মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিলিয়নিয়ার ছিলেন জন ডি. রাফেলার। আজকের দিনের মূল্যে হিসেব করলে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪০০ বিলিয়ন ডলার। তার জীবনী তুলে ধরেছে অর্থনীতি বিষয়ক ওয়েবসাইট লাভমানি।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্পদশালী পরিবারগুলোকে নিয়ে ফোর্বস-এর করা তালিকায় এখনো রকফেলার পরিবারের নাম আছে। তবে রকফেলারের জীবনের শুরুটা ছিল নিতান্তই সাদামাটা।
১৮৩৯ সালে নিউ ইয়র্কের সাধারণ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জন ডি. রকফেলার। সেলসম্যান ও লোক ঠকানোর কাজের সূত্রে তার বাবা বিল বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরেই থাকতেন।
ছোটবেলায় মায়ের কাছে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রাথমিক পাঠটুকু পান রকফেলার। তার প্রথমদিকের কাজের মধ্যে ছিল টার্কি পালা, চকোলেট বিক্রি, প্রতিবেশীদের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া ইত্যাদি।
১৮৫৯ সালে মরিস বি. ক্লার্কের সঙ্গে একত্রে একটি কোম্পানি শুরু করেন রকফেলার। তার কোম্পানি বিচালি, মাংস, ও শস্যদানা বিক্রি করত। পরে তেলের ব্যবসায় নামেন রকফেলার।
১৮৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় প্রথমবারের মতো মাটি খুঁড়ে তেল উত্তোলন করা হয়। ওই ঐতিহাসিক ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে তেলশিল্পে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন রকফেলার।
কিন্তু তিনি ধারণা করেছিলেন, তেল খোঁড়ার চেয়ে তেল পরিশোধনের ব্যবসা বেশি লাভজনক হবে। তাই ক্লিভল্যান্ডে নিজের প্রথম তেল শোধনাগার চালু করতে কয়েকজনের সঙ্গে অংশীদারীত্বে যুক্ত হন তিনি।
দু বছরের মাথায় তার কোম্পানি ওই এলাকায় সবচেয়ে বড় কোম্পানিতে পরিণত হয়। এরপর কিছু অর্থ ধার করে ১৮৬৫ সালে অংশীদারদের থেকে পুরো কোম্পানি কিনে নেন রকফেলার।
ব্যবসায়র ধাঁচ আগে থেকে টের পেতেন রকফেলার। তখনকার সময় জ্বালানির মূল উৎস ছিল কয়লা। কিন্তু রকফেলার বুঝতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যতে কয়লার স্থান দখল করে নেবে তেল।
১৮৭০ সালে ভাই উইলিয়াম এবং শিল্পপতি হেনরি ফ্ল্যাগলারের সঙ্গে জোট বেঁধে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি গঠন করেন রকফেলার।
তখন কেরোসিনকে ‘গরীবের আলো’ বলা হতো। রকফেলার বুঝতে পেরেছিলেন, এ বস্তু তাকে সফলতা এনে দেবে। আর তা-ই হলো, যুক্তরাষ্ট্রে পরিশোধিত কেরোসিনের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী হয়ে উঠলেন তিনি।
তখনকার মার্কিন রেলপথ ও পরিশোধিত তেলের বড় বড় কোম্পানিগুলোকে এক ছাতার নিচে এনেছিল সাউথ ইমপ্রুভমেন্ট কোম্পানি। ১৮৭১ সালে এটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন রকফেলার।
তবে এ সংগঠনে কেবল রাঘববোয়াল কোম্পানিগুলোই স্থান পেয়েছিল। তাই বছরখানেক পরে পেনসিলভানিয়ার প্রশাসন এটিকে স্থগিত করে দেয়।
ঝানু ব্যবসায়ী রকফেলারের লাভ হুহু করে বাড়তে থাকল। এরপর বছর দুয়েক ধরে নিজের সব প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিকে কিনে ফেলেন তিনি। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মনোপলি সৃষ্টি করেন রকফেলার।
চার মাসের কম সময়ে তিনি ২২টি তেল শোধনাগার কিনেছিলেন। ক্লিভল্যান্ডে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার ৮০ ভাগ তার অনুকূলে চলে যায়। এ ঘটনা ইতিহাসে ‘দ্য ক্লিভল্যান্ড ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত।
ক্লিভল্যান্ড ম্যাসাকারের ফলে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ট্রাস্ট গঠিত হয়। পরবর্তী তিন দশকের বেশি সময় ধরে এ ট্রাস্ট যুক্তরাষ্ট্রের তেলবাণিজ্যের পুরোটাই দেখভাল করত।
নিজের এত বড় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে রকফেলারকে রেলপথের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করতে হতো। রেলগাড়িতে করেই সারাদেশে তেল পরিবহন করতেন তিনি।
অন্যদিকে মার্কিন রেলশিল্পও রকফেলারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। রেলের কার্গের ৪০ শতাংশই ছিল তার কোম্পানির তেল।
এর ফলে রেল কোম্পানিগুলোর মধ্যেও প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আর তার লাভের গুড় খেলেন রকফেলার, তিনি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পরিবহন খরচে ছাড় পেতে শুরু করলেন। এতে অবশ্য বাজারে কেরোসিন তেলের দাম সস্তা হয়েছিল।
রকফেলার কয়েকবছর বিস্তর লাভ করেন। এরপর রেলরোডের অন্যতম বড় কোম্পানি কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট ও টম স্কট রেলের ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা করে।
পাকা ব্যবসায়ী রকফেলার তখন ৪,০০০ মাইল পাইপলাইন তৈরি করে বসেন। এসব লাইন ব্যবহার করে তিনি ওহাইও থেকে পেনসিলভানিয়া পর্যন্ত তেল সরবরাহ শুরু করতে পারলেন। রেলপথের ওপর তার নির্ভরশীলতা কমে গেল। অবিশ্বাস্যরকমভাবে, রকফেলারের এ পদক্ষেপের দরুন যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ রেল কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেল।
১৮৭৩ সালে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়। প্রথমবারের মতো নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ হয়ে যায়। সারাদেশে গণহারে কাজ হারান মানুষ। কিন্তু রকফেলার এটিকেও ব্যাবসায়িক সুযোগ হিসেবে দেখেছেন। এ চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার সময় তিনি স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের প্রতিদ্বন্দ্বী আরও অনেক কোম্পানি অল্প দামে কিনে নেন।
১৮৮২ সালের মধ্যে আমেরিকার ৯০ শতাংশ তেলের মালিকানা চলে গেল স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের কাছে। দেশের ২০,০০০ তেলকূপে রকফেলারের লাখখানেক কর্মী কাজ করত তখন। অবশ্য ১৯ শতক শেষ হওয়ার আগে রকফেলারের তেলের ভাগ কমে ৮০ শতাংশে নেমেছিল।
ওই সময়ে ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমগুলো রকফেলারকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। মার্কিন সংবাদপত্রসমূহ রকফেলারকে নিষ্ঠুর ও অনৈতিক ব্যবসায়ী হিসেবে বর্ণনা করতে শুরু করে। ১৯০২ সালে আইডা টার্বেল নামক একজন লেখক রকফেলারের ব্যবসায়ের সমালোচনা করে একাধিক নিবন্ধ ও একটি বই লেখেন।
বইটিতে রকফেলার বাবা বিলের নানা কুখ্যাত ঘটনা তুলে ধরেন তিনি। প্রসঙ্গত, আইডার পরিবারের তেল শোধনাগারের ব্যবসায় স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের কারণে বন্ধ হতে বাধ্য হয়।
২০ শতকের শুরুর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট প্রভাবশালী ট্রাস্টগুলো বন্ধ করার ওপর জোর দেন। ওই সময় রকফেলার কেরোসিন শিল্পের ৯৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
১৯০৪ সালে মার্কিন সরকার স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ট্রাস্ট-এর বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টি-ট্রাস্ট মামালা দায়ের করে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আদালতে মামলা লড়াইয়ের সময় রকফেলারের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের অনেক থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ে।
১৯১১ সালে আদালত রায় দেন, স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের ব্যবসায় শেরম্যান অ্যান্টিট্রাস্ট আইনকে লঙ্ঘন করেছে। ওই সময়ও পরিশোধিত তেলের বৈশ্বিক বাজারের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল স্ট্যান্ডার্ড অয়েল। রকফেলারকে তার ব্যবসায় ভেঙে ফেলার জন্য ছয় মাস সময় দেওয়া হয়।
রকফেলার তখন তার পুরো ব্যবসায়কে ৩৪টি ছোট ছোট কোম্পানিতে আলাদা করেন। এতে আখেরে তারই লাভ হয়, তিনি আগের চেয়েও ধনী হয়ে পড়েন। তার এসব কোম্পানির মধ্যে ছিল শেভরন ও এক্সনমোবিল-এর মতো হালের বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান।
১৯৩৭ সালে ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন রকফেলার। সারাজীবনে তিনি বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় ৫৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দান করেছিলেন।
জীবিতাবস্থায় চারটি ফাউন্ডেশন তৈরি করেছিলেন তিনি। এগুলো হচ্ছে রকফেলার ফাউন্ডেশন, রকফেলার ইনস্টিটিউট ফর মেডিকেল রিসার্চ, জেনারেল এডুকেশন বোর্ড, ও লরা স্পেলম্যান রকফেলার মেমোরিয়াল।
বিভিন্ন ফাউন্ডেশন ছাড়াও শিক্ষাখাতে অনেক অর্থ খরচ করেছেন রকফেলার। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিলেন। এছাড়া তার আর্থিক সাহায্য পেয়েছে হার্ভার্ড, ইয়েল, কলম্বিয়া, ও ব্রাউনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
চিকিৎসাখাতেও রকফেলারে অবদান আছে। রকফেলার ফাউন্ডেশনের ইন্টারন্যাশনাল হেলথ ডিভিশন ম্যালেরিয়া, পীতজ্বর, হুকওয়ার্ম ইত্যাদি রোগের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালিয়েছিল।
১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে এ ফাউন্ডেশন আমেরিকান রেড ক্রস ও ইউনাইটেড ওয়ার ওয়ার্ক ফান্ডসহ বিভিন্ন যুদ্ধকালীন সহায়তা দেওয়া দাতব্য সংস্থায় ২২ মিলিয়ন ডলারের বেশি দান করে।
ফোর্বস-এর তথ্যমতে বর্তমানে রকফেলার পরিবারের মোট সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। পরিবারটির ১৭৪ জন সদস্যের মধ্যে এ সম্পদ ভাগ করা বলে ধারণা করা হয়।