একে একে আমরা যখন জানতে পারলাম আমাদের মতো সমুদ্র সমান্তরাল দেশের আবহাওয়া পরিবর্তনের রুদ্ররোষ সামুদ্রিক সাইক্লোন থেকে বাঁচার প্রথম কাতারের সৈনিক হচ্ছে ম্যানগ্রোভ। পৃথিবীর প্রায় ৩৪০ প্রজাতির খাদ্য উপযোগী মিঠা জল ও লবণ জলের মাছের আঁতুড়ঘর হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র। প্রায় হাজারো বড় জীব, অণুজীব আশ্রয় নেয়, পুষ্টি পায় ম্যানগ্রোভের উদার উৎপাদনশীলতায়। একসময় জীববৈচিত্র্য বলতে একটা প্রতিবেশের সীমাবদ্ধ কিছু জীবজন্তু, গাছপালাকে বোঝাত। সেই অনুযায়ী ধরা হতো ম্যানগ্রোভের জীববৈচিত্র্য অন্যান্য জঙ্গলের চেয়ে অনেক সীমিত। আধুনিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ম্যানগ্রোভের জীববৈচিত্র্য অনেক মূল ভূখণ্ডের বনের চেয়ে সমৃদ্ধ। ম্যানগ্রোভের কার্বন সংরক্ষণ ক্ষমতা অন্যান্য জঙ্গলের চেয়ে দশ গুণ বেশি।
গ্রামীণ জঙ্গল ছাড়া বাংলাদেশে তিন ধরনের লক্ষণযুক্ত জঙ্গল আছে। শুকনা পাতা ঝরা শালের জঙ্গল, পূর্বাঞ্চলের মিশ্র বৃষ্টিপাতের জঙ্গল আর চিরহরিৎ ম্যানগ্রোভ জঙ্গল।
আমাদের যদি কঠোর সত্যির মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে স্বীকার করে নিতে হবে শালের জঙ্গল, মিশ্র বৃষ্টিপাতে জঙ্গলের ভবিষ্যৎ সংশয় আচ্ছাদিত। সেগুলো জঙ্গল বলতে ছেঁড়াখোরা খুবলে নেওয়া বনভূমির কঙ্কাল। শৃঙ্খলচক্র প্রায় পোকায় খাওয়া।
শালের বনভূমি নষ্ট হলে পঞ্চাশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় অনেকটা আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। মিশ্র বৃষ্টিপাতে বা রেইন ফরেস্টে শত শত বছরের চেষ্টায়ও ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু ম্যানগ্রোভ আয়ুষ্ময়ী। ফাঁকা হওয়া জঙ্গল ১৫ বছরের চেষ্টায় আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।
জীববৈচিত্র্যে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। তার পরই সুন্দরবনের অবস্থান। এককালে বাংলা অঞ্চলের গঙ্গার পুরো দক্ষিণ অঞ্চল ছিল ম্যানগ্রোভ বনে আচ্ছাদিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত এখনকার সুন্দরবনের এলাকার চেয়ে দ্বিগুণ এলাকায় বাদা জঙ্গল ছিল। ব্রিটিশ সরকার ক্লদ রাসেন নামের একজনকে বন কেটে কৃষিজমি উদ্ধারের দায়িত্ব দেয়। তাঁর প্রচেষ্টায় সুন্দরবন আজকের হালে পৌঁছেছে। আমাদের টেকনাফ অঞ্চলে, চকোরিয়ায় বেশ সমৃদ্ধ ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ছিল। গত শতাব্দীর আশির দশকে বন বিভাগের কর্মতৎপরতায় উপকূলীয় বেষ্টনীর নামে চমৎকার বনভূমি গড়ে তোলা হয়েছিল। নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে ঢুকলে মনে হতো সুন্দরবনে ঢুকেছি। এখন সেসব অতীত হয়ে গেছে।
চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের মারাত্মক কুফল ফলতে শুরু করেছে। ভয়ংকর বিষে মাছ-চিংড়ি মারতে গিয়ে শতাধিক প্রজাতির জীবসত্তাকে বিলুপ্তির পথে টেনে নেওয়া হচ্ছে। অথচ আমাদের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল একমাত্র বাঘের জঙ্গল, এত হরিণও আর কোনো ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে নেই। এখানে জঙ্গল সীমানার মধ্যে চার রকম ডলফিন-পরপয়েজ দেখা যায়।