ডুলডুং) মানুষেরা৷
জার্মান পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগে বাম দলের সদস্য ক্লারা বুঙ্গেরের প্রশ্নের জবাবে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
সংঘাতে বাড়ছে অভিবাসন
অনিয়মিত অভিবাসন প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার পেছেন দ্বন্দ্ব আর সংঘাতকে চিহ্নিত করেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো৷ বিশেষ করে আফগানিস্তান ও ইউক্রেনে চলমান সংঘাত, সহিংসতাকে সামনে এনেছেন তারা৷
ইউক্রেন থেকে আরো প্রায় ২৯ হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন জার্মানিতে৷ সবমিলিয়ে, জার্মানিতে ইউক্রেনীয়দের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে৷ যুক্ত হয়েছে, অতিরিক্ত চার হাজার আফগান নাগরিক৷
ডুলডুং নিয়ে থাকছেন অনেকে
সেন্ট্রাল রেজিস্টার অব ফরেনার্সের হিসাবে দুই লাখ ৭৯ হাজার ৯৮ জন ব্যক্তির আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে৷ তাদের সবাইকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর কথা৷ কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় তাদের এখনও ফেরত পাঠানো হয়নি৷
আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়ার পরেও যাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠালে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে কিংবা স্বাস্থ্যগত কারণে জটিলতায় ভুগছেন তাদের অস্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দেয় জার্মানি৷ আর এই বিশেষ বিবেচনাটি ডুলডুং বা সহনশীলতা পারমিট নামে পরিচিত৷
পরিসংখ্যান বলছে, যাদের আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে, তাদের ৮০ শতাংশ মানুষের ডুলডুং আছে৷ ফলে তাদের ফেরত পাঠানোর আপাতত সুযোগ নেই৷ আবার ২৫ শতাংশ ব্যক্তির কাছে নেই কোনো ভ্রমণ নথি৷ নিজ দেশের দূতাবাস থেকেও তারা সেটা নিতে পারছেন না, সেসব ব্যক্তিদেরও ডুলডুং দেয়া হয়েছে৷
নিরাপদ দেশের তালিকা
জার্মানির কিছু রাজনীতিবিদ, যেমন খ্রিশ্চিয়ান গণতন্ত্রী নেতা ফ্রাইডরিশ মের্ৎস ‘ডুলডুং’-এর অধীনে জার্মানিতে অবস্থানরত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জের ধরে পরামর্শ রেখেছেন৷ তিনি বলছেন, নিরাপদ দেশগুলোর তালিকা আরো বড় করা উচিত৷ তাহলে, আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া ব্যক্তিদের ডিপোর্ট করা সহজ হবে৷
সপ্তাহ দুয়েক আগে মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এ (সাবেক টুইটার) মের্ৎস লিখেছেন, টিউনিশিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া এবং ভারতকেও নিরাপদ দেশ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত৷ একইসঙ্গে মলদোভাকেও নিরাপদ দেশের তালিকায় যুক্ত করার পরামর্শ রাখেন তিনি৷
তার দিন কয়েক পর, মলডোভা এবং জর্জিয়াকে নিরাপদ দেশ হিসাবে অন্তর্ভুক্তিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেসারের আনা খসড়া আইনে সম্মতি দিয়েছে জার্মান মন্ত্রিসভা৷
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক অবশ্য সেই তালিকা বিস্তৃত করার বিরোধিতা করছেন৷ তিনি বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত মূলত অভ্যন্তরীণ গতি প্রকৃতি বিবেচনা করে নেয়া উচিত৷ এর সঙ্গে পররাষ্ট্র নীতিকে মিলিয়ে ফেলা উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি৷
অবশ্য নিরাপদ দেশের তালিকায় জর্জিয়া এবং মলডোভাকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বেয়ারবক৷ এ মাসের শেষ দিকে, পার্লামেন্টে এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে৷
ফুঙ্কে মিডিয়া গ্রুপকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশ দুটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ নিতেই ভালো করছিল৷ আইনের শাসন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে বলেও অভিমত তার৷
বর্তমানে, জার্মানির তালিকায় নিরাপদ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত সব দেশ, ঘানা, সেনেগাল, বসনিয়া-হার্ৎসেগোভিনা, সার্বিয়া, নর্থ মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া, কসোভো এবং মন্টিনিগ্রো৷
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ভিড় বাড়ছে
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, সাধারণভাবে ইউরোপে আসা শরণার্থী ও অভিবাসীর সংখ্যাও বাড়ছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যাসাইলাম এজেন্সি (ইইউএএ)-এর সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে প্রথম ছয় মাসে নরওয়ে এবং সুইজারল্যান্ডসহ ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন৷
ইইউ কমিশনের মুখপাত্র আনিটা হিপার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসার জন্য অনিয়মিত উপায় ব্যবহার করা বেশিরভাগ মানুষই সিরিয়ান এবং আফগান নাগরিক৷
নানা পদক্ষেপ, ঝুঁকি থাকার পরেও তাদের বেশিরভাগই ভূমধ্যসাগরীয় এবং বলকান রুট ব্যবহার করে ইউরোপে আসছেন৷
অভিবাসনের ক্ষেত্রে এ দুটি পথই বিপজ্জনক হিসেবে পরিচিত৷ এই দুটি রুটেই অভিবাসীরা অমানবিক পরিস্থিতির মুখে পড়ে৷ সমুদ্র পথে প্রতি বছর শত শত মানুষ মারা যান অথবা নিখোঁজ হন, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিবাসন রুট হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷
জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম জানিয়েছে, চলতি বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে দুই হাজার ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন৷ আর যেসব মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি, সেগুরো বিবেচনায় নিলে সংখ্যাটি আরো বড় হতে পারে বলে মনে করছে আইওএম৷
লিবিয়া ও টিউনিশিয়ার সঙ্গে চুক্তিও আশা দেখাচ্ছে না ইইউকে
অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকাতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে ট্রানজিট দেশ হিসেবে পরিচিত লিবিয়া ও টিউনিশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ এর জন দেশ দুটিকে বিপুল অর্থ দিতে হচ্ছে ইইউকে৷ কিন্তু তাতে খুব একটা সুফল আসেনি৷ কারণ, অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঠেকাতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি হয় টিউনিশিয়া ও লিবিয়া৷
চুক্তির পরেও ইউরোপমুখী শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে৷ পরিসংখ্যান বলছে, অভিবাসীদের আগমন ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় এ বছর ২৮ শতাংশ বেড়েছে৷
কমিশনের মুখপাত্র হিপার জানিয়েছেন, সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগরীয় রুট এবং পশ্চিম বলকান রুটের মাধ্যমে অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে৷ পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রুটের জন্যও একটি পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷ তবে এ বিষয়ে বিশদ কিছু জানাননি তিনি৷