শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৫ পূর্বাহ্ন

যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা: ভিন্ন সংস্কৃতির মানসিক ও সামাজিক প্রভাব

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৪

দেশের বাইরে কোথাও পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কিছু ধারণা থাকে। যেমন দেশ-বিদেশের নতুন বন্ধু, নতুন জায়গা ঘুরে দেখা, মোটামুটি স্বাধীন একটা জীবনযাপন করা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট বা ছবি দেখেও আমরা ধারণা করি, উচ্চশিক্ষার সময়টা বেশ প্রাণবন্ত।

তবে কিছু বিষয় আমরা অনেকেই বলি না। যেমন ‘কালচারাল শক’ কিংবা সংস্কৃতিগত অসামঞ্জস্যতা। আমার কিছু সহকর্মী জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পড়তে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা বলছিলেন। আর আমি নিজেও যখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গিয়েছি, প্রথম দিকে কিছু বিষয় মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিল। আমার অধ্যাপক তাই বলতেন, কোনো কিছুই ভালো কিংবা খারাপ নয়, মানিয়ে নিতে সময় লাগে, এই যা!

জার্মানি কিংবা যুক্তরাষ্ট্র, একেক দেশ এবং একেক জাতির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের একেকটি স্টেটের সংস্কৃতি, সেখানকার পরিবেশ একেবারেই ভিন্ন। কেন্টাকির পরিবেশ, সেখানকার মানুষের কথা বলার ধরনের সঙ্গে অবশ্যই নিউইয়র্ক কিংবা ওয়াশিংটন ডিসির সঙ্গে মিলবে না। লেক্সিংটন শহরের যেমন নিজস্ব একটি জীবনধারা আছে, আবার ওয়াশিংটন গিয়ে মনে হয়েছে এখানে বহু দেশের মানুষের আনাগোনা বেশি।

শুরুর দিকে কিছুটা খারাপ তো লাগতই। কিন্তু এই প্রাথমিক সময়টা কাটিয়ে উঠলে সংস্কৃতিগত অসামঞ্জস্যতার বিষয়গুলো অনেকটা সহজ হতে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্র খুবই ব্যক্তি স্বাধীনতাকেন্দ্রিক। যেই গ্র্যাডহাউজিং এ দুবছর থেকেছি, সেখানকার কিছু প্রতিবেশীর সঙ্গে কখনোই কথা হয়নি। কিংবা ক্লাসে পুরোদস্তুর আলোচনা, বিতর্ক হলেও অনেক সহপাঠীকে দেখেছি একাডেমিয়ার বাইরে কখনো প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলত না। শুরুতে বেশ হাঁপিয়ে যেতাম, সারাটা দিন যাচ্ছে দুটো কথা বলার লোক নেই। শহরতলীতে যে বাসা ভাড়া নিয়েছি সেখানে আমার অ্যাপার্টমেন্টের বাকি ভাড়াটেরাও তাই।

তাই ভাবতাম, আমি দক্ষিণ এশীয় বলে এমন কি না! কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, সেখানকার স্থানীয়রাও প্রয়োজন ছাড়া নিজেদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না। যদিও কোনো সহযোগিতায় তারা সহজভাবেই এগিয়ে আসে। কিন্তু এর বাইরে না। তাই আমরা যারা পরিবারে বেড়ে উঠি কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার পরিবেশে থাকি, তাদের জন্য এমন আচরণ কিছুটা অদ্ভূত ঠেকবে।

তবে এ ক্ষেত্রে সমাধান হলো, কিছুটা সময় পর বেশ কিছু ভাল বন্ধু হয়ে যায়, অন্তত যাদের সঙ্গে সপ্তাহান্তে বের হওয়া, আড্ডা দেওয়া যায় হিসেব ছাড়াই। যেহেতু অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীই পড়তে যায়, তাই সহমর্মিতার জায়গা থেকে বন্ধুত্বটা স্বাভাবিকভাবেই গড়ে ওঠে।

আমরা যতই ইংরেজিতে অভ্যস্ত হই না কেন, কিছুটা পার্থক্য থাকেই। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই ছিল। এর ওপর একেক স্টেটের মানুষের কথা বলার ধরন, উচ্চারণ, এমনকি অর্থও ভিন্ন হওয়ায় পুরোপুরি বুঝতে আমাকে বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে ঠাট্টা করবার সময়ে। দেখা গেছে সহপাঠীরা মিলে কোনো গেট টুগেদারে দাঁড়িয়ে ঠাট্টার আলাপ হচ্ছে, অথচ আমি তার অর্থটা বুঝতে পারছি না। একবার ভাবুন তো, সেই পরিস্থিতে কেমনটা লাগার কথা! শ্রেণিকক্ষেও নানা দেশের অধ্যাপক থাকতেন। কেউ কোরিয়া, চীন, ইতালি থেকে এসেছেন। তাদের বলার ধরনও একেবারেই ভিন্ন। না ইংরেজি, না তাদের নিজস্ব ভাষা। তাই এমনও হয়েছে, কোনো ক্লাসে বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হয়েছে।

তবে এ ক্ষেত্রেও অধ্যাপক বা সহপাঠীরাও আসলে বুঝতে পারেন যে একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসেবে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা সহজভাবেই নিজের দায় স্বীকার করে নিতেন, তাই প্রশ্ন করার সুযোগ থাকতই। এ ছাড়াও ক্লাস শেষে প্রয়োজনে কথা বলে নেওয়া যেত। আমার এক সহপাঠী ছিল চীনের। দেখতাম, তার ইংরেজি কোনোমতে চালিয়ে নেওয়ার মতো হলেও তার গ্রেড বেশ ভালো। এর কারণটা হলো, সেখানে শুধু বলার ধরনকেই গুরুত্ব দেয়া হয় না। বরং কোনো একটা বিষয়ে কে কতটুকু পড়েছে, ভালো একটা গবেষণা করতে পারছে, এটাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ আমাদের দেশে ইংরেজি ভাষা নিয়ে যেই ধারণাটা রয়েছে আমেরিকায় তেমনটা নয়। বরং আমি বাংলাদেশি হিসেবে যে তাদের মতো বলতে-বুঝতে পারব না, এই বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া হয়।

এই বিষয়গুলো ছাড়াও থাকে খাবারে পরিবর্তন, সন্ধ্যা ৭টার পর আবাসিক এলাকাগুলোতে সবকিছু শুনশান হয়ে যাওয়া, কোথাও বিনা অনুমতিতে ছবি তোলা, কিংবা বড়দিন ছাড়া কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ছুটি না থাকা। হয়তো ঈদের দিন আপনাকে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হচ্ছে। এরকম ছোটখাটো বহু বিষয় রয়েছে যা একেকজনের কাছে একেবারে নতুন মনে হতে পারে। তাই যে দেশ বা স্টেটেই পড়তে যাওয়া হোক না কেন, সেখানকার সম্পর্কে ভালো মতো জেনে নেওয়া প্রয়োজন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আর আপনি যেখানে থাকবেন, দুটো কিন্তু ভিন্ন হবে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com