
ইতিহাস:
মহাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ খৃষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে শুরু হয়। তখন মধ্য চীনের প্রশাসন উত্তরাঞ্চলের জাতির আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দেয়াল দিয়ে সীমান্তে তৈরি করা প্রহরা টাওয়াগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থা করে। চীনের বসন্ত ও শরত যুগ আর যুদ্ধমান রাজ্যসমূহের যুগে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অনেক লড়াই হয়েছিলো। বড় রাজ্যগুলো পরস্পরের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সীমান্তের নিকটবর্তী পাহাড়ে মহাপ্রাচীর তৈরির কাজ শুরু করে। খৃষ্টপূর্ব ২২১ সালে ছিন রাজবংশের প্রথম রাজা চীনকে একীকৃত করার পর আগের ছোট ছোট রাজ্যের তৈরি করা মহাপ্রাচীর সংযুক্ত হয়। আস্তে আস্তে আঁকাবাঁকা পাহাড়গুলোতে তৈরি এই প্রাচীর উত্তর সীমান্তের পথ রুখে দেয়। এতে উত্তর দিকের মঙ্গোলিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমির পশুপালকদের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। ছিন রাজবংশের আমলে মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৫০০০ কিলোমিটার। ছিন রাজবংশের পর হান রাজবংশ মহাপ্রাচীর আরও ১০ হাজার কিলোমিটার বাড়িয়ে দেয়। দু’হাজারেরও বেশি বছর ধরে চীনের বিভিন্ন সময়ের প্রশাসন ভিন্ন মাত্রায় মহাপ্রাচীরের কাজ এগিয়ে নেয়। বিভিন্ন রাজবংশের আমলে নির্মিত প্রাচীর এক সঙ্গে সংযুক্ত হলে এর মোট দৈর্ঘ্য ৫০ হাজার কিলোমিটারেও বেশি হতে পারে। যার অর্থ এ প্রাচীর পৃথিবীকে এক দফা ঘেরাও করতে পারে।
এখন মহাপ্রাচীর বলতে সাধারণত মিং রাজবংশের আমলে (১৩৬৮-১৬৪৪) তৈরি মহাপ্রাচীর বোঝায়। এটি চীনের পশ্চিমাংশের কানসু প্রদেশের চিয়াইয়ু কুয়ান থেকে চীনের উত্তর-পূর্ব লিয়াও নিং প্রদেশের ইয়েলো নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই মহাপ্রাচীর চীনের ৯টি প্রদেশ, শহর, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে গেছে। এর মোট দৈর্ঘ্য ৭৩০০ কিলোমিটার। চীনা হিসেবে প্রায় ১৪ হাজার লি। সুতরাং চীনের মহাপ্রাচীরকে ১০ হাজার লি’র মহাপ্রাচীর বলা হয়। প্রতিরক্ষা প্রকল্প হিসেবে মহাপ্রাচীর পাহাড়ে তৈরি করা হয় এবং মরুভূমি, মালভূমি, জলাভূমি অতিক্রম করেছে এটি। মহাপ্রাচীর যে সব জায়গা অতিক্রম করেছে সে সব জায়গার ভৌগোলিক অবস্থা খুব জটিল। নির্মাণকারীরা ভৌগোলিক অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কাঠামো প্রয়োগ করেছেন। এতে চীনের পূর্বপুরুষদের মেধা ও নির্মাণ দক্ষতা ফুটে উঠেছে।
মহাপ্রাচীর আঁকাবাঁকা ও উঁচু-নিচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীরের নিচে খাড়া পাহাড়ি খাদ। প্রাচীর আর পাহাড় পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রাচীনকালে এই মহাপ্রাচীর অতিক্রম করা ছিলো অসম্ভব! প্রাচীর সাধারণত বড় বড় ইট আর লম্বা পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। ইট ও পাথরের ভিতরে হলুদ মাটি ও পাথরের টুকরা দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে। প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় দশ মিটার। তার প্রস্থ ৪ থেকে ৫ মিটার। এতে যুদ্ধের সময় খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহে সুবিধা হয়। দেয়ালের ভিতরে পাথরের সিঁড়ি আছে। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে সহজেই উঠা-নামা করা যায়। অল্প কিছু দূর পর পর রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এসব টাওয়ারে অস্ত্র ও খাদ্য রাখা হতো। এখানে সেনারা বিশ্রামও নিতো। যুদ্ধের সময় সেনারা এর আড়ালে আশ্রয় নিতে পারতো। তা ছাড়া, শত্রুর আক্রমণ টের পেলে এসব টাওয়ারে আগুন জ্বালানো হতো। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে খবর পৌঁছে যেতো।
বর্তমানে মহাপ্রাচীরের এ ভূমিকা আর নেই। কিন্তু তার বৈশিষ্ট্যময় স্থাপত্য রয়েছে। মহাপ্রাচীর দেখতে খুব মজবুত একটি স্থাপনা। দূর থেকে দেখলে এ মহাপ্রাচীরকে একটি উড্ডয়নমান ড্রাগনের মতো মনে হয়। আর কাছ থেকে দেখলে উঁচু-নিচু পাহাড়ের সঙ্গে মিশে থাকা একটি সুমহান রহস্যময় স্থাপনা বলে মনে হয়।
মহাপ্রাচীরের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাত্পর্য রয়েছে। এটি প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করে। চীনে একটি প্রবাদ আছে, ‘মহাপ্রাচীর দেখতে না গেলে প্রকৃত পুরুষ হওয়া যায় না।’ দেশি-বিদেশি পর্যটকরা মহাপ্রাচীরে উঠে খুব গর্ব বোধ করেন। চীন ভ্রমণে আসা বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট মহাপ্রাচীরে উঠেছেন। এখন মহাপ্রাচীরের কয়েকটি অংশ অপেক্ষাকৃতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেমন, বেইজিংয়ের বিখ্যাত পাতালিং, সিমাথায়, মুতিয়েনইউ, মহাপ্রাচীরের পূর্ব দিকের সানহাই কুয়াং এবং মহাপ্রাচীরের পশ্চিম দিকে কানসু প্রদেশের চিয়াইয়ু কুয়াং প্রভৃতি অঞ্চল। এসব জায়গা চীনের বিখ্যাত পর্যটন জায়গা। সারা বছর এসব স্থানে ভিড় লেগে থাকে।