দূর দেশে পরিচিত মুখ দেখার একটা আলাদা আনন্দ আছে! ফিলাডেলফিয়ার গ্রেহাউন্ড বাস স্টেশন থেকে বেরিয়ে পরিচিত এক মুখ দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। নিউ ইয়র্ক শহর থেকে শার্লটসভিল যাওয়ার পথেই যখন ফিলাডেলফিয়া, তখন ‘রকি’র শহরে কিছুক্ষণ সময় না কাটিয়ে যেতে মন চাইছিল না! অতএব, দু’সপ্তাহের আমেরিকা ভ্রমণের সূচিতে দু’টো দিন বরাদ্দ হল ফিলাডেলফিয়ার জন্য। ‘রকি’ অর্থাৎ রকি বালবোয়া। মানে, ১৯৭৬ সালে সিলভেস্টার স্ট্যালোনের যে বক্সার অবতার দু’চোখ ভরে দেখেছিলেন। রকি থাকতেন ফিলাডেলফিয়াতেই।
দৌড়তে বেরোতেন শহর জুড়ে। দৌড় শেষ হত ফিলাডেলফিয়া মিউজ়িয়ম অফ আর্টের সিঁড়ির উপরে। ছোটবেলা থেকেই আমি আদ্যোপান্ত রকি-র ফ্যান। তাও আবার সোজা ফিলাডেলফিয়া এসে পড়েছি। তাই, রকির স্মৃতিজড়িত জায়গায় না গেলে কী আর হয়! এসব ভাবতে ভাবতে বাস স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিলাম। সঙ্গী প্রসেনজিৎদা অবশ্য ট্রেনেই যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নতুন কোনও শহরে এসে পায়ে না হাঁটলে আমার পোষায় না! তাই, দাদার কথা অগ্রাহ্য করে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে ডাউনটাউনের মধ্যে দিয়ে শুকিল নদীর সেতু পেরিয়ে মার্কেট স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখি ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসে পড়েছি।
মনে পড়ে গেল, আমার এক বন্ধু ক’মাস পরে এখানেই পড়তে আসবে! মনে পড়তেই, বন্ধুটিকে ভিডিও কল করে ফেললাম। প্রসেনজিৎদার বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা। আর সেটা পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে। বাড়ি ঢোকার আগে ফুড ট্রাক থেকে কেনা হল ‘চিকেন ওভার রাইস’। এ রকম খাবারের কথা আগেও শুনেছি। আমেরিকার বহু জায়গায় পাওয়া যায় এই জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড। অনেকটা পোলাওয়ের সঙ্গে বোনলেস মাংসের টুকরো আর হালকা গ্রেভি হলে যেমন হয়, সেরকম আর কী! তার উপর আপনার পছন্দের সস ছড়ানো। তবে আমেরিকার খাবারের কথা বলতে গেলে একটা বিষয় না বলে পারছি না। ওদের এক প্লেট খাবার একা শেষ করা মুখের কথা নয়! সন্ধেবেলায় আবার নেওয়া হল দু’প্লেট চিকেন ওভার রাইস। চার জন মিলে ওই দু’প্লেট খাবার শেষ করতে বেশ বেগ পেতে হল! রাতে আবার বৌদির হাতের ডিনার খেয়ে ঘুম দিলাম।
আমেরিকা পৌঁছে রোজই বেশ ভোর ভোর ঘুম ভাঙত। মানে, বডি ক্লক তখনও ঠিক খাপ খাইয়ে উঠতে পারেনি। পরদিন সকালে চা ও আড্ডা সাঙ্গ করে বসলাম ব্রেকফাস্ট খেতে। অ্যাভোকাডো আর মেয়নিজ় চিজ় স্যান্ডউইচ, পট্যাটো চিপস, সতে করা সবজি, স্ক্র্যাম্বলড এগ, স্মুদি…প্রাতরাশের বহর দেখে বুঝলাম দাদা-বৌদি বেশ মার্কিনি হয়ে উঠেছেন! খেয়েদেয়ে প্রসেনজিৎদা ও আমি বেরোলাম রকি অভিযানে। ফোনের ম্যাপে ফিলাডেলফিয়া মিউজ়িয়ম অফ আর্ট খুঁজে বের করলাম। প্রায় দু’মাইল হেঁটে পৌঁছে গেলাম সেখানে। আকাশ একটু মেঘলা। ম্যাপ ধরে চললাম শুকিল নদীর উপরের আর একটা সেতু বরাবর।
৪৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম সেই ঐতিহাসিক সিঁড়ির সামনে। জায়গাটা বেশি পরিচিত রকি স্টেপস নামে। কত উৎসাহী মানুষের ভিড় সেখানে! প্রত্যেকেই ছবি বা ভিডিও তুলছেন। এর ফাঁকে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল সেখানে। সেই গাড়িতেও রকি-র ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজ়িক চলছে!আর একজনকে দেখলাম হুড পরে বেরোলেন গাড়ি থেকে আর দৌড়ে উঠতে থাকলেন সিঁড়ি বেয়ে। সবকিছু দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। আমিও দৌড়লাম সিজ়ড়ি বেয়ে। পাশে ক্যামেরাম্যান প্রসেনজিৎদা। শেষে রকির ভঙ্গিমায় ছবি তুললাম। সিঁড়ির ঠিক ডানদিকে রয়েছে রকির মূর্তি। কয়েকবছর আগে স্ট্যালোন নিজেই উদ্বোধন করেছিলেন এটি। কোথাও কোনও সিকিউরিটি গার্ড নেই। কিন্তু সকলেই লাইনে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। এদের নিয়মশৃঙ্খলা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না! মূল উদ্দেশ্য সাধন হয়ে যাওয়ায় আমার এ শহরে আর কোনও পরিকল্পনা নেই! তবে দাদা বললেন, ‘‘একটা খুব সুন্দর কবরস্থান আছে এ শহরে। নামটা ঠিক জানি না, কোথায় তাও জানা নেই।’’ তবে ইন্টারনেটের যুগে এসব কোনও বাধাই নয়। জানা গেল লরেল হিল সিমেটারি।
আধ ঘণ্টা বাসযাত্রা আর মিনিট দশেক হেঁটে পৌঁছে গেলাম সেই কবরস্থানে। শুকিল নদীর পাড়ে এক ছোট্ট টিলার উপর অবস্থিত এটি। বিশাল এলাকা। মনে পড়ে গেল, প্রাগ-এ দেখা কাফকা-র কবরস্থানের কথা। ১৮৩৬ সালে স্থাপিত লরেল হিল সিমেট্রি অনেক বেশি খোলামেলা। এটিই এ দেশের প্রথম কবরস্থান যা ন্যাশনাল হিস্টোরিক ল্যান্ডমার্ক-এর তকমা পায়। রাজনৈতিক নেতা থেকে যুদ্ধজয়ী, শিল্পী থেকে শিল্পপতি…কত কে যে ঠাঁই পেয়েছেন এই শেষ বিশ্রামের জায়গায়। সবুজ পরিবেশকে আরও মনোরম করে তোলে এখানকার চোখধাঁধানো ভাস্কর্য ও স্থাপত্য। লরেল হিল কিন্তু শুধু মৃতদের বিশ্রামের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত নয়! সাধারণ মানুষের জন্যও যথেষ্ট আকর্ষণীয় এই জায়গা। কোনও প্রবেশ মূল্য নেই। কত কে পিকনিক করতে আসেন। কেউ কেউ জগিং করেন। আবার কেউ সাইকেল নিয়ে বেড়াতে আসেন। এমনকী পোষা কুকুরের সঙ্গেও দেখলাম কতজনকে! সকলকেই মুক্তকণ্ঠে স্বাগত জানাচ্ছে লরেল হিল সিমেট্রি। প্রতিটি সমাধিই সুন্দর কারুকার্যে মণ্ডিত। অনেকগুলো আবার ফ্যামিলি টুম্ব।
সেখানে একটা ঘরের আকারে নির্মিত সমাধির দেওয়ালের মধ্যে থাকে ড্রয়ার। মাটির নীচে নয়, বরং এই ড্রয়ারেই শায়িত থাকে মৃতদেহগুলি। হেঁটে হেঁটে আমরা পৌঁছলাম টিলার উঁচু জায়গায়। এখান থেকে সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শুকিল নদী। ভারী মনোরম জায়গা! প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ওখানে কাটিয়ে বাড়ি ফেরার বাস ধরলাম। পরেরদিন ছিল শনিবার। দুপুরের বাস ধরে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে পা বাড়াতে হবে এবার। প্রসেনজিৎ দা বলল, ‘‘পনেরো মিনিট হাঁটলেই ক্লার্ক পার্ক আছে। শনিবার ওখানে হাট বসে! ঘুরে আসতে পারিস সকালবেলা।’’
প্রস্তাবটা বেশ পছন্দ হল আমার। ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সপ্তাহান্তের ছুটির মেজাজ। রাস্তায় যানবাহনও কম। তবে ফোনে ম্যাপ দেখে খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। পৌঁছে দেখলাম, সবুজ সুন্দর পার্ক। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। পার্কের অন্যপাশে দেখতে পেলাম কয়েকটি তাঁবু খাটানো। বুঝলাম ওখানেই হাট বসেছে। অর্থাৎ, যাকে আমরা বলি ‘ফার্মার্স মার্কেট’। পরিবার নিয়ে অনেকেই ঘুরতে এসেছেন পার্কে। আমি অবশ্য মার্কেটের দিকেই হেঁটে গেলাম। হয়তো আবহাওয়ার কারণে ভিড় কিছুটা কম। দোকানের সংখ্যাও কম। দেখলাম বিক্রি হচ্ছে ফল-সবজি ও নানা খাদ্যসামগ্রী। এক ভদ্রমহিলা চেজার চিজ় এনেছেন। দু’রকম চেডার চেখে দেখলাম। দু’টোই খুব সুস্বাদু। আমি এক বাক্স চেরি কিনে ফেরার পথ ধরলাম।
কলকাতা থেকে কানেকটিং ফ্লাইটে ফিলাডেলফিয়া যেতে পারেন।
ডাবল বেডের ভাড়া শুরু ১০২০২ টাকা থেকে
যোগাযোগ:+১২১৫৪৪৮২০০০
ওয়েবসাইট: www.sheratonphiladelphiadowntown.com
ডাবল বেডের ভাড়া শুরু ১৩৯৬৫ টাকা থেকে।
যোগাযোগ: +২১৫৬২৫২৯০০