করোনায় অচলাবস্থার মধ্যে সারাদেশের মানুষ অর্থনীতির কি হবে ভেবে অস্থির। এমন দুর্দিনে আমার বন্ধুটির কথা মনে এল। তবে আর ফোন করে খোঁজখবর করা হয়ে ওঠেনি।
অনেক দিন পর আমার গাঁয়ের মানুষগুলোর মধ্যেও পরিবর্তন এসছে। আমার মনে হয় আমিও নিজেকে চিনতে পারলাম না। আমি মানুষটা আমার কাছেই অপরিচিতই রয়ে গেলাম। আমি চাই আমার গাঁয়ের প্রতিটি ছেলে মেয়ে স্বাবলম্বী হোক।
আরেকবার আমার দাদার কথায় ফিরে আসি। উনি খুব রাগী মানুষ ছিলেন। তাঁর ধারেকাছে খুব কম মানুষই যেত। তিনি কোনও অন্যায়কে পশ্রয় দিতেন না। আমার দাদার সাথে সম্পর্কটা ছিল অনেকটা শাসন ও বন্ধুর মতো। স্কুল বন্ধ থাকলেই দাদা-নাতির গাঁয়ের মধ্যে কাঁচা রাস্তা কিংবা ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের জায়গা জমি ঘুরে দেখা।
আমাদের জায়গাগুলো গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে ছিলো। তাই জায়গাগুলো দেখতে দেখতে আমার আর দাদার পুরো গ্রাম দেখা হয়ে যেত। গাঁয়ের পথে ঘুরতে ঘুরতে যখনই কারো শস্যক্ষেতে বা ফসলি ক্ষেতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ফসল নষ্ট করত, তখন হয় আমাকে এসব পশুপাখিগুলো তাড়াতে হতো অথবা তাদের মালিককে ডেকে এনে বলতে হতো।
একদিন দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম- দাদা, পশুপাখিরা অন্যের জমির ফসল নষ্ট করলেও তুমি নিজেদের জমিজমা দেখতে বেরিয়ে সবার জমির তদারকি করো। আবার কারো ক্ষেতে পানি না থাকলে বাড়িতে গিয়ে ক্ষেতে পানি দিতে বলে আসে।
দাদা বললেন- সবাই ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকব। এক একটি ফসল বছর ঘুরে একবারই ফলে। সেই ফসল সংগ্রহ বা সংরক্ষণ দেখভাল করা সবারই দায়িত্ব।
দাদা বললেন- ফসল যার ক্ষেতেই হোক তাতে সবার হক আছে। একটি লাউ যদি কারও হয় তবে সে নিজে খাবে। এরকম সবাই যদি কিছু কিছু সবজি ফলায় তাহলে বাজারে কখনো সবজির দাম বাড়বে না। ঠিক তেমনি ফসলি জমিতে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসল হয় আর সবাই মিলে রক্ষনাবেক্ষন করি তবে বাজারে ধান চাল গম আটার দাম বাড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
দাদা বলেন, এসব ফলে পশুপাখি তার খাবার পাবে। গরু ছাগল পাবে খড় কুড়া হাঁস মুরগী পাবে খুদ জাউ। অন্য পশুপাখি সেসবের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকবে। কিন্তু ফসল ফলার আগেই যদি ফসল নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আমরাই খাব কি আর পশুপাখিগুলোই খাবে কি?
আজ এই করোনার সংকটের মধ্যে এই বিষয়গুলো ভাবিত করে। এখন আমি বুঝি কারো গাছে যদি একটি ফসল ফললে তার আঠারো কোটি ভাগের এক ভাগ আমার ভাগ্যে আছে। এভাবে চিন্তা করলে আমরা নিজেদের যেমন রক্ষা করতে পারব ঠিক তেমেই আমাদের অর্থনীতিও মনে হয় সামনে এগিয়ে যাবে।
অর্থনীতির যতটুকু বুঝতে পারি তাতে মনে হয়, এদেশের উৎপাদিত প্রতিটি শস্যকণা অর্থনীতির সঙ্গে ভীষণভাবে জরিত। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা সর্বক্ষেত্রে নিজেরা স্বাবলম্বী হলে আমাদের অর্থনীতির চাকাও এমনিতেই সচল হবে।
গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেতে গিয়ে দেখি অনেক অনাবাদী জমি পড়ে আছে। এসব দেখে খুব করে দাদার কথাগুলো মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়া চীন’ পড়ে জানতে পেরেছি- চীনারা তাদের দেশের প্রতিটি কণাকে কাজে লাগিয়ে কতো দ্রুত তাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে পৃথিবীর একটি সফলতম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমাদের দেশে হাজার হাজার একর ভূমি আজও অনাবাদী থাকে। যাদের জমিজমা অনাবাদী থাকে সেসব জমি যাঁরা আবাদ করে তাদের বুঝিয়ে দেয়া হোক। এদেশে এখনো বহু মানুষ নিজের কোনও ভূমি না থাকায় অন্যের জমিতে ফসল ফলায়। তাতে ভূস্বামীই বেশি পায় আর যৎসামান্য যা পায় তা দিয়ে চাষকারীর জীবন চলে না।
আমি অর্থনীতি বুঝতে চাই না আমি চাই অভাগা মানুষগুলো তাদের খাবারের অন্ন পাক। আমি লতাপাতার সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমি লাউয়ের কচি পাতার কথা বলতে চাই। পুঁইশাকের আঁটি বাঁধা বোঝা মাথায় নিয়ে বাজারে পথে কৃষকদের ছুটে চলা দেখতে চাই। আমি মনের আনন্দে রাখাল বালকের গরু ছাগল মোষের পাল নিয়ে বাড়ির পথে ফিরে চলার দৃশ্য দেখতে চাই। লতায়পাতায় ছড়ানো ছিটানো এক সবুজ প্রান্তরে ঘাসের ওপর বসে কূলবধুদের হাসিঠাট্টা ও আনন্দ উপভোগ করার দৃশ্য দেখতে চাই। আমি রাস্তার দু’ধারে ফলফলাদির গাছ দেখতে চাই।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমরা আমাদের জায়গা থেকে ভূমিকা পালন করতে চাই। আমাদের প্রতিটি শস্য উদ্যান ফসলের চাষাবাদ এবং আমাদের সারাজীবন ধরে আলতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে চাই। আমরা বড় বড় কথার ফুলঝুরি নিয়ে হাজির হওয়া ব্যক্তির বক্তব্য শুনতে চাই না। সোনার বাংলা যেন সবুজ শ্যামল লতাপাতার ফল-ফসলাদির রূপসী বাংলা হয়। আমি সেই রূপসী বাংলার রূপ দেখতে দেখতে জীবনের বাকিটা পথ চলতে চাই।