বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পূর্বাহ্ন

রূপকথার শহর প্রাগের স্মৃতি

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

প্রাগকে ডাকা হয়, ‘আ সিটি অব হান্ড্রেড স্পায়ার্স’ নামে। ইউরোপের অন্যতম সুন্দর শহর এটি। রূপকথার শহর নামেও পরিচিত। কী এক নিগূঢ় ঐন্দ্রজালিক মায়ায় আচ্ছন্ন এক শহর। ভাল্টাভা নদীর তীরে অবস্থিত প্রাগ হলো চেক রিপাবলিকের রাজধানী। এই অঞ্চলটি মূলত বোহেমিয়া রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বোহেমিয়া বলতে প্রাচীন ঐতিহাসিক চেক অঞ্চলভুক্ত রাজ্যগুলোকে বোঝানো হতো। যেখানে বোহেমিয়ান রাজা-বাদশা বিশেষ করে হোলি রোমান সম্রাটদের বসবাস ছিল।

১৯ শতকের দিকে বেরনারদো বোলযানো নামে এক ব্যক্তি ১০৩টির মতো প্যাঁচানো উঁচু অট্টালিকা ও গম্বুজ আকৃতির ক্যাথেড্রাল গণনা করে পান, যার থেকেই এর নামকরণ হয়েছে, আ সিটি অব হান্ড্রেড স্পায়ার্স।

এই শহরটা কোনো এক কারণে অদ্ভুতভাবে টানত আমাকে। তাই এক কাক ডাকা ভোরে হাজির হয়েছিলাম প্রাগে। টানা ১০ দিনের ইউরোপ ট্যুরের শেষ চমক ছিল প্রাগ।

jagonews24

শহরটি নিয়ে আমার প্রথম চেনাজানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অথবা দ্বিতীয় বর্ষে, ‘রকস্টার’ সিনেমার মাধ্যমে। মুভিটা বেশ কয়েকবার দেখা হলেও কখনোই ভাবিনি এই শহরের পথে পথে আমি হাঁটব, ঘুরে বেড়াব, গান শুনব। তাই এডিনবার্গে পড়তে গিয়ে প্রাগ ঘুরতে যাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। বাকেট লিস্টের শুরুতেই এই নামটা ছিল।

আধার কেঁটে মিটিমিটি আলো ফুটছে কেবল। টানা আট দিন ধরে নির্ঘুম-ভবঘুরে আমি প্রচণ্ড ক্লান্ত আর চোখে একরাশ ঘুম। কারেন্সি এক্সচেঞ্জ করে, গুগল ম্যাপ ঘেঁটে বাসে চড়ে মেট্রো লেনে যাই, তারপর সেখান থেকে সিটি সেন্টারে। যখন হোটেলে পৌঁছলাম, কেবল ভোর হচ্ছে। চেক ইন হতে তখন অনেক বেলা বাকি। লাগেজ জমা দিয়ে মাথায় ঘুরঘুর করছে, কীভাবে ঘুমানো যায়। না হলে তো বাকি দিনটা হাই তুলতে তুলতেই যাবে। ঘুম কাটানোর বিকল্প হিসেবে স্টারবাকসে ঢুকলাম। ভাবলাম কড়া দুই কাপ কফি খাই, আর সাথে প্রাগের ভোর হওয়া দেখি।

jagonews24

কিন্তু আদতে স্টারবাকসে গিয়ে আসলে টানা দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। ব্যাপারটা যতটাই হাস্যকর মনে হোক না কেন, ট্যুরিস্টদের এমন আচরণে ওরা কিন্তু বেশ অভ্যস্ত। কারণ আমার মতোই আরেকদল ট্যুরিস্ট বাক্স-পেটরা নিয়ে একইভাবে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিছু বুড়ো মানুষ কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে কফিতে মনোযোগ দিল।

এখন প্রাগ জার্নি শুরু করা যাক। শহরটিতে থাকার মেয়াদ ছিল কেবল দেড় দিন। পরেরদিন বিকেলেই এডিনবার্গের ফ্লাইট। মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছুটি। এত এত সুন্দর লোকেশন, আর সময় এত কম! প্রাগ ১ থেকেই যাত্রা শুরু করে ছিলাম, হোটেলটাও সেখানেই ছিল। প্রাগ ১ এর প্রত্যেকটা অলিগলি দেখার মতো, প্রাচীন ক্যাথেড্রাল, এনটিক গোথিক চার্চ, বারোক (মঞ্চের মতো সাজানো) আরকিটেকচার বিল্ডিং, পাথর বাঁধানো রাস্তা আর ইতিহাস তো আছেই।

jagonews24

প্রথমে চলে যাই চার্লস ব্রিজের কাছে, যা মূলত রাজা চার্লস (৪) এর নামকরণে তৈরি। সেতুটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের একটি অংশ যা মেডাইভাল পাথরের তৈরি ছিল। এই সেতুর মূল আকর্ষণ ছিল একটার পর আরেকটা করে ৩০ জন ক্যাথলিক সেইন্টের ভাস্কর্যের সজ্জা। প্রথম দেখাতেই এটি আপনাকে নিয়ে যাবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে।

আর এই পুরো যাত্রাপথে ভালোলাগা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায় ওদের স্ট্রিট পারফরমেন্সগুলো দেখলে, আঞ্চলিক গান এবং নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রে সুর তোলে স্থানীয়রা।

jagonews24

প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটা এবং ২৮০টি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর প্রাগ ক্যাসেলে পৌঁছাই। এতটা পরিশ্রম করে উঁচুতে ওঠাটা বৃথা যায়নি। ওদের সব বাড়িগুলো একই প্যাটার্নের, মাথাটা ত্রিভুজ আকৃতির এবং ইট বর্ণের। প্রাগ ক্যাসেল থেকে দেখা শহরের প্যানারমিক ভিউ এক জীবনে ভোলার মতো না। কুয়াশাচ্ছন্ন বিন্দু বিন্দু বাড়িগুলো যেন রোদে ঝিলমিল করছিল, আর সঙ্গে ভ্লাটভা নদীর চমৎকার একটি দৃশ্য। সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল ওখানে বসে পুরো একটা দিন পার করে দেয়া যাবে।

ভোর থেকে শুরু করে রাত অব্দি এই শহরের একেক রূপ দেখার জন্য এর থেকে ভালো লোকেশন আর কী হতে পারে! যখন হাজার বছরের রাত নামে এখানে, একটি-দুটি করে হাজারো মিটিমিটি জোনাকী পোকার মতো বাতি জ্বলতে থাকে পুরো শহরটায়, দূর থেকে কোনো এক অজানা সুর ভেসে আসে, আর সাদা কুয়াশায় মোড়া চার্লস ব্রিজটি এক অপার্থিব অনুভূতির হাতছানি দেয়। এই অনুভূতি পেতে বার বার ফিরে যেতে মন চাইবে প্রাগে।

jagonews24

প্রাগ ক্যাসেলকে ‘ক্যাসেল অব কমপ্লেক্স’-ও বলা হয়। এটির নির্মাণকাল ৯ম শতাব্দী। গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড থেকে জানা যায়, এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাচীন ক্যাসেলগুলোর মধ্যে একটি। যা প্রায় ৭০ হাজার বর্গমিটারজুড়ে অবস্থিত। এটি মূলত বোহেমিয়ান রাজা থেকে শুরু করে বর্তমানে চেক রিপাবলিকের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও একটি গোপন কক্ষে বোহেমিয়ান সময়ের অনেক স্মারক ও মুদ্রা সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।

হয়ত ৩-৪ দিনেই পুরো শহরটা দেখা হয়ে যাবে, কিন্তু রেশটা রয়ে যাবে অনেকটা সময়। এই শহরে আরও একবার যাওয়ার জন্য আরও অনেকগুলো দিন বেঁচে থাকা যায়। ভ্রমণ আসলে মনে শান্তি এনে দেয়, জীবনকে অবশ্যই নতুনভাবে দেখতে ও ভাবতে শেখায়।

ফারজানা আফরোজ

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com