চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার কুমারধন গ্রামের তরুণ মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ। প্রায় দুই যুগ আগে, ২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। পড়াশোনা না করে সারা দিন বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো একজন চরম অমনোযোগী কৃষকপুত্রের পাস করার কোনো কারণও তো ছিল না। বয়সে ছোট ছেলেরা সহপাঠী হবে—এই আশঙ্কায় দ্বিতীয়বার আর পরীক্ষা দেওয়ার চিন্তা মাথায় আনেননি সুলতান। ভেবেছিলেন, সিনেমার নায়কের মতো ঢাকায় গিয়ে ব্যবসা করলেই বুঝি ভাগ্য বদলে যাবে, তারপর সফল মানুষ হিসেবে মা-বাবার কাছে ফিরবেন।
সুলতান মাহমুদ সফল হয়েই ফিরেছেন। মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে তিনি সফলতা পেয়েছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত আসতে রবার্ট ব্রুসের গল্পকেও হার মানিয়েছে তাঁর অধ্যবসায়। দিন কয়েক আগে ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে সেই অধ্যবসায়ের গল্পই শোনান সুলতান মাহমুদ। মায়ের অনুরোধে দ্বিতীয়বার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েও ফেল করেছিলেন সুলতান! পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এক বিঘা জমি ভাড়া করে শুরু করলেন মিষ্টিকুমড়ার চাষ। ফলন ভালো হলো না। হতাশ হলেন খুব। তখন আরেক বন্ধুর অনুরোধে সুলতান ২০০৪ সালে তৃতীয়বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেন। এবার সব বিষয়ে পাস করলেন।
এসএসসির পর কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার আকবর আলী খান কারিগরি কলেজে ভর্তি হলেন সুলতান। বাবা আবদুল মালেক দরিদ্র কৃষক, মা রেনুজা বেগম গৃহিণী। ফলে পরিবার থেকে আর্থিক কোনো সহযোগিতা পাওয়া গেল না। তাই এক বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বিমা কোম্পানিতেও খণ্ডকালীন কাজ করেন সুলতান। সেটিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না। মন লাগালেন উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনায়। এইচএসসি পরীক্ষা ভালোভাবেই উতরে গেলেন।
এইচএসসি পাস করার পর সুলতান দেখলেন তাঁর বাল্যবন্ধু সাব্বির ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স করে একটি প্রতিষ্ঠানে থ্রিডি রেন্ডারিংয়ের কাজ করছেন। সাব্বিরের পরামর্শে ২০০৬ সালের জুন মাসে ঢাকা পলিটেকনিকে ছয় মাসের একটি কোর্সে ভর্তি হলেন। সুলতান আশা করছিলেন, কোর্স শেষ হলে খুব সহজেই চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল পুরো উল্টোটা। এক অফিস থেকে অন্য অফিস ঘুরতে ঘুরতে পকেট ও মনোবল—দুটিই শূন্য হতে লাগল।
মাস দুয়েক পরে বন্ধু সাব্বির একটি প্রতিষ্ঠানে সুলতানের জন্য ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) প্রকৌশল অঙ্কনের সফটওয়্যারভিত্তিক শিক্ষানবিশির ব্যবস্থা করলেন। সেখানে শর্ত ছিল তিন মাসের কাজ দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু তিন সপ্তাহ না যেতেই না করে দিল তারা। চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না সুলতান মাহমুদের। যাতায়াত করতেন বাসে বা হেঁটে। দুপুরের খাবার বলতে বেশির ভাগ সময়েই ছিল দুটি শিঙাড়া। এরপর একই রকম শর্তে অন্য এক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশির ব্যবস্থা হয়। এখানেও এক মাসের বেশি টিকলেন না।
আবার ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে এলেন সাব্বির। নিজের অফিসে বলে আবার শিক্ষানবিশির ব্যবস্থা করে দিলেন। এবার শিক্ষানবিশির মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারলেন। মাসিক চার হাজার টাকা বেতনে চাকরি হয়ে গেল সুলতানের। চাকরিতে যোগ দেওয়ার মাসখানেক পর ঈদুল আজহা চলে এল। কিন্তু ঈদের আগে বেতন-বোনাস পেলেন না সুলতান। মনে কষ্ট নিয়ে ছেড়ে দেন সেই চাকরি।
হতাশা পেয়ে বসে সুলতানকে। আত্মবিশ্বাসের একরত্তিও বাকি রইল না আর। দেশে কিছু হচ্ছে না দেখে বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করলেন। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ৯ মাস প্রশিক্ষণ নিলেন। সেই চেষ্টাটিও বৃথা গেল।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে সাব্বিরের পরিকল্পনায় তৈরি হয় থ্রিডি ড্রয়িংয়ের স্টুডিও। যেখানে স্থাপত্য নকশা তৈরি ও রেন্ডার করার কাজ হতো। এই স্টুডিওতেই থ্রিডি রেন্ডারিংয়ের কাজ করা শুরু করলেন।
নতুন কর্মজীবন সাবলীলভাবেই চলতে থাকল। এরই মধ্যে ২০১০ সালে বিয়ে করলেন সুলতান। তবে সামান্য বেতনে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় সংসার চালানো কি অতই সহজ? অভাব কাটছিল না। বেতন যা বাড়ছিল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল জীবনযাপনের ব্যয়। সুলতান অতিরিক্ত আয় করার প্রয়োজন অনুভব করলেন। কিন্তু বাড়তি কাজের জন্য একটি কম্পিউটার লাগবে। মায়ের শরণাপন্ন হলেন। মেজ ভাইয়ের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা জোগাড় করে দিলেন মা।
অবশেষে ধারদেনা করে একটি ইনটেল কোর আই থ্রি প্রসেসরের একটি কম্পিউটার কিনে ফেলেন সুলতান। অফিসের কাজের পর শুরু করেন বাইরের কাজ। অফিস শেষে রাত ১০টায় বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেয়ে আবার কাজে বসে পড়েন। রাত দুইটা-তিনটা পর্যন্ত কাজ করে পরদিন সকাল ১০টায় আবার অফিসে যেতেন। এই ছিল রুটিন। অভাব দূর হলো এবার।
এবার বাস্তবতার সবচেয়ে ভয়ংকর রূপটা দেখতে হয় সুলতানকে। শুধু অর্থের অভাবে নিজের প্রথম ছেলেসন্তানটি জন্মের পরপর মারা গেল। সেদিন জীবনে অর্থের গুরুত্ব হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন সুলতান। শুরু করেন দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম। টাকা উপার্জন করতেই হবে। কিন্তু বিপর্যয় কি আর তাঁকে ছাড়বে? ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সাব্বিরের অফিস বন্ধ হয়ে যায়।
সুলতান তবুও দমে যাওয়ার পাত্র নন। ২০১৫ সালের মে মাসে ইন্টারনেটে আউটসোর্সিং কাজ পাওয়ার ওয়েবসাইট (মার্কেটপ্লেস) আপওয়ার্কে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন সুলতান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আপওয়ার্কে অ্যাকাউন্ট খোলার ঠিক সাত দিনের মাথায় অস্ট্রেলিয়ার একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে থ্রিডি রেন্ডারিংয়ের কাজ পেলেন সুলতান। এ থেকেই হলো শুরু। থ্রিডি রেন্ডারিংয়ের পাশাপাশি আর্কিটেকচারাল টুডি রেন্ডারিংয়ের কাজ পেতে থাকলেন। ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্ত্রী নাজমুন নাহারকেও ধীরে ধীরে শেখাতে শুরু করলেন টুডি রেন্ডারিংয়ের কাজ। নাজমুন নাহারের শিখতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কাজ শিখেই স্বামীকে সহযোগিতা করা শুরু করলেন তিনি।
২০২১ সাল পর্যন্ত সুলতান ও নাজমুন নাহারই কাজ করতেন। ২০২২ সালে দুজন মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন আর্কিওভিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে এখন নিয়মিত শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন চারজন। প্রতিষ্ঠানটি স্থাপত্য ও প্রকৌশল নকশার ত্রিমাত্রিক রূপ দেয় অর্থাৎ রেন্ডারিং করে। এ ছাড়া দ্বিমাত্রিক বা টুডি নকশা রেন্ডার, থ্রিডি অ্যানিমেশন ইত্যাদি কাজও করে আর্কিওভিজ।
আপওয়ার্ক থেকে ১ লাখ মার্কিন ডলার আয়ের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার প্রচুর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সরাসরি কাজ করছে আর্কিওভিজ, যা থেকে সুলতানের আয় হয়েছে আপওয়ার্কের থেকেও কয়েক গুণ বেশি। ঢাকার উত্তরায় বাসা ভাড়া নিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করছেন সুলতান।
মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ আজ সফল। অভাব বলতে কিছু নেই তাঁর। মাসে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয়। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার জন্য পাকা বাড়ি করে দিয়েছেন তিনি। এই সফলতার পরও ঈদে বেতন-বোনাস না পাওয়ার পুরোনো সেই স্মৃতি ভোলেননি সুলতান। ঈদের আগে নিজের কর্মীদের বেতন ও বোনাস সবার আগে নিশ্চিত করেন। তাঁর চিন্তা, কোনো কর্মীর ঈদ আনন্দ যেন মাটি না হয়। সামনে আরও বড় পরিসরে কাজ শুরু করা, আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান সুলতান।
সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যেককে আগে খুঁজে বের করতে হবে, কোন বিষয়টি তিনি ভালো বোঝেন। তারপর ধৈর্য নিয়ে নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে সেই বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। একই সঙ্গে যোগাযোগে দক্ষতা বাড়ানোও অতি জরুরি। সব সময় নিজেকে হালনাগাদ থাকতে হবে। এগুলো মেনে চলার পর কেউ যদি সততার সঙ্গে পরিশ্রম করে, তাঁকে কেউ আটকাতে পারবে না।