স্বর্গীয় সৌন্দর্যের লীলাভূমি মালদ্বীপ প্রজাতন্ত্র ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার এবং গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার, এক জল ডুবুডুবু নীল দেশের নাম মালদ্বীপ।
পৃথিবীর মধ্যে মালদ্বীপের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। এখানকার সমুদ্রের পানি পরিস্কার ও নীল এবং বালির রঙ সাদা। সমুদ্রের মধ্যে হাজার ধরনের মাছ ও সামুদ্রিক প্রানী দেখা যায়। যদিও সত্তরের দশকের আগে পর্যটনের জন্য একেবারেই পরিচিত ছিল না এদেশ। পরবর্তীতে পর্যটন শিল্পের পরিকল্পিত উন্নতির ফলে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
সার্কভুক্ত দক্ষিণ এশীয় এদেশ পর্যটকদের কাছে ভীষণ প্রিয়। আর দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ার কারণে পশ্চিমা পর্যটকদের কাছে মালদ্বীপ খুবই জনপ্রিয় পর্যটনস্থল।পশ্চিমা নবদম্পতিরা মালদ্বীপ ভ্রমণ খুবই উপভোগ করেন৷ বর্তমানে নতুন সংস্কারের কারণে কম খরচে ভ্রমণের সুযোগ সুবিধা বাড়ায় এবং অতুলনীয় স্বর্গীয় সৌন্দর্যের জন্য সবার কাছেই মালদ্বীপ এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
ছোট-বড় সবমিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার দ্বীপ নিয়ে গঠিত নীলচে পানির এই দেশ। সবগুলো দ্বীপই অপার সৌন্দর্য বহন করে সমুদ্রের বুকে স্থান করে নিয়েছে। এর মধ্যে মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে প্রায় দু’শোর মতো দ্বীপে। আর প্রতিটি দ্বীপই যেন স্বপ্নের রঙ মাখিয়ে সাজানো।
গোটা পৃথিবীর পর্যটকদের বিলাস যাপনের অন্যতম লক্ষ্য এই দেশ। বিশেষ করে কপোত-কপোতীদের জন্য ঘন নীল আর শ্যাওলা সবুজ ঢেউ খেলানো ভারত মহাসাগরের বুকে দোল খাওয়া এই অনিন্দ্য সুন্দর ভূখণ্ডের কোনও তুলনাই নেই। মালদ্বীপের হাজারও দ্বীপের মধ্যে বারোস অন্যতম সুন্দর একটি দ্বীপ। পর্যটকদের সমুদ্রবিলাসের জন্য ও নিরালায় সময় কাটানোর সমস্ত আয়োজন রয়েছে এখানে।
মালদ্বীপ প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত বিলাসবহুল রিসোর্ট বারোস আইল্যান্ড। এখানে রয়েছে সমুদ্রের পানির ওপর বিশেষভাবে নির্মিত বাড়ি। এসব বাড়িতে থাকার কারনে পর্যটকরা সমুদ্রের বিভিন্ন রঙের মাছ ও প্রাণী খুব কাছ থেকে দেখতে পারেন, শুনতে পারেন সামুদ্রিক পাখির ডাক। সমুদ্রের স্বচ্ছ পানির ভেতরে কোরাল রিফ, উত্তাল সাগরের ঢেউ, কচ্ছপ ও নানা ধরনের রঙ্গিন মাছ সব এক ভিন্ন ধরনের আনন্দ দেয় পর্যটকদের মনে। অথবা সমুদ্র সৈকতে থাকতে চাইলে আছে বিশেষভাবে নির্মিত বাড়ি।
সৈকত থেকে ১০ মিটার দূরে অবস্থিত বিশেষভাবে নির্মিত বাড়িগুলো কাঠের সেতু দিয়ে সেগুলোকে সৈকতের সঙ্গে সংযুক্ত করা থাকে। কিছু কিছু বাড়িতে কাঠের সংযুক্ত সেতু থাকে না, সেক্ষেত্রে পর্যটকরা ছোট নৌকায় করে সমুদ্রের বুকে নির্মিত বাড়িতে আসা-যাওয়া করেন। এখানকার পানির উপরে বিচ, চালাদেওয়া বাগানবাড়ি ও ব্যক্তিগত পুলগুলো খুব নান্দনিকতায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
বারোস আইল্যান্ড নামের একতলা বিচ বাংলো দিয়ে ছিমছাম সাজানো দ্বীপটিতে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, সুইমিংপুল, ফুটবল মাঠ, কিংবা সুভ্যেনির শপ, যেখান সামুদ্রিক কাঁচামাল দিয়ে বানানো সুভ্যেনির সংগ্রহ করে নিতে পারেন পর্যটকেরা। এছাড়া অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের জন্য আছে সমুদ্রের পান্নার মতো সবুজ পানিতে স্নোরকেলিং কিংবা ডাইভিং-এর সুযোগ। বারোস আইল্যান্ডে স্নোরকেলিং করার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় এমন পর্যটকের দেখা মিলা ভার।
স্বচ্ছ পরিষ্কার পানির গভীরে সামুদ্রিক প্রাণীকুলের জীবন, কোরাল, মাছেদের চলাফেরা ও সৌন্দর্য দেখার জন্য স্নোরকেলিং ভালোবাসেন সৌন্দর্যপ্রেমীরা। বারোস দ্বীপে এমনকি যাদের পানিভীতি আছে তাদের জন্যেও প্রাথমিক ডাইভ কোর্সের ব্যবস্থা আছে। আগে থেকেই ডাইভিং জানেন এমন পর্যটকেরা সুযোগ পান আইল্যান্ডের লেগুনে ডাইভ করার অভিজ্ঞতা অর্জনের।
ছোট এই দ্বীপটিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা; ওয়াটার স্কাইং, ওয়াটার বোর্ডিং, উইন্ড সার্ফিং এবং ক্যানোইং। এর যেকোনো সুযোগই লুফে নেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকেরা। পর্যটকদের সময় কাটানোর জন্য সাথে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পছন্দের তালিকায় থাকে অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ রাইডগুলো। আবার ইচ্ছে হলে দ্বীপ থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের পাশের সাইট হাউজে গিয়ে কোরাল রিফ দেখে আসতে পারেন। যান্ত্রিক আর কর্মব্যস্ত শহুরে জীবনের তিক্ততা থেকে একটু সময়ের জন্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে একটু শান্ত ও নিরিবিলি সময় কাটাতে পর্যটকরা ভিড় জমায় এই আইল্যান্ডে।
একেবারে ছোট্ট একটি দ্বীপ বারোস, কিন্তু আয়োজনের যেন কমতি নেই। প্রকৃতি তো উদার হাতে আপন মনে শত রঙে সাজিয়ে দিয়েছে আর সেই রঙিন সময়কে উপভোগ করার জন্য রয়েছে অসাধারণ কিছু ব্যবস্থা। প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার আধ্যাত্মিক ধ্যানের এক অসাধারণ মেলবন্ধন নিয়ে রয়েছে এখানকার স্পা ও মেডিটেশন সেন্টারগুলো। তাই প্রকৃতিপ্রেমীরা সেখানে গেলে রিল্যাক্স্যাশনের এই সুযোগ লুফে নেন। উপভোগ করেন নিজেদের আর মরমে মিশিয়ে নেন প্রকৃতিকে।
বারোস আইল্যান্ডের কাছাকাছি রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি দ্বীপ। হাতে সময় নিয়ে গেলে ঘুরে আসা যায় সেখান থেকেও। সামুদ্রিক বেলভূমি পেছনে রেখে, সকালের চিকচিকে রোদে পিঠ পেতে ঝিলমিলে বালুকনায় পা মেখে ছোট বিচ বাংলোর সামনে পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চে বসে সামুদ্রিক খাবার খাওয়া। কিংবা ছোট বাগানওয়ালা রেস্তোরাঁয় বসে দুপুরের খাবার সেরে পাশের সবুজ ঘাসের বাগানে শুয়ে বসে বিকালের ক্লান্তি দূর করা ঢুলু ঢুলু চোখে অনেকটা আমাদের ‘ভাতঘুম’এর আমেজ আর সাথে সামুদ্রিক নোনা বাতাস। ঠিক ওই সময়টায় হয়তো মাথার উপরে প্রাচীন কোনও গাছ থেকে উড়ে আসা বুনো সামুদ্রিক পাখির উড়ে যাওয়া দেখে তার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করা।
আবার সন্ধ্যে সন্ধ্যে সময়টাতে অপরিচিত ছোট ছোট পোকাদের মোহময় কলরবের সাথে যখন পানির রঙ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় তখন বিষণ্ণ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে বালুকাবেলায় খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া, রাতের বেলায় বিষাক্ত অন্ধকারের মতো কালো পানির সাথে তীরে এসে আঁছড়ে পড়া মাছের খেলা দেখা। কিংবা রাত আরেকটু ভারী হলে নিজেকে অন্ধকারে মিশিয়ে দিয়ে একাকার হয়ে যাওয়া। খানিকটা যেন এমন; নিজেও যে প্রকৃতির একটা অংশ সেটা অনুভব করতেই যেন যেতে হয় বারোস আইল্যান্ডে।
রাজধানীর মালের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে খুব বেশি দূরে নয় এই স্বর্গীয় দ্বীপ। মিনিট ২৫-এর যাত্রা মালে থেকে বারোস।বারোস আইল্যান্ড-এ যেতে হলে প্রথমেই ঢাকা থেকে বিমানে মালদ্বীপ যেতে হবে। নীল পানির বুকেই যখন নামতে থাকে বিমান তখন খানিকটা ভয় শঙ্কা কাজ করে হয়তো; এই বুঝি নীল পানিতেই তলিয়ে যাবে বিমান!
আবার খানিকটা হাতড়ে খুঁজে পাওয়ার মতো করে ছোট একখন্ড ভূমির দেখা মিলে তখন হয়তো স্বস্তি মেলে। মালদ্বীপ যেন রূপকথার গল্পের সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হওয়া অজানা কোনও ভূমি। বিমান অবতরণেরে পরে বিমানবন্দরের কাছ থেকে স্পিড বোট বা ফেরিতে করে যেতে হয় বারোসে।
অন্যসব পর্যটনস্থলের মতো পিক সিজন-এ ঘুরতে গেলে খরচ ও ভিড় দুটোই বেশি হয়, কমন ভ্যাকেশন এড়িয়ে গেলে অথিতিপরায়ন মালদ্বীপে খাতির ও সমাদরের ঘাটতি পড়ে না। তবে মালদ্বীপের সবকিছুতে ২৫ শতাংশের মতো ট্যাক্স রেট থাকে যে কারনে মালদ্বীপ ভ্রমণ মোটামুটি ব্যায়বহুল।
তবে ছোট্ট দ্বীপ বারোসের রিসোর্টগুলোতে থাকা খাওয়ার সাথে সাইট সিয়িং-এর প্যাকেজ থাকে। আগে থেকে একটু জেনেশুনে নিলে খাবার খরচ এবং অন্যান্য খরচ খানিকটা বাগে আনা যায়। বারোস আইল্যান্ডে রাত যাপন মোটামুটি ব্যায়বহুল। বেশিরভাগ প্রাইভেট আইল্যান্ডের খরচ মেইন সিটির চেয়ে বেশি। তবে নিজেদের মতো করে প্যাকেজ বাছাই করে প্ল্যান করলে সুন্দর একটা সময় কাটিয়ে আসা যায়।
কোরাল রিজেনারশন প্রজেক্ট চলার কারনে বারোস দ্বীপে তাই কোরাল প্রজাতির যেন কোন ধরনের ক্ষতি না হয় সেই ব্যাপারে একটু সতর্কতা মেনে চলা হয়। এবং চাইলে কোরাল রিজেনারেশন ও সংরক্ষনের প্রোগ্রামে পর্যটকরা কোরাল রিফের সংরক্ষনার্থে ডোনেশন করতে পারেন এবং মেরিন সেন্টার কোরাল প্ল্যান্টিং প্রজেক্টের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। ম্যারিন সেন্টারে সামুদ্রিক প্রানীদের সম্পর্কে জানারও সুযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে অসাধারণ এক দ্বীপ বারোস।
আসুন ভ্রমণে গিয়ে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলে প্রকৃতি রক্ষায় কাজ করি। নিজেও ভাল থাকি, প্রকৃতিকেও ভাল রাখি।
হালিমা খাতুন জাইম