রিমঝিম বৃষ্টির ছন্দ বাজে। মাতাল হাওয়ায় মন উড়ে যায় ওই দুরে গগনে। এমনও দিনে মনটাকে বেধে রাখা যেনো অসম্ভব। তাইতো দুরের পথে হারিয়ে যেতে নেই মানা। এখনই সময় পানির সঙ্গে খেলা করার। প্রকৃতিতে বর্ষার মৌসুম চলছে। বর্ষা মৌসুমে ঘুরে আসতে পারেন কোনো একটি হাওড় থেকে। কারণ এ সময়ে হাওড় এলাকা স্বরূপে হাজির হয়।
অনেক দিন যান্ত্রিক শহরের কোলাহলে ব্যস্ত থেকে আপনি হাপিয়ে উঠেছেন নিশ্চয়! যদি তাই হয়; মনটাকে একটু প্রশান্তি দিতে ঘুরে আসুন ‘টাঙ্গুয়ার হাওড়’। অপরূপ নয়াভিরাম এক জলরাশি ‘টাঙ্গুয়ার হাওড়’। যেন রূপের রানী।
নীল আকাশের রাশি রাশি মেঘ বিশাল এই হাওরের জলে খেলা করে অবিরাম। দেখলে মনে হবে এ যেনো রাশি রাশি মেঘের পাহাড়। মেঘের দেশে অতিথির বেশে আজই বেড়িয়ে পড়ুন। চার দেয়ালে আটকে রাখা মনটি টাঙ্গুয়ার জলে শীতল হতে বাধ্য।
বর্ষা মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে বেড়াতে গেলে ভিন্ন ধরণের স্বাদ পাবেন। শীতের দিনের তুলনায় বর্ষা মৌসুমে টাঙ্গুয়া সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে হাজির হয় প্রকৃতির মাঝে। এ যেনো এক ভিন্ন জগৎ!
টাঙ্গুয়া হাওড়ে যেতে ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে গেলে বিশেষ কোন সুবিধা পাবেন না। তার চেয়ে বরং বাসে করে সোজা চলে যাবেন ভাটির দেশ সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ পৌঁছানর পরে শহরের ঘাট থেকে একটা ইঞ্জিন বোট ভাড়া করতে হবে। সুনামগঞ্জের হাছন রাজা ঘাট থেকে ট্রলারে করে তাহিরপুর ঘাটে যেতে সময় লাগবে ৬ ঘন্টা। ভাড়া প্রতিদিনের জন্য কম-বেশী ৩ হাজার টাকা। ভাল দেখে নৌকা নিবেন। আশ-পাশের দৃশ্য দেখতে হলে ছই-এর উপর সারাদিন কাটাতে হবে। ছই-এর উপরটা টিন সীট দিয়ে মোড়ানো, সাইডে বসবার ব্যবস্থা আছে এমন নৌকা খুজে বের করবেন।
দিনের বেলা টাঙ্গুয়ার এক রূপ, আর রাতে আরেক। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের প্রকৃত মজা নিতে হলে এই নৌকাতেই রাত্রি যাপন করতে হবে। সঙ্গে কয়েক জন থাকলে ভালো। সবাই মিলে হাওড়ের জলে রাত্রি যাপন করার মজাই আলাদ। তবে চাঁদনী রাতের দিন আরো মনোরম হয়ে ওঠে হাওড় এলাকা। এ যেনো রূপালী চাঁদের দেশ। চাঁদনী পসর রাইতে প্রিয়জনকে নিয়ে হাওড়ের মাঝে মাছের খেলা দেখতে দেখতে হারিয়ে যাবেন ভিন্ন জগতে।
হাওড়ের জল, নৌকা, মেঘ আর চাঁদের রূপালী আলো যখন খেলা শুরু করবে ঠিক তখন মাতাল হাওয়া এসে আচড়ে পড়বে আপনার শরীরে। সবার সংমিশ্রণে এই একটি স্থানেই আপনি চমৎকার খেলা উপভোগ করতে পারবেন। ভাগ্যে থাকলে এর সাথে যদি যোগ হয় বৃষ্টি তবে তো আর কথাই নেই। আপনি পৃথিবীর মাঝে সব থেকে স্মরণীয় একটি দিন পেয়ে গেলেন।
সুনামগঞ্জ থেকে সকাল সকাল নৌকা ছাড়া ভাল। সুরমা নদী দিয়ে যাত্রা শুরু হবে। তারপর এই নদী সেই নদী, এই খাল সেই খাল পাড়ি দিয়ে আপনাদের নৌকা চলবে টাঙ্গুয়ার হাওড় অভিমুখে। পথে বিশ্বম্বরপুর এবং তাহিরপুর উপজেলা সদর পরবে। তাহিরপুর উপজেলা সদরে রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেবেন। তাহিরপুরে রাত্রি যাপন করলে টাঙ্গুয়ার হাওড় দেখে সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসতে হবে তাহিরপুরে।
তাহিরপুরে এক কাপ চা খেয়ে সোজা চলে যান টাঙ্গুয়ার হাওড়। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে একটা সরকারী রেস্ট হাউজ আছে। তবে এটি কোন রেস্ট হাউজই নয়। কনক্রিটের পিলারের উপর টিনের ঘর। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের মাছ পাহারা দেবার জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসাররা থাকে ওখানে। তাই এ রেস্ট হাউজের চিন্তায় থাকলে ভুল করবেন।
উত্তর দিকে মেঘালয় রাজ্যের খাড়া পাহাড় আর তিন দিকে থৈ থৈ পানি। মাঠ-ঘাট সহ চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। ভাটির দেশের প্রকৃত রূপ এটি। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা আর কিশোরগঞ্জ এই তিন জেলা জুড়ে বিস্তৃত সেই অদ্ভূত জলরাশি। এই জলরাশির ভিতরেই মেঘালয়ের পাদদেশে টাঙ্গুয়ার হাওড়। বর্ষায় আলাদা করে টাঙ্গুয়ার হাওড় বলে কিছু থাকেনা। সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
টাঙ্গুয়ার হাওড়ে পৌঁছালেই দেখবেন গভীর কালচে পানি। অনকে দূর পর্যন্ত কোন গাছ-গাছালীর উপরাংশ পানির উপরে দেখা যাচ্ছেনা। তখনই বুঝবেন আপনি যথাস্থানে পৌঁছে গেছেন।
হাওড়ের সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্রাম ‘বাগলী’। খাতা কলমে নাম ‘বীরেন্দ্রনগর’। ওখানে বিডিআর-এর একটা বিওপি রয়েছে। ছোট্ট একটা বাজার রয়েছে। বিদ্যুৎও আছে। বাগলী বিডিআর ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এখানেই রাত্রী যাপন করা নিরাপদ। নিরাপত্তা সমস্যা নেই, তারপরও আপনি নিশ্চিত হতে এ সুযোগ নিতে পারেন।
বাগলী বাজারে চা-এর দোকান থাকলেও ভাতের হোটেল নেই। বাজার থেকে ঝুড়ি ধরে হরেক রকমের মিশানো তাজা ছোট মাছ কিনে নিবেন। নৌকার মাঝিরা সাধারণত চমৎকার রান্না করেন। লাল ঝুটিওয়ালা দেশী মোরগও মিলবে প্রচুর। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে আসবেন আর মাছের স্বাদ নিবেন না এটা কি হয়! এখানে বড় মাছও আছে, কিন্তু বর্ষায় প্রজনন মৌসুমে এই মাছ মারা নিষেধ। তবে স্থানীয় সুগন্ধি ‘বাঁশমতি’ চালের ভাত খেতে ভুলবেন না কিন্তু।
এখানে দিনের বেলা পাখিদের মেলাও উপভোগ করতে পারবেন। বর্ষায় দেশী পাখি, যেমন : বক, পানকৌড়ী আর মাছরাঙা আপনাকে মাঝে মাঝে অভিনন্দন জানাবে। হাওড়ের মাঝে গাছের মধ্যে পাবেন তাল গাছ।
ফেরার পথে আবার সুনামগঞ্জ হয়ে না-ই বা ফিরলেন। টাঙ্গুয়ার হাওড় থেকে নৌকা যোগে চলে যাবেন নেত্রকোনার কলমাকান্দা বা মোহনগঞ্জ। নতুন একটা রুট ঘুরে আসা হবে। সেখান থেকে লোকাল বাসে নেত্রকানা, নেত্রকানা থেকে ডাইরেক্ট বাসে সোজা ঢাকা। সময়ও লাগবে কম। কলমাকান্দা থেকে নেত্রকানা যেতে সময় লাগবে মাত্র ২ ঘন্টা। সুনামগঞ্জ থেকে নৌকা ভাড়া করবার সময় মাঝিকে এই রুটে ফেরার বিষয়টি আগেই জানিয়ে রাখবেন।
আর্মি বা বিডিআর-এর কোন রেফারেন্স থাকলে বাগলী (বীরেন্দ্রনগর) বিডিআর বিওপি-তে আতিথেয়তা পেয়ে যেতে পারেন। তাহলে আর কোন চিন্তা থাকবে না। থাকার বিছানা-পত্র আর রান্নার ঝামেলা মিটে যাবে। তবে আপনাকে থাকতে হবে আপনাদের নৌকাতেই। টাঙ্গুয়ার হাওড় ও আশে পাশে গ্রামীণ ফোনের ভাল নেটওয়ার্ক পাবেন। অনেক দূরে গেলেও কাছের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ভয় নেই। শুধু বাগলী বাজারে চা খেতে খেতে মোবাইলটা চার্জ করে নিলেই হবে। যাবার সময় সুনামগঞ্জ থেকে প্রয়োজনীয় টুকি-টাকি কিনে নেবেন।