পৃথিবীজুড়ে পরিব্রাজকদের শীর্ষ সারিতে নারীদের অবস্থান এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। গহীন অরণ্য, আকাশচুম্বী পর্বতশৃঙ্গ, এমনকি সাগরের মাঝে জেগে থাকা প্রবাল দ্বীপেও এখন তাদের সাবলীল বিচরণ। নারীদের ভ্রমণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটির নাম নিরাপত্তা। অনেক সময় পুরুষদের অযাচিত আচরণ নারীদের ভ্রমণকে করে তোলে ঝুঁকিপূর্ণ।
এমন রূঢ় বাস্তবতার মাঝে অনেক নারী হয়ত এমন কোথাও বেড়াতে যেতে চান যা হবে পুরুষের ছায়ামুক্ত। ‘‘সুপার শি’’ দ্বীপের গল্পটা ভ্রমণপিপাসু নারীদের কাছে কিছুটা স্বপ্নের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু আসলেই এমন একটি দ্বীপ আছে, যা কেবলই নারীদের জন্য এবং যেখানে কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই।
চলুন, বিস্ময়কর এই দ্বীপটির ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
মধ্যরাতের সূর্যের দেশ ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলবর্তী শহর রেইসবর্গ মিশে গেছে বাল্টিক সাগরে। সৈকতের কাছাকাছি বাল্টিক সাগরের বুকে রেইসবর্গ দ্বীপপুঞ্জের একটি ছোট্ট দ্বীপ ফিওর্ড্স্কার। ৮.৪ একর আয়তনের এই ভূ-খণ্ডটি ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির অন্তর্গত রেইসবর্গ শহরের অংশ। এই ফিওর্ড্স্কারই ২০১৮ সাল থেকে সুপার শি নাম নিয়ে বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র নারীদের দ্বীপের মর্যাদা অর্জন করেছে।
জার্মান বংশোদ্ভূত মার্কিন নারী উদ্যোক্তা ক্রিস্টিনা রথ ২০১৭ সালে কিনে নেন ফিওর্ড্স্কার দ্বীপটি। তিনি ফোর্বসের দ্রুত সাফল্য অর্জনকারী শীর্ষ ১০ নারী উদ্যোক্তাদের একজন। ২০১৬ সালে তিনি তার প্রযুক্তি পরামর্শদানকারী সংস্থা ‘‘ম্যাটিসিয়া কন্সাল্ট্যান্ট্স’’ ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করেন। বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য ৭১৩ কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা (১ মার্কিন ডলার = ১০৯.৭৩ বাংলাদেশি টাকা)।
ফিওর্ড্স্কারের মালিক হওয়ার পর রথ দ্বীপের নামকরণ করেন ‘‘সুপার শি’’। তার উদ্দেশ্য ছিল মূলত নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বের নানান পেশাজীবী নারীদের সান্নিধ্য পাওয়া। আর এরই অঙ্কুরে জন্ম নেয় সুপার শি।
রথ শুরু থেকেই দ্বীপে শুধুমাত্র নারীদের প্রবেশের রীতি চালু রেখেছিলেন। দ্বীপের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন স্থাপনের জন্য পুরুষ নির্মাণ শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার ছিল। এছাড়া বিশেষ অনুমতি ছিল রথের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক পুরুষের।
বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে এই উদ্যোগের কথা জানান রথ। মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়ে যায়, দ্বীপের সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার আগেই বুকিংয়ের অনুরোধ আসতে শুরু করে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ৮ হাজারেরও বেশি নারী পর্যটকের আবেদন এসেছিল সেবার। এর মধ্য থেকে রথ ১৫০ জনের ভিডিও সাক্ষাৎকার নেন।
অবশেষে ২০১৮ সালের ২৩ জুন পুরো একটি দ্বীপ রিসোর্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করে ‘‘সুপার শি’’।
২০২৩ সালের শেষের দিকে শিপিং কর্মকর্তা ডেয়ান মিহভ দ্বীপটি কিনে নেন এক মিলিয়ন ইউরোতে। মালিকানা পরিবর্তনের পরেও সেখানে চিত্তবিনোদনের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
এই দ্বীপের মাটিতে রয়েছে পান্নার মতো সবুজ শ্যাওলা এবং লাইকেনের পুরু স্তর। এগুলোর সঙ্গে মানানসই হয়ে বেড়ে উঠেছে লম্বা পাইন গাছ এবং অমসৃণ শিলা। ফার্ন, জুনিপার এবং ব্লুবেরির ঝোপে ভরা বন যেন এক বুনো উন্মাদনায় কাছে টানে।
এমন আদিম সৌন্দর্যের মাঝে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য রাখা হয়েছে শরীরচর্চার সহায়ক নানা ধরনের ক্রিয়াকলাপ। যার মধ্যে যোগ ব্যায়াম, ধ্যান, সুপিং, কাইট বোর্ডিং, সাঁতার, মাছ ধরা, কায়াকিং ও হাইকিংয়ের মতো সুবিধাগুলো উল্লেখযোগ্য। এসব কিছুকেই আরও আনন্দদায়ক করে তোলে বন্ধুত্বপূর্ণ আড্ডা ও অনুপ্রেরণামূলক আলোচনা।
দ্বীপটিতে থাকার জন্য রয়েছে ১,৮০০ বর্গফুটের চারটি সুসজ্জিত কেবিন। যার মধ্যে আছে উন্নতমানের হ্যাস্টেন্সের বিছানা, রান্নাঘর, বাথরুম এবং ফায়ারপ্লেস। এছাড়া রয়েছে ফিনিশ সনা বা কাঠের ঘর। আছে যোগ ব্যায়াম তাঁবু, ব্যায়াম সরঞ্জাম, এবং ৩৫০ বর্গফুটের তিনটি অতিরিক্ত মিনি কেবিন।
সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহের পাশাপাশি রয়েছে খোলা আকাশের নিচে রান্নার ব্যবস্থা। হেলিপ্যাড ও প্রাইভেট বিচে ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও সময়কে উপভোগ্য করে তোলে ১০০ বর্গফুটের স্পা ও ৭৫০ বর্গফুটের ইয়োগা ইয়ার্ড।
সুপার শি আইল্যান্ডে রয়েছে ব্যায়ামেরও ব্যবস্থা/প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে
অতিথিদের জন্য খাবারের উপাদান সংগ্রহ করা হয় দ্বীপের ক্ষেত থেকেই। সুষম খাবারের জন্য ‘‘প্যালিওভেদ’’ মেনে চলা হয়। অর্থাৎ আয়ুর্বেদিক নীতির সঙ্গে প্যালিও ডায়েটের উপাদানগুলোকে একত্রিত করা হয়।
অন্যান্য রিসোর্টগুলোর মতো এই দ্বীপে কোনো ধরনের অ্যালকোহল বা চিনিযুক্ত খাবার পরিবেশন করা হয় না। তাই স্বাস্থ্য নিয়ে একদম নিশ্চিন্ত থাকায় অতিথিরা পুরোটা সময় অন্যদের সঙ্গে মজার সময় কাটানোতে মনোনিবেশ করতে পারেন।
এখানে চার দিনের জন্য একজন নারী পর্যটকের খরচ হবে ২,৩০০ মার্কিন ডলার বা ২ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৬ টাকা। এর ভেতরে পানিপথ পেরিয়ে দ্বীপে পৌঁছা থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়া ও শারীরিক কার্যকলাপ সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। এক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে গেলে জনপ্রতি খরচ হতে পারে প্রায় ৪ হাজার ৬০০ ইউরো বা ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৯২ টাকা।
ফিনল্যান্ড ট্যুরিস্ট ভিসা
গন্তব্য যখন ফিনল্যান্ডের সুপার শি, তখন প্রথম কাজ হচ্ছে দেশটির টুরিস্ট ভিসা নেওয়া। ভিসা আবেদনের জন্য এ সময় প্রয়োজন হবে-
– নির্ভুলভাবে পূরণ করা ফিনল্যান্ড টুরিস্ট ভিসা আবেদন ফরম
– নূন্যতম ছয় মাস মেয়াদ থাকা বৈধ পাসপোর্ট
– পাসপোর্ট সাইজ ছবি
– বিগত ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট
– ভ্রমণ বীমা
– ট্যাক্স সার্টিফিকেট
– ফিনল্যান্ডে যাওয়া-আসার স্পষ্ট বিবরণীপত্র
ভিসা ফি বাবদ খরচ হবে ৮০ ইউরো বা প্রায় ৯ হাজার ৫৩২ টাকা। ৬ থেকে ১১ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে ধার্য হয় ৪০ ইউরো বা ৪ হাজার ৭৬৬ টাকা।
এখানে ব্যাংক তহবিল অবশ্যই ফিনল্যান্ডে প্রতিদিন ৫০ ইউরো বা ৫ হাজার ৯৫৮ টাকা খরচ করার সামর্থ্যের অনুকূল হতে হবে। সেই সঙ্গে তা আবেদনকারীর ফিনল্যান্ডে ভ্রমণের সময়সীমার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।
রেইসবর্গ দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে কাছাকাছি বিমানবন্দর রয়েছে হেলসিঙ্কিতে। তিন মাস আগে থেকে আকাশপথে রাউন্ড ট্রিপে টিকেট বুকিং করলে কেমন খরচ হতে পারে চলুন দেখে নিই।
ঢাকা থেকে ফিনল্যান্ড যাওয়ার দ্রুততম উপায় হচ্ছে দোহায় ট্রানজিট নিয়ে হেলসিঙ্কিতে নামা। এ রুটে খরচ পড়তে পারে ১,৩২৮ মার্কিন ডলার বা ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ টাকা।
হেলসিঙ্কিতে নেমে লেন্টোসেমা থেকে ট্রেনে করে যেতে হবে প্যাসিলা। তারপর ট্রেন বদলে আরেক ট্রেনে প্যাসিলা থেকে কারিসের কার্জা। দুই রেলপথে খরচ পড়তে পারে ২৮ মার্কিন ডলার বা ৩,০৭৩ টাকা। অতঃপর কার্জা থেকে ২১ মিনিটের পানিপথ পেরলেই সুপার শি-এর সৈকত। সর্বমোট প্রায় সাড়ে ১৯ ঘণ্টার এ যাত্রায় রয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ ঘণ্টার প্লেন যাত্রা।
ঢাকা থেকে ট্রেনে আগরতলা পৌঁছে সেখান থেকে হেলসিঙ্কির বিমান ধরা যায়। এ পথে গেলে সময় বেশি লাগলেও খরচ অনেকটা বাঁচানো যায়। এ পথে বিমান ভাড়া জনপ্রতি ৮৮২ মার্কিন ডলার বা ৯৬,৭৮১ টাকা।
এই রুটটি আগরতলা থেকে দিল্লি, কুয়েত ও তুর্কি হয়ে হেলসিঙ্কিতে গিয়ে শেষ হবে। আকাশ, রেল ও পানিপথ মিলে এখানে সময় লেগে যাবে প্রায় সাড়ে ২৫ ঘণ্টা।