বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

মেঘের উপত্যকা সাজেক

  • আপডেট সময় বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই। সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য। আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ কঠিন পাহাড়।  একেবারে চূড়ায়, মাথার খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুল পৃথিবী, চরাচরে তীব্র নির্জনতা।’ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এ লেখকের কবিতার পঙিক্ত যেন উঠে এসেছে লাল পাহাড়ের মেঘের উপত্যকা সাজেক ভ্যালির কথা। চারদিকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি। তুলোর মতো উড়ে যাওয়া মেঘ আর এর মাঝেই যেন মাথা উঁচু করে ঠাঁই নিয়ে ‘সাজেক ভ্যালি’।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতার নৈসর্গিক সাজেক ভ্যালি যেন অপার সৌন্দর্যের আধার। আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়ি। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে বহুল আলোচিত বাঘাইছড়ি উপজেলার আয়তনে সবচেয়ে বড় ইউনিয়নও সাজেক ইউনিয়ন। ৬৮৪ বর্গকিলোমিটারের সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই থেকে কংলাক পাহাড়—দুটো পাহাড় ঘিরেই মেঘের উপত্যকা সাজেক ভ্যালি। ২০১৩ সালের দিকে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে নয়নাভিরাম সাজেক ভ্যালিতে পর্যটন রিসোর্ট গড়ে তোলার পর দেশে-বিদেশে সুখ্যাতি পেয়েছে সাজেকের রুইলুইপাড়া। তবে ক্রমান্বয়ে সাজেকের সৌন্দের্যের প্রবাহে দুই-আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কংলাক পাহাড়ে এখন গড়ে উঠেছে নানা রিসোর্ট-কটেজ।

ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী এলাকা রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালি নামে পরিচিত এই উপত্যকা ২০১৪-১৫ সালের পর থেকেই মূলত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একসময়ে বেসরকারি উদ্যোগে আট-দশটি রিসোর্ট-কটেজ গড়ে উঠলেও এখন সাজেক প্রায় শখানেক রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে। চা বাগানের অঞ্চল সিলেট আর সমুদ্রপাড়ের শহর কক্সবাজারের মতো দিনে দিনে দেশের পর্যটনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সাজেক ভ্যালি। বছরের ১২ মাসই সাজেকে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে; তবে ভ্রমণপ্রেমী মানুষের বাড়তি চাপ থাকে মূলত শীতকালে। শীতের সকালে, কুয়াজাভেজা ভোরে সুন্দরী সাজেকের রূপ যেন কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সাজেক উপত্যকায় মেঘের টেউ খেলানো কিংবা উড়ে যাওয়ার দৃশ্য বরাবরই মতোই প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে টানে; তাই সারা বছরের চেয়ে শীতকালেই সাজেক উপত্যকায় পর্যটকদের ভিড় থাকে।

রুইলুই পাহাড় থেকে কংলাকচূড়া পর্যন্ত এ সড়কের দুপাশ ঘেঁষেই বিগত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রিসোর্ট-কটেজ। সাজেক চূড়া থেকে তাকালেই চারদিকে বিস্তীর্ণ পাহাড়।  সাজেক ভ্যালিতে মূলত লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বাস। কালের বিবর্তনে দূর পাহাড়ের সাজেক দেশে-বিদেশে সৌন্দর্যের জুড়িতে সমাদৃত হলেও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষের জীবনমান তেমন একটা বদলায়নি। দেশের পর্যটন শীর্ষের দিকে অবদান রাখলেও সাজেকের প্রত্যন্ত গ্রামের পাহাড়ি মানুষের ভ্যাগ বদলায়নি। ইকো-ট্যুরিজমের পরিবর্তে দিনে দিনে অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সৌন্দর্য হারাতে বসেছে সাজেক ভ্যালি। আর উদ্যোক্তা হিসেবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চেয়েও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান এখানে উদ্যোক্তা হয়ে পড়ায় ও পরিবেশগত জীববৈচিত্র্যকে অপ্রাধান্য দেয়ার বদৌলতে সুন্দরী সাজেকের রূপ ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়ের পরিবেশবাদীরা মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখতে ইকো-ট্যুরিজমের প্রসারতা দরকার। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মানুষকে যদি পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায় সেক্ষেত্রে প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈচিত্র্য বজায় থাকবে পাশাপাশি পর্যটকরা পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগে আরো আগ্রহী হয়ে উঠবেন।

রেস্টুরেন্টনির্ভর গড়ে উঠেছে রাঙ্গামাটির পর্যটনকেন্দ্র : গত এক দশকে স্থানীয় পর্যটন শিল্পে যে কিছু উদ্যোগে পর্যটনকেন্দ্রের সৃষ্টি হয়েছে সেটি কেবল রেস্টুরেন্টনির্ভর। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের সঙ্গ দিয়েছে সুবিশাল নয়নাভিরাম কাপ্তাই হ্রদ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তি চুক্তি) সম্পাদন পরবর্তী সময়ে অনেকটাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসে পাহাড়ে। চুক্তি-পরবর্তী সময়ে প্রথম ধাপে কাপ্তাই হ্রদের মাঝখানে এক ছোট্ট চরে ব্যক্তি পর্যায়ে ‘পেদা টিং টিং’ নামক একটি রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান।  রাঙ্গামাটির পর্যটনে এটিই পর্যটনের বিকাশের সুন্দরতম যাত্রা। তবে বিগত এক দশকে রাঙ্গামাটি সদরে বেশকিছু পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যার প্রায় সবক’টি রেন্টুরেন্টনির্ভর। জেলা শহরে পুলিশের পলওয়েল পার্ক, পর্যটন করপোরেশনের ঝুলন্ত সেতু, জেলা প্রশাসনের রাঙ্গামাটি পার্ক ও সেনাবাহিনীর আরণ্যক ছাড়া রেন্টুরেন্ট নির্ভরতা ছাড়া উল্লেখজনক তেমন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ‘পেদা টিং টিং’ চালুর পর আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কের পাশে যেসব রেস্টুরেন্ট নির্ভরশীল পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে যেগুলোর মধ্যে বেরান্নে, বড়গাঙ, ইজোর, বার্গী লেকভ্যালি অন্যতম। এছাড়া আসামবস্তিতে গাঙ সাবারাং, কাপ্তাই হ্রদের চরে চাংপাং, জুমঘর, শহরের রাঙাপানি এলাকার কেজিআর অন্যতম।

রাঙ্গামাটির পর্যটন শিল্পে ব্যক্তি উদ্যোক্তা পর্যায়ের বেশকিছু সংকটের কথা তুলে ধরেছেন উদ্যোক্তা সুমেত চাকমা। ২০১৬ সালের দিকে তিনি বড়গাঙ নামক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। পরবর্তী সময়ে এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন তার আরো ছয়জন বন্ধু। সাত বন্ধু মিলে বড়গাঙ প্রতিষ্ঠা করেন। সবশেষ গত বছরের শেষ দিকে চারজন মিলে আবারো যাত্রা শুরু করেন বার্গী লেকভ্যালির। যে বার্গীতে বর্তমানে ১৮ জন যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বণিক বার্তার সঙ্গে আলাপকালে সুমেত চাকমা জানিয়েছেন, পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে বৃহৎ পরিসরে নামতে হয়। কিন্তু পুঁজি সংকটের কারণে আমরা প্রথম ধাপে রেস্টুরেন্টকে নির্ভর করেই প্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগ নিই।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com