রংপুর নগরের উত্তর প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে চিকলি বিল। এটি এক সময় অনাদরে, অবহেলায় পড়ে ছিল। বিলটি ঘিরে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক)। এর একপাশে নিজেরাই গড়ে তোলে সিটি পার্ক। অন্যপাশ বরাদ্দ দেয় বেসরকারি কোম্পানিকে। সে পাশে গড়ে তোলা হয়েছে আলো ঝলমল ওয়াটার পার্ক।
সম্প্রতি ওই পার্কে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কালিবাড়ী এলাকা থেকে বেড়াতে গিয়েছিলেন ফারুক হোসেন। তিনি এখন শিক্ষকতা করেন। আগে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন।
ফারুক বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারা চিকলিকে বিল হিসেবেই জানতেন। সেখানে এখন এতকিছু হয়েছে, দেখে অবাকই লাগল। চিকলি আগে ছিল শুধু বিল, এখন হয়ে গেছে বিনোদনে ঝিলমিল!
রংপুর নগরের হনুমানতলা এলাকায় প্রায় ১০০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ওই বিনোদনকেন্দ্র। এর সিটি কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত অংশের নাম চিকলি সিটি পার্ক। আর বেসরকারি কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত অংশের নাম চিকলি ওয়াটার পার্ক। ২০১৫ সালে বিনোদনকেন্দ্রটি দর্শানার্থীদের জন্য খুলে দেয় সিটি কর্পোরেশন।
চিকলি সিটি পার্কে প্রবেশ ফি ২০ টাকা। সম্প্রতি এই অংশ দিয়ে ঢুকে দেখা যায়, ভেতরে কংক্রিটে ঢালাই করা পাড়। বিলে চলা স্পিডবোটের ঢেউ আছড়ে পড়ে যেন চুমু খাচ্ছে কিনারে। পাড়ে নানা জীবজন্তুর ভাস্কর্য। জিরাফের একটি ভাস্কর্যের ওপর উঠে খেলা করছে এক শিশু।
শিশুটির বাবা-মা বললেন, বিকেলে ঘোরার জন্য জায়গাটি মন্দ নয়। শিশুরাও মজা পায়।
বিলের পাড় ধরে পূর্ব দিকে গেলে দেখা যায়, হাতের বাম পাশে সুন্দর ছাউনিঘেরা বসার বেঞ্চ। মাঝেমধ্যে দোকানঘর। সেসব দোকানে মেলে চায়ের সঙ্গে টা-ও।
এক দোকানি বললেন, ছাউনিঘেরা বেঞ্চগুলো ভালো। তবে কিছু তরুণ-তরুণী এগুলোর অপব্যবহার করেন। এতে পরিবার নিয়ে যারা আসেন, তারা বিব্রত হতে পারেন। এদিকে করপোরেশনের নজর দেওয়া দরকার।
পাড় ধরে আরও পূবে গেলে দেখা মিলবে বট-পাকুড়ের ছায়ার। যেন বাংলার যেকোনো চিরচেনা বিল। এর ডানপাশে হয়ত দেখা যাবে, টাগ-জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলে। ওনারা স্থানীয় বাসিন্দা।
একজন জেলে জানালেন, আগে বিলে মাছ বেশি পাওয়া যেত। আস্তেধীরে মাছ কমছে।
বিলের এপার থেকেই দেখা যায়, উত্তর পারে আলো ঝলমল পরিবেশ। সেখান থেকে ভেসে আসছে সুর-ছন্দও।ওই পারে গিয়ে দেখা মেলে আরেকটি প্রবেশপথের। টিকিটও কিনতে হয় আরেকটি।
হ্যাঁ, এটিই চিকলি ওয়াটার পার্ক।
এই পার্কে ঢুকে দেখা যাবে, মনোরম পরিবেশ। মৃদুমন্দ ছন্দে কোথাও গান বাজছে। হাতের বামে স্পিডবোটে ওঠার ঘাট। এসব বোটের ঢেউই আছড়ে পড়ে বিলের পাড়ে।
ঘাট থেকে বের হয়ে সামনে গেলে হাতের ডানপাশে পড়বে কৃত্রিম পাহাড়। সেই পাহাড় চিড়ে ঝরছে ঝরণাও। কোথাও দেখা যাবে, গলাউঁচু সাদাবক যেন এখনি দেবে উড়াল। কিন্তু উড়তে পারবে না, এগুলো কৃত্রিম।
এইখানে ইউনিফর্ম পরে দায়িত্ব পালন করছিলেন এক ব্যক্তি। নাম জাহিদুল ইসলাম। তিনি বললেন, পাহাড়ে ওঠা নিষেধ। পিছলে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
পাহাড়-ঝরণা পেরিয়ে সাদা কাশফুলের সমারোহ। সেই সমরোহ পেরিয়ে সামনে গেলে দেখা যাবে ইয়া বড় নাগরদোলার, শিশুদের অন্যতম আকর্ষণ। রয়েছে শিশুপযোগী আরও নানা রাইড।
এক শিশুর মন্তব্য, এখানে এলেই তার মন ভালো হয়ে যায়।
এই পারের পুরো পথজুড়ে বিলের ধারঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে বসে থাকার বেঞ্চ ও মাচাংঘর। এসব বেঞ্চ ও ঘরে বসে উপভোগ করা যায় বিলের সৌন্দর্য। শেষ বিকেলের রোদ, গোধূলির লালচে আভা আর রাতে রংবেরঙের কৃত্রিম আলোয় বিলের পানি যেন ঝিলমিল করে ওঠে।
এমনি একটি মাচাংঘরের পাশে দেখা হয় শাহীন আলম নামের এক দর্শনার্থীর সঙ্গে। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। এসেছেন কুমিল্লা থেকে।
শাহীন বললেন, ‘রংপুরে এত সুন্দর একটি বেড়ানোর জায়গা আছে, না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। রাতেই ঢাকায় ফিরব। ট্রেনের টিকিট কাটা আছে, হাতে সময়ও আছে। তাই এখানে বেড়াতে এসেছি। এসে দারুণ লাগল!’
এই পর্যটকের ভাষ্য, রংপুরের বাইরের অনেকে বিলটি সম্পর্কে তেমন জানেন না। তাই বিলটি ঘিরে প্রচারণা বাড়ালে এখানে পর্যটকের আনাগোনা আরও বাড়বে।
জানতে চাইলে চিকলি ওয়াটার পার্কের অন্যতম সত্ত্বাধিকারী ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোখলেছুর রহমান তরু জুমবাংলাকে বলেন, ‘চিকলি নিয়ে আরও বড় পরিকল্পনা আছে। পার্ক আরও বড় করা হবে। তখন দর্শনার্থীরা আরও বিনোদন পাবেন। আর তেমন কোনো প্রচার না করেও চিকলি ওয়াটার পার্কে ভিড় লেগেই থাকে। ভালো জিনিস হলে তার প্রচার এমনিতেই ছড়িয়ে পড়বেই।’