ইট পাথরের তৈরি সুউচ্চ ভবনের মাঝে যেন এই শহরের আকাশও লুকিয়ে গেছে। শহরের বাতাস হয়েছে ভারী। গগনচুম্বী এসব ভবন যেন এখন শহরের শোভা। মানুষের আভিজাত্য প্রকাশ পায় বাড়ির সৌন্দর্য্য আর বিলাসিতায়। তবে জানেন কি, এমন একটি শহর রয়েছে যেখানে বাড়ি তৈরি হয় মাটি দিয়ে। এমনকি বহুতল ভবন তৈরি উপকরণও মাটি।
আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির তৈরি বাড়ি চোখে পরে। যা শত শত বছর ধরে সে অঞ্চলের ঐতিহ্য বহন করছে। যদিও এখন তেমন একটা মাটির বাড়ি দেখা যায় না। সেখানে স্থান নিয়েছে ইট পাথরের বাড়ি। তবে ইয়েমেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হাদরামাউত উপত্যকার এক বিস্ময়কর শহর শিবাম। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন উঁচু ভবনের নগরী, যেখানে সমস্ত বহুতল ভবন কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি।
এই কারণে একে ‘মরুভূমির ম্যানহাটন’ বা ‘পৃথিবীর প্রথম উঁচু ভবনবিশিষ্ট শহর’ বলা হয়। শিবামের স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণপ্রক্রিয়া, ইতিহাস ও টিকে থাকার রহস্য এক অনন্য বিষয়।
১৯৮২ সালে ইউনেস্কো শিবামকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, কারণ এটি ঐতিহ্যগতভাবে টিকে থাকা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন উচ্চনগরী। শিবাম শুধু একটি শহর নয়, এটি মানব সভ্যতার স্থাপত্যশিল্পের এক বিরল নিদর্শন। আধুনিক প্রযুক্তির আগে কীভাবে মানুষ টিকে থাকার জন্য স্থাপত্যশৈলীকে অভিযোজিত করেছিল, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ শিবাম।
শিবামের বহুতল দালানের সংখ্যা প্রায় ৫০০টির বেশি। সাধারণত ৫-১১ তলা, কিছু ভবনের উচ্চতা ৩০ মিটার পর্যন্ত। ভবনগুলো খেজুর কাঠের ফ্রেম দিয়ে শক্তিশালী করা হয় এবং প্রতি কয়েক বছর পর পর নতুন কাদা দিয়ে সংস্কার করা হয়। প্রথম তলায় পশুর জন্য গোয়ালঘর বা দোকান থাকে, ওপরের তলাগুলো বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হয়।
এই অঞ্চলের বাড়িগুলো কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি করার বিশেষ কিছু কারণও আছে বটে। প্রথম কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সাথে মানিয়ে নেওয়া। শিবাম এক মরুভূমির শহর, যেখানে বৃষ্টি খুবই কম হয়, কিন্তু যখন হয়, তখন তা হয় প্রবল। তাছাড়া, এখানে প্রচণ্ড গরম ও ধূলিঝড় লেগেই থাকে। কাঁচা মাটির (আদোব বা সানাই মাটি) দেয়াল গরমে ঘরকে শীতল রাখে এবং শীতকালে উষ্ণতা ধরে রাখে। এছাড়া, ভূমিকম্প প্রতিরোধেও মাটির দালান বেশ কার্যকর।
শিবামের আশেপাশে পাথরের যোগান কম থাকায় এবং কাঠের অভাব থাকায় স্থানীয়রা সহজলভ্য কাদা, খড় ও খেজুরগাছের কাঠ ব্যবহার করে দালান নির্মাণ করে। এর ফলে খরচ কমে এবং পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সম্ভব হয়।
শিবামের প্রতিটি দালানই একেকটি দুর্গের মতো। অতীতে দস্যু ও শত্রুদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য শহরকে চারপাশে ঘিরে এক ধরনের উঁচু দুর্গ-শৈলীর নকশায় নির্মাণ করা হয়। সরু গলিপথ এবং সংযুক্ত বাড়িগুলো আক্রমণকারীদের চলাচল কঠিন করে তোলে।
তবে শিবামের ভবনগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকলেও আধুনিক শহরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পর্যাপ্ত সংরক্ষণ না করার ফলে এটি এখন ধ্বংসের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষত, ২০০৮ ও ২০১৫ সালের বন্যায় অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি