বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৭ অপরাহ্ন

রাতের আলোয় চোখ ধাঁধানো দুবাই এয়ারপোর্ট

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৩ মে, ২০২৩

দূর পশ্চিমের দিকে যাত্রা করলেই মধ্যপ্রাচ্য সামনে পড়ে। আরব রাষ্ট্রসমূহের সেই ট্রানজিট শহরগুলোর নাম ওমান, বাহরাইন, দোহার, কুয়েত, আবুধাবি, জেদ্দা কিংবা দুবাই। ইতিপূর্বে ওমান, বাহরাইন, দোহার, কুয়েত, আবুধাবি হয়ে যাতায়াত করেছি। এবার মধ্য বিরতি করলাম দুবাই। বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো এক নাটকে এরকম একটি সংলাপ ছিল- ট্যাকা দেন, দুবাই যাবো। সম্ভবত কাজ পেতে বা জীবন-সংগ্রামের প্রবল বাসনায় দুবাই যাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা। তারপর এই দুবাই নানা প্রসঙ্গে এখন বাঙালিদের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হয়ে উঠেছে, যা আমার সঙ্গে অনেকেই স্বীকার করবেন।

দুবাইসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিক যাচ্ছে কাজ করতে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে, ক্রিকেটাররা ক্রিকেট খেলতে কিংবা রাষ্ট্রীয় কাজে সরকারি কর্মকর্তারা। শোনা যায়, কিছু সন্ত্রাসী পালিয়ে এসে এখানে (রাজার হালে!) আছে। তারা নাকি এখান থেকে বাংলাদেশে অপকর্ম চালায়। এদের দু’একজন আবার দেশের শীর্ষ স্থানীয় সন্ত্রাসী। এরা এখানে আসার আগে নাম পরিবর্তন করে আসে। পাসপোর্ট পরিবর্তন করে অথবা পাসপোর্টে নতুন নাম রাখে। যেমন ধরুন, রাঙ্গা রাগীব, নাম পরিবর্তন করে রাখল ডন সিরাজ- এরকম আর কি?

যাক দুবাইয়ে এসে তারা যদি ভালো থাকে থাকুক, তবে দেশ অশান্ত করতে তারা কিছু না করলেই হয়। এছাড়া আসে ব্যবসায়ীরা, সংযুক্ত আরব আমিরাত নামক দেশটির রাজধানী দুবাইয়ে বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী নানা ধরনের ব্যবসা করছেন। কেউ কেউ নাকি জমি বা বাড়ি কিনে বসবাসও করছেন। অর্থাৎ মালয়েশিয়ার মতো সেকেন্ড হোম, বাহ!বেশ। রাষ্টীয় কাজে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন, তারা তো আছেনই, কিন্তু অসংখ্য শ্রমিকসহ বাংলাদেশিরা এখানে বাস করে, ভাবতে ভালোই লাগে। আরো ভালো লাগে যখন দুবাইয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল খেলতে আসে তখন গ্যালারিজুড়ে লাল-সবুজের পতাকা হাতে টাইগারদের সমর্থনে বাঙালি দর্শকরা উচ্চারণ করে- সাকিব, তামিম, মুশফিক কিংবা মাশরাফির নাম।

দুবাই এখন অনেক উন্নত, বিশাল বিমান বন্দর তাদের। বিশ্বের সেরাদের একটি তাদের এমিরেটস এয়ারলাইন্স। উন্নত সার্ভিসের জন্য যাত্রীদের খুবই পছন্দ। আমি এমিরেটসে এই প্রথম যাত্রী হলাম। বহু দিন মনে মনে ক্ষীণ বাসনা ছিল। ভালো সেবা নিয়ে ঢাকা থেকে দুবাই এলাম। উপর থেকে নামতে নামতে দেখলাম অপূর্ব সব দৃশ্য! দেখলাম প্রতি মিনিটে প্রায় তিনটি করে ছয়টি বিমান ওঠা-নামা করতে। দেখলাম আলোকসজ্জিত বিশাল সুন্দর বিমান-বন্দর! এখানে ট্রানজিট পাঁচ ঘণ্টা। ট্রানজিট টাইম সব সময়ই আমার কাছে বিরক্তিকর। চেয়ারে বসে বসে ঘুমানো অথবা ডিউটি ফ্রি মালামাল দেখা অথবা বিভিন্ন রং ও  চেহারার মানুষ পরখ করা। অবশ্য এটি আমাকে বেশ পুলকিত করে! কারণ মানুষের বিচিত্র চেহারা দেখতে আমার ভালোই লাগে, তাতে পৃথিবীর রহস্যময়তার স্পর্শ পাই। তবে ট্রানজিটে এখন সময় কেটে যায়।

ডিজিটালের এই চরম যুগে হাতের ডিভাইস আমাদের এক অর্থে দারুণ সহযোগিতা করছে! ওয়াই-ফাই থাকার কারণে আপনি ইচ্ছে করলে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো মানুষের কাছে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছেন, বিনা পয়সায় কথা বলতে পারছেন, খবর দেখতে পারছেন, সিনেমা দেখতে পারছেন, সারা পৃথিবীর যে কোনো বিষয় মিনিটের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন, এমনকী গোগল ম্যাপ দেখে যে কোনো গন্তব্য নির্ধারণ করতে পারছেন। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনি সহযোগিতা পাবেন, সেটি হলো ভাষার দূরত্ব হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারবেন। সেটি হলো ট্রানস্লেশনে গিয়ে বাংলাকে স্প্যানিশে, আরবিকে ইংরেজিতে নিয়ে যেতে পারবেন।

খুব আফসোস লাগছে যে, বিমান বন্দরের বাইরে শহর ও শহরের বাইরের মরুভূমির নান্দনিক দৃশ্য দেখার সুযোগ হলো না। তাই বিমান বন্দরের ভেতরেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোনো নাগরিককে। পেয়েও গেলাম একজন ভদ্রমহিলাকে, যিনি পেশায় বিমানবালা। আমার কথা বলার আগ্রহ দেখে তিনি নজেই এগিয়ে এলেন এবং আমার সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথা বললেন। যদিও তাঁর মূল ভাষা আরবি আর আমার বাংলা। আমি জানতে চাইলাম, তাঁর পেশা ও দুবাই সম্পর্কে। সে যা বলল, তা হলো-‘আমি এই পেশাকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি। আমি এতে অর্থ এবং আনন্দ দুটোই পাচ্ছি। মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই ভালো করছে। আর দুবাই সম্পর্কে তোমাকে জানাই- দুবাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী ও দেশটির সবচেয়ে বড় এবং জনবহুল শহর। দুবাইয়ের আশেপাশের শহরগুলো হলো- দক্ষিণে আবুধাবি, উত্তর-পূর্বে শারজাহ এবং দক্ষিণ-পূর্বে ওমান।

বর্তমানে দুবাইয়ের জনসংখ্যা প্রায় ২,৭৮,৯,০০০ জন। পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত দুবাই এই অঞ্চলের দ্বিতীয় ব্যয়বহুল এবং বিশ্বের বিশতম ব্যয়বহুল শহর। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্রও দুবাই। এই দুবাই যাত্রী ও পণ্যবাহী বিমানের জন্য একটি বড় বৈশ্বিক পরিবহন কেন্দ্র। দুবাইয়ের মূল আয়ের উৎস তেল, পর্যটন, বিমানচালনা, রিয়েলস্টেট ইত্যাদি। দুবাই সারা পৃথিবীকে আকৃষ্ট করেছে বড় বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, অসংখ্য হোটেল এবং বড় নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে। এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিল্ডিং এবং মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলা হযেছে। অথচ আমরা জানি, প্রায় আড়াই শ’ বছর আগে এই দুবাইয়ের মানুষেরা মাছ ধরে জীবিকা অর্জন করতো।

হরেক দেশের মানুষের ভিড়ে ঠাসা দুবাই এয়ারপোর্ট 

এখানে একটু বলে রাখি, এই পেশা ছিল আরবের প্রায় প্রত্যেক দেশেই। আমি নিজে এই পেশার প্রমাণ পেয়েছি এরকম তিনটি দেশের ন্যাশনাল মিউজিয়াম পরিদর্শন করে। যেমন বাহরাইন, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় জাদুঘর দেখে তাদের আদি পেশা অর্থাৎ জেলে জীবনের নিদর্শন দেখেছি। সে আরো বলল, দুবাই যেহেতু আরব মরুভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত, সেকারণে এর বেশিরভাগ বালুময় মরুভূমি। তাই প্রাকৃতিক দৃশ্য বলতে রয়েছে ধূ ধূ বালুচর। গবেষকরা বলেছেন, দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে কঙ্কর মরুভূমি এবং বালি বেশিরভাগই চূর্ণশেল, সূক্ষ্ম প্রবাল নিয়ে গঠিত পরিষ্কার ও সাদা বালি। লবণাক্ত উপকূল রয়েছে শহরের পুব দিকে এবং উত্তর-দক্ষিণে রয়েছে সমভূমি এবং সলখা হিসেবে পরিচিত টিলা। যা সারি সারি এগিয়ে গেছে।

এক সময় দুবাই শাসন করতো ব্রিটিশরা। বাংলাদেশের সাথে একটি মিল আছে, সেটি হলো ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাত ৭টি অঞ্চল সংযুক্ত করে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো হলো- আবুধাবি, দুবাই, আজমান, শারজাহ, উম্মুল কুয়াইন, ফুজিরা ও রাস-আল-খাইমা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল বাহরাইন ও কাতারের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আসেনি। এখানে বহু প্রাচীন আমলের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দূতের মাধ্যমে এখানে ইসলাম ধর্মের প্রচলন হয় এবং নবী করিমের মৃত্যুর পর অমুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অমুসলিমরা পরাজিত হলে, সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলামের জয় জয়কার হয়।

এই বিমান বন্দরে দেশীয় লোকজনের পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ দেখলাম। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নানা পর্যায়ের মানুষ। আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু শ্রমিক ভাইয়েরা মালিক ও সিসি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চাইলো না। শুধু তথ্য জানার খাতিরে একজনকে বললাম, কত দিন আছেন এখানে? কেমন আছেন? উত্তরে বললেন, বেশ কয়েক বছর ধরে আছি। তবে পরিশ্রম খুব বেশি। একটু থেমে নিজেই বললেন, পরিশ্রম তো করতেই হবে, দেশে কী করবো?

ব্যস্ত বিমানবন্দরে করোনা সচেতনতা মেনে চলছে সব কাজ

ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম দুবাই এয়ারপোর্টের অন্দর মহল। অন্দর মহল বললাম এ কারণে যে, রাজপ্রাসাদের অন্দর মহলের মতোই এটি গড়ে তোলা হয়েছে। রানী তার সখী-সহযোগীদের নিয়ে অন্দর মহলে বাস করতে যাতে বিরক্ত না হন, তেমনি ট্রানজিটের যাত্রীরা যাতে দীর্ঘ সময় এখানে হেঁটে হেঁটে, দেখে দেখে, বসে বসে, খেতে খেতে, কেনা-কাটা করতে করতে পরবর্তী বিমানে উঠতে পারে, তার সুব্যবস্থা করে রেখেছে আরবের এই দেশটির বণিক-রাজরা। অনেক বড়, অনেক খোলামেলা এবং কয়েক তলা মিলিয়ে জ্বলজ্বল করা এমন ব্যস্ততম বিমান-বন্দর মধ্যপ্রাচ্যে আর নেই।

আমাদের ট্রানজিটের সময় শেষ হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই গন্তব্য যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে পরবর্তী বিমানে উঠবো। এখানে বলে রাখি, এই ভ্রমণে আমাদের বলতে, আমরা ছয়জন। ভ্রমণের দলনেতা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, যিনি ভ্রমণপিয়াসী একজন মানুষ। একইসঙ্গে বাংলা ভাষার একজন বিশিষ্টি কথাসাহিত্যিক বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যিনি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন, আরো রয়েছেন জাদুঘরের আমার চারজন সহকর্মী- কঙ্কনকান্তি বড়ুয়া, দিবাকর সিকদার, সাইদ সামসুল করীম এবং নাছির খান। এঁদের মধ্যে শেষ চারজনের এটিই পশ্চিমের দিকে প্রথম যাত্রা। সেকারণে তাদের মধ্যে কৌতূহল ও দেখার আগ্রহ প্রবল। তারা তাই ছুটে বেড়াচ্ছে এপাশ থেকে ওপাশ। আমি কিছুক্ষণ ওদের পিছু পিছু ছিলাম, দেখলাম ওরা ঘুরে ঘুরে দেখছে ঘড়ি, খেজুর, চকলেট, মোবাইলসেট আর নানান কসমেটিকস। শুধুই দেখা, কেনাকাটা নয়। আরো একটি বিষয়- সময় কাটানো। কারণ পাঁচ ঘণ্টা ট্রানজিট, অনেক দীর্ঘ সময় তো বটেই।

উড়াল দেওয়ার অপেক্ষায় সারি সারি উড়োজাহাজ

ধীরে ধীরে ট্রানজিট টাইম ফুরিয়ে এলো। আবারও ইমিগ্রেশন, আবারও আকাশে উড়াল দেওয়া। এই উড়ালে একটি বিশাল বোয়িং বিমানে উঠলাম, যেটি ডুপ্লেক্স। এমিরেটসে ভ্রমণ সত্যি আরামদায়ক। যথারীতি উইন্ডো সিট। আকাশের মেঘ গুনে গুনে দূর নীলের স্পর্শ নিয়ে ছুটলাম। এরকম আকাশে উঠলেই আমার মন যেন কেমন করে?

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com