মাঘের তীব্র শীতের সকাল, সূর্যের আলো তখনো ভালোভাবে ফোটেনি। এসময় পানি আর বনের ভ্রমণটাই ভিন্ন আমেজের হয়।
রাতারগুল ফরেস্টে একটা সকাল কাটিয়েছি আমরা। এমন সবুজের রাজ্যে পরিবেশকর্মীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
শরীফ জামিল, মেজবাহ উদ্দিন মান্নু, মুশফিক আরিফ, আরিফুর রহমানসহ সারা দেশের ৩৫ জন পরিবেশকর্মী রাতারগুলে তিনদিন ধরে অবস্থান করেছি।
বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) সকালটা আমাদের জন্য এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। খুব সকালেই প্রায় আধা মাইল দূর থেকে নীল দিগন্তে মিতালি পাতানো সবুজ চাঁদোয়ার হাতছানির দিকে হাঁটা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা সকাল। সরু নালার মতো লেক, সেখানে সারি সারি ডিঙি নৌকা ভেড়ানো। সারিবদ্ধ পাতানো ডিঙি নৌকা নিয়ে সারিবদ্ধ হয়েই পরিবেশকর্মীদের প্রবেশ বনের ভেতর।
সকাল থেকেই তীব্র শীতে আকাশও কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন, তারপরও নিঝুম ঝকঝকে সকাল। তটিনীর কূলে ডেকে যায় একলা ডাহুক। এমন নিস্তব্ধ সকালে শুধু নৌকার বৈঠা শব্দ করছে ছলাৎ ছলাৎ।
যেখানে প্রকৃতি তার মায়াবী রূপের সবটাই যেন ঢেলে দিয়েছে, সেই রূপে বিমোহিত হয়ে এগিয়ে যাওয়া সবুজের বনে ঘুরে বেড়িয়েছেন পরিবেশকর্মীরা। রাতারগুল বন পরিবেশ সুরক্ষা এবং নিরাপদ করতে এই পরিবেশকর্মীদের ছিল আন্দোলন, সংগ্রাম।
‘বাংলার অ্যামাজন’ নামে পরিচিত সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুলে ঘুরে বেড়ানোর গল্পটা বাস্তবে দেখলেন তারা। রাতারগুল মূলত ‘ফ্রেশ ওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট’ বা জলাবন। এমন বন বাংলাদেশ আর কোথাও দেখা যায় না। যে খেলায় উন্মাদনা নেই, নেই আনন্দ, নেই জেতার প্রতিযোগিতা, আছে ভারসাম্য বজায় রাখার সুকৌশল। এমন সুকৌশল অবলম্বন করে গলাসমান জলে দাঁড়িয়ে আছে রাতারগুলের গাছগাছালি! যা উপলব্ধি করতে হয় অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে।
রাতারগুল বনের গাছগাছালি
অন্তর্দৃষ্টিতে ঘাপলা থাকলে রাতারগুল তার কাছে তুচ্ছ হতে পারে। বলতে হয়, এমন একটি রহস্যময় জলাবনের নামই হচ্ছে ‘রাতারগুল’।
রাতারগুল জলাবন বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যা সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত। বনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
উত্তরে মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর। যেখানে কৃষকদের চাষ করা সবুজে ভরপুর। মাঝখানে ‘জলাবন’ রাতারগুল।
উইকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে, সারা পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশ আছে দুটি, একটা শ্রীলংকায় আরেকটা আমাদের রাতারগুলে। অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল এ বনের সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র অ্যামাজনের।
রেইন ফরেস্ট নামে পরিচিত হলেও বিশ্বের স্বাদুপানির সবচেয়ে বড় সোয়াম্প বন কিন্তু ওই অ্যামাজনই। ঠিক অ্যামাজন সোয়াম্পের মতোই স্বাদুপানির বন রাতারগুল।
আমাজনের মতো এখানকার গাছ বছরে ৪ থেকে ৭ মাস পানির নিচে থাকে। শীতের সময়টা রাতারগুল বনের পানির রং থাকে হলদে। পানি হলদে বর্ণের হওয়ায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। যা পরিবর্তন হয় বৃষ্টির সময়।
স্থানীয়দের ধারণা পাহাড়ের পানি রাতারগুল বনের মধ্যে আসায় পানির রং পাহাড়ের মাটির রঙের মতো হয়।
এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে।
এছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ গাছ, আছে পিঠালি, অর্জুন, ছাতিম, গুটি জাম, আছে বট গাছও। এই বনে সাপের আবাস অনেক বেশি। এছাড়া রয়েছে বানর, গুঁইসাপ, সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি।
এতো কিছু সম্ভাবনা থাকলেও পর্যটকদের আসার জন্য তেমন কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। যাও আছে তা একেবারেই অপ্রতুল। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে দুপাশে চায়ের বাগান, সবুজে সমারোহ পর্যটকদের আকৃষ্ট করে রাতারগুলের ভিন্নরূপ। এতেও রয়েছে অনেক ঝুঁকি।
পরিবেশবাদীদের দাবি, রাতারগুল বনে একটা সময় বনদস্যু, বালুদস্যু আর রাঘববোয়ালদের আনাগোনা ছিল,এখন অবস্থা ভিন্ন। তবে রাতারগুল বনটি পর্যটন কেন্দ্র হয়েছে, অনেক পর্যটক আসছে, উন্নয়নও হচ্ছে দিনদিন।
সম্ভাবনার পাশাপাশি নতুন সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে আর তা হলো প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলার কারণে। যার কারণে উভয় সংকটে পড়ছে রাতারগুল।
সিলেটের পরিবেশকর্মী আব্দুল করিম কিম বলেন, রাতারগুল নিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ছিল। আজ আমরা সফল হয়েছি। রাতারগুল প্রচুর সম্ভাবনাময় জায়গা, সম্ভাবনার পাশাপাশি সমস্যা নতুন করে যুক্ত হয়েছে। তা হলো যেসব পর্যটক আসছে তারা প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলছে ফলে এখানে যেমন পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পাশাপাশি তেমনই পরিবেশের ভারসাম্যও হুমকির মুখে পড়ছে। সরকারের এ ব্যাপারে সুদৃষ্টি দেওয়া দরকার।
ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক পরিবেশকর্মী শরীফ জামিল বলেন, রাতারগুল বনে একটা সময় বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হতো, বালু উত্তোলন করা হতো, বন ধ্বংস করা হতো। আমরা এ বন সুরক্ষায় অনেক আন্দোলন করেছি। সম্ভাবনাময় এ বনটি শুধু পর্যটকদের জন্য সমৃদ্ধ নয়, অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হচ্ছে সরকার। এ বনের পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্ব সকলের।
টেকসই উন্নয়ন পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব কৌশলগত রাতারগুলে তিনদিনের কর্মশালায় উপস্থিত থেকে তিনি আরও বলেন,‘পরিবেশ রক্ষায় যতক্ষণ পর্যন্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবেশ রক্ষার যে কোন প্রয়াসই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিন দিনের কর্মশালায় যারা অংশগ্রহণ করেছেন তারা প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট কিছু পরিবেশ সংবেদনশীল এলাকায় স্থানীয়ভাবে সামাজিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। আমরা রাতারগুলকে কর্মশালার জায়গা হিসেবে পছন্দ করেছি। আমরা সবাই মিলে কৌশল নির্ধারণ করব, কীভাবে রাতারগুলসহ পরিবেশ রক্ষা যায়।