অনেক দিনের ইচ্ছা, মেঘের রাজ্য দর্শনে যাব। বছরের শুরুতে পাসপোটের্র আবেদন করি। জুন মাসে আমার ভিসা কনফার্ম হয়। ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে বাল্যবন্ধু জার্মান প্রবাসী আরিফ। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে আরিফ বাংলাদেশে আসে আর ভারতীয় ভিসা করে জার্মানি ভারতীয় দূতাবাস থেকে। আমরা ১৫ আগস্ট ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতে প্রবেশ করব বলে সিদ্ধান্ত নেই।
১৪ আগস্ট রাতে আমরা ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহনে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ভোরে সিলেট মাজার জিয়ারত করে টেম্পোযোগে ৭০০ টাকা ভাড়ায় তামাবিল বর্ডারে পৌঁছাই। সেখানে সকাল ৯টার পর দুই বর্ডারের যাবতীয় ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শেষ করে দুপুর ১১:৩০ মিনিটে ইমিগ্রেশন অফিসের সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করি মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম শামসুল হক (অসম প্রবাসী)। চমৎকার বাংলায় কথা বলে। কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পারি তিনি যথেষ্ট মিশুক প্রকৃতির ও আমুদে একজন মানুষ। তার সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয় যে তিনি আমাদের ভারতের সবচেয়ে স্বচ্ছ জলের নদী উমাংগট, বোরহিল ফলস (বাংলাদেশে যাকে পান্থুমাই ঝর্ণা বলে), পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং এবং তার পাশেই অবস্থিত লিভিংরুট ব্রিজ (জীবিত গাছের শিকড় দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি সেতু) দেখিয়ে তারপর শিলংয়ের প্রধান কেন্দ্রস্থল পুলিশবাজার নিয়ে যাবে। বিনিময়ে তাকে আমরা ২ হাজার ৫০০ রুপি দেব।
যে কথা সেই কাজ। প্রথমেই আমরা সোনাংপেডেং গ্রামের উমাংগট নদীতে গেলাম। বর্ডার থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্বে এটি। নদীর পানি যথেষ্ট ঠা-া ও নদীর ওপর যে ঝুলন্ত সেতু আছে তার ওপর থেকে দেখলে নদীর গভীরের পাথরগুলোও দেখা যায়। এই নদীটি পৃথিবীর দ্বিতীয় স্বচ্ছ জলের আধার বলে বিবেচিত। নদীতে গোসলের পর আমরা বোরহিল ঝর্ণা দেখে মাওলিননং গ্রামে যাই। যেতে লাগে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। এই গ্রামকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর ফুলের গাছে সাজানো পুরো গ্রামটি। কোথাও কোন ময়লা-আবর্জনা নেই। একটু পর পর বাঁশের ঝুড়ি রাখা আছে ময়লা ফেলার জন্য। এই গ্রামে ময়লা তো দূরের কথা, ধূলিকণার অস্তিত্বও নেই। গ্রামের পাশেই প্রায় ২০০ সিঁড়ি নিচে নামলে গাছের শিকড় দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি সেতুটি চোখে পড়ে। এটি দেখলে মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসাই করতে হয়। এই গ্রামেই একটি ব্যালেন্সিং রক বা ‘ভারসাম্য পাথর’ আছে। বিশাল পাথর একটি ছোট খুঁটির ওপর দাঁড়ানো। খুবই অদ্ভত। না দেখলে বিশ্বাস হয় না। দেখতে দেখতে প্রায় দুপুর ৩টা বেজে যায়। আমরা এই গ্রাম থেকে কিছু খাবার কিনে গাড়িতে বসেই লাঞ্চটা সেরে নেই। লাঞ্চের পর আমাদের গাড়ি রওনা হয় শিলংয়ের উদ্দেশ্যে।
চমৎকার সুন্দর মসৃণ রাস্তা। কোন জ্যাম নেই। পাহাড়ের গা ঘেঁষে প্রায় দু’ঘণ্টা চলতে থাকে আমাদের গাড়ি। পাশেই প্রায় আড়াই হাজার ফুট গভীর খাদ বা ক্যানিয়ান। ভুলক্রমে চাকা হড়কে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না আমাদের অস্তিত্ব। সন্ধ্যার কিছুপর আমরা পুলিশবাজার চৌরাস্তায় এসে পৌঁছাই। আমাদের ড্রাইভার শামসুল ভাইকে বলে দেই তিনি যেন পরদিন সকাল ঠিক ৭টায় এখানেই অপেক্ষা করেন। তারপর ট্যাক্সি থেকে নেমে আমরা চৌরাস্তা থেকে একটু ভেতরে ১ হাজার রুপিতে একটা হোটেলে রুম ভাড়া নেই। রুমে একটু ফ্রেশ হয়ে আবার পুলিশবাজার চৌরাস্তায় চলে আসি। সেখানে বসেছে প্রায় শ’খানের স্ট্রিটফুডের দোকান। চিকেন থেকে শুরু করে হাজারো ভাজা-পোড়া জাতীয় খাবার পাওয়া যায় এখানে। তবে খাবার কেনার আগে একটু সাবধানে দেখে-বুঝে খাবার কিনতে হয় কারণ এখানকার বেশিরভাগ খাবারে শূকরের মাংস ব্যবহার করা হয়। যাহোক স্ট্রিটফুড খেয়ে আমরা একটা বাঙালী হোটেল খুঁজে বের করে সেখানে ভাত-মাছ খাই। খাবার বিল মিটিয়ে আমরা রুমে চলে আসি কারণ সেখানে সন্ধ্যার পর প্রচুর কুয়াশা পড়ে। শীত পড়ে যথেষ্ট। হোটেলে সটান হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেই।
পরদিন সকাল ৭টার মধ্যে আমরা পুলিশবাজার চলে আসি। সেখানে পরোটা-ডিম দিয়ে নাস্তা সেরে ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুক্ষণ পরই শামসুল ভাই গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। আমার তাকে প্রথমেই লাইটলুম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ান যেতে বলি। এটি মেঘালয়ের অন্যতম বড় একটি ক্যানিয়ান। প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা সেখানে পৌঁছাই। এটা একটি আশ্চর্য জায়গা। এই কুয়াশা, এই রৌদ্র। কোন ধারাবাহিকতা নেই এই মেঘ-রোদের খেলার। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্যানিয়ানে আমরা এর গভীরতাটাই দেখতে পারিনি। কারণ কুয়াশার কারণে দুই হাত সামনের বস্তুও দেখা যাচ্ছিল না। যদিও পরবর্তীতে চেরাপুঞ্জিতে আমরা আরও কয়েকটি ক্যানিয়ান দেখেছিলাম। যাহোক, লাইটলুম থেকে আমরা বিখ্যাত এলিফ্যান্ট ফল্স দেখতে গেলাম। এই ঝর্ণা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিছুদিন আগেই ঘুরে গেছেন। তার ছবিও এখানে আছে। সফেদ ফেনার মতো ধারায় পানি প্রবাহিত হয় বলে ঝর্ণাটির রূপ এক কথায় অনন্য। এই ঝর্ণা দেখতে হলে আপনাকে ৩০ রুপি দিয়ে টিকিট কাটতে হবে। ফলস দেখে আমরা শামসুল ভাইকে বললাম যে, চেরাপুঞ্জি (পূর্বের নাম সোহরা) যাব- চলেন। তিনি বললেন, যেতে যেতেই দুপুর গড়িয়ে যাবে। তাই পথেই লাঞ্চ সারতে হবে। আমরা বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না, গাড়ি দ্রুত টেনে চলেন। শামসুল ভাই ঝড়ের বেগে চেরাপুঞ্জির দিকে গাড়ি ছুটাল। পাহাড়ী রাস্তায় প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা যাবার পর দুপুর ২:৩০ মিনিটের দিকে আমরা একটা হোটেলে থামলাম। সেখানে কাসার থালায় ছোট ছোট বাটিতে পাপড়, ডাল, শাক, মাছ ও পায়েস দিয়ে পেটপুরে ভাত খেলাম। খেয়েই রওনা হলাম চেরাপুঞ্জির নোহকালিকাই ফলস দেখতে। এই ফল্স ১,১১৫ ফুট গভীর।
এটা দেখতেও টিকেট কাটতে হয়। নোহকালিকাই ফলস দেখে রওনা হলাম চেরাপুঞ্জির আরেক বিষ্ময় মোসমাই কেইভা বা মোসমাই গুহা দেখতে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলে একটা ছমছমে অনুভূতির সৃষ্টি হয়। খুবই ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে হলেও পিছল নয় একটুও। যাহোক প্রায় ১৫ মিনিটে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে আমার সিদ্ধান্ত নিলাম পড়ন্ত বিকেলটা কাটাব চেরাপুঞ্জির আরেক বিস্ময় সেভেন সিস্টার ফল্স দেখে। কারণ এই মোসমাই গুহা থেকে মাত্র ১৫ মিনিটেই সেভেন সিস্টার ফল্সে যাওয়া যায়। এই ফল্সে একসঙ্গে সাতটা ধারায় পানি প্রবাহিত হয় এবং এটি ২৩০ ফুট গভীর। ফলসটি রাস্তার পাশে বিধায় কোন টিকেট কাটতে হয় না। ফল্সটি দেখে আবার পুলিশবাজার আসতে আসতে রাত প্রায় ৮টা। ২ হাজার রুপি ভাড়া মিটিয়ে শামসুল ভাইকে পরের দিন সকাল ৮টায় একই স্থানে আসতে বললাম। তারপর সেই আগের হোটেলেই ডিনার সেরে ক্লান্ত শরীরে হোটেলে এসে লম্বা ঘুম।
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে ঠিক ৮টায় আমরা ডাউকি (বাংলাদেশে এই বর্ডারকে তামাবিল বলে) বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথিমধ্যে মেঘ পাহাড়ের কিছু ছবি আমরা তুলে নেই। সকাল ১১টার দিকে আমরা বর্ডারে পৌঁছে শামসুল ভাইকে ১ হাজার ৭০০ রুপি ভাড়া প্রদান করি। এরপর আবারও দু’পাশের ইমিগ্রেশন শেষ করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেই।