বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৪ পূর্বাহ্ন

‘মুগ্ধকর’ আন্দামান

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০২৩
Holiday.

পৃথিবীর যে কত রং, কত রূপ, কত-শত বিশেষত্ব—তা কি সহজেই বোঝানো যাবে? সম্ভব না। ইচ্ছে হয় ছুটে যাই এমন কোথাও, যেখানে দু’দন্ড শান্তি মিলবে, নিরেট আনন্দ মিলবে। তাহলে যেতে পারেন ‘আন্দামান’!

তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই চলে গেলাম আন্দামান৷ সেলুলার জেল-খ্যাত ও নীলাভ-সবুজ রঙের জল-খ্যাত এই জায়গার কথা শুনলে ‌‘না’ বলা যায় কিভাবে তা আমার জানা নেই। কলকাতা থেকে আন্দামান ঠিক দুই ঘণ্টার ফ্লাইট! কাছাকাছি পৌঁছাতেই বিমানের জানালায় চোখ রেখে দেখা যায় অদ্ভুত নীল জলরাশি। ওইতো আন্দামান! পৃথিবীর আদিমতম আদিবাসীদের দেশ, কালাপাহাড়ের দেশ! সকালের রোদে চিকমিক করতে থাকা গোটা আন্দামানে চোখ জুড়ে খেলা করবে রাজ্যের বিষ্ময়! পৃথিবীটা এতটা সুন্দর কেন? জীবনটা এত আশ্চর্যময় কেন!

তবে জানা গেল, এই দ্বীপ অঞ্চলের প্রয়োজনীয় মালপত্রের বেশিরভাগই জাহাজেই পৌঁছায়৷ কিন্তু অসম্ভব ঝড়ো ভ্রমণের মধ্যেও যেটা টের পাওয়া গেল, তা হল আন্দামান অত্যন্ত ব্যয়বহুল এক জায়গা৷ যদিও তার ব্যাখ্যা হিসেবে এখানকার লোকজনেরা বলে থাকেন— এখানকার যা কিছু তা সবই অন্য রাজ্য থেকে আনতে হয়, তাই সবকিছুতেই টাকা একটু বেশি গুনতে হয়৷ যে হোটেলে ছিলাম সেখানকার কর্মচারিরা জানালো, কলকাতায় আলুর কেজি ১০ টাকা হলে এখানে ৫০ টাকা!

মেগাপট ও হর্নবিল নামের দুটি দৃষ্টিনন্দন হোটেল রয়েছে পোর্টব্লেয়ারে। এই দুই হোটেলেই যদি ডিম দিয়ে কারি খেতে চান দাম পড়বে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা! তাও তো পোর্টব্লেয়ার রাজধানী। এখানে সরকারি অতিথিশালায় আতিথ্য গ্রহণ করলে প্রাতরাশে ডিম কমপ্লিমেন্টারি মিলবে। কিন্তু পোর্টব্লেয়ার থেকে ‘অবশ্য গন্তব্য’ হ্যাভলক দ্বীপের সরকারি অতিথিশালায় আতিথ্য নিলে প্রাতরাশ কমপ্লিমেন্টারি হলেও ডিম সেদ্ধ কিংবা পোচ কিংবা অমলেট কিনে খেতে হবে। কেন এতবার দামের উল্লেখ করছি সে কথায় আসছি! তবে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই দূরের অবস্থানের কারণেই কি এত দাম? যদিও কেউ প্রশ্ন করে না, কারণ টাকা খরচ করতেই তো মানুষ এখানে আসে!

সুরমা মাছ হচ্ছে এই দ্বীপের সবচেয়ে সম্মানী মাছ। জনপ্রিয় মাছে তালিকায় আরো আছে অ–কুলীন জোনা মাছ। কিন্তু তার স্বাদ-টাদ নিয়ে কোনো কথা না বলাই ভালো৷ এর দামই কেজি প্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। যে ড্রাইভার আমাকে ঘুরিয়েছে, সে বললো, শসা, আনারস আর পেঁপে ছাড়া কিছুই নেই আমাদের এখানে। ধান চাষও হয় না খুব একটা। সব আসে চেন্নাই বা কলকাতা থেকে।

যেতে হবে রাধানগর সৈকত। এশিয়ার সেরা সমুদ্রতটে কী না আছে! আরো নিখুঁতভাবে বললে- হ্যাভলক দ্বীপের সৌন্দর্যে মোহিত হবে না এমন মানুষটি পাওয়া দুষ্কর। রহস্যময় সুন্দর এই দ্বীপটিতে যেতে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে রওনা করতে হয় প্রাইভেট ফেরিতে। খরচ ৭০০ থেকে শুরু করে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত, ফেরির কোয়ালিটির উপর নির্ভর করে। মোটামুটি দুই-আড়াই ঘণ্টার জার্নি। পৌঁছে দেখতে পাবেন প্রবাল ঘেরা সৈকত। একটা থেকে আরেকটা দ্বীপে যেতে হবে ছোট ছোট জাহাজে করে। আর এই জাহাজে করে যাবার পথে সমুদ্রের সৌন্দর্যকে নানানভাবে আবিষ্কার করা যায়। কখনো সমুদ্রের জলের রঙের পরিবর্তন দেখে অবাক হবেন- কোথাও নীল, কোথাও সবুজ। আবার কখনো মন ভালো করে দেয়া আকাশই নিশ্চিত! সবুজের সমাহারে হারিয়ে যেতে পারেন চোখ জুড়ানো এলিফ্যান্ড বিচে। কালাপাথর বিচেও ঘুরে আসতে পারেন সেই সঙ্গে!

চারদিকে গভীর সমুদ্র। জলের অসামান্য বর্ণ বৈচিত্র্য আর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু একই সঙ্গে মূল ভূখণ্ড থেকে যাতায়াত যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য বলে এখানে তারাই আসতে পারেন যাদের বেড়াতে গিয়ে হিসেব করার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। ভারতের বাকি পর্যটন কেন্দ্রগুলো থেকে আন্দামান আরেকটি বিষয়ে স্বতন্ত্র। এখানে যারা বেড়াতে আসেন তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষ আসেন ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে। ফলে দু’বেলা খাবার বা ঘোরার অর্থ যেহেতু তারা আগেই গচ্ছিত করে দেন, এখানকার অস্বাভাবিক দামের ব্যাপারটি তারা তেমন ভাবে বুঝে উঠতে পারেন না। আসলে এখানে এটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে‍ যে, ফুলকপির তরকারির দাম দুইশ টাকা! কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো স্থানীয়দের জন্য জিনিসপত্রের দাম আবার অন্যরকম। অর্থাৎ একই জিনিসের দু’রকম মূল্যের বাজার রয়েছে আন্দামানে।

দামের কথা চিন্তা না করে ঘোরা দরকার! পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে দেখতে পারেন লং আইল্যান্ড। ডলফিনের খেলা, পরিচর্যা কখন, কীভাবে করা হয়- এসবের দেখা মেলে কত সহজেই। বিখ্যাত সেলুলার জেলও দেখে আসা যায় একনজর। ব্রিটিশদের শাসনামলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই সোজা নির্বাসনে পাঠানো হতো এই দূরদ্বীপে। তারপর তাদের ওপর নেমে আসতো সীমাহীন অত্যাচার। ইতিহাসের এসব অভিনব গল্পের সাক্ষী হতে চাইলে পোর্ট ব্লেয়ারের এই জেল না দেখে আসা চলবে না।

কোরাল ও মাছের জগতে প্রবেশের সুযোগ এখানে এসে হাতছাড়া করে না কেউই। স্নোরকেলিং বলা হয় একে। আমাদের সেন্টমার্টিনেও এই সুবিধাটা আছে। গাইড সঙ্গী হাত ধরে নিয়ে গেল যেখানে রয়েছে কোরালের বেশি বেশি উপস্থিতি সেখানে। জলের নিচে মাথা ডুবিয়ে দেখবেন এক বিস্ময়কর জগত। এত রং! এত রহস্য! এতটা সুন্দর! দেখবেন মৃত ও জীবন্ত কোরালের সমাহার। চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রঙের মাছ। মনে হয় যেন চুমু খাবে এসে। এসব যতোই দেখবেন ততোই নেশা! আশ আর মিটবে না। তবে আশ মিটিয়ে স্নোরকেলিং বা স্কুভা ডাইভিং- যাই করেন না কেন, নিজের পকেটের দিকেও যে নজর রাখতে হবে! ২৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকা হয় মিনিট পনেরর জন্য!

বলতে না চাইলেও বার বার এই টাকার কথা ওঠার কারণ একটাই। সাধারণ মানুষের বেড়াতে‍ আসার জন্য নয় আন্দামান। অতএব যা হয়, ভাত থেকে শুরু করে স্নোরকেলিং— সবকিছুতেই অদৃশ্য আগুনের উত্তাপ। দামের উত্তাপ। মাত্র তিন রাত ঘুরে একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, এখানকার মানুষজন শান্তিপ্রিয়। খরচ যতই হোক না কেন, এখানকার মানুষ জানে এই বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে পর্যটক আসবেই সৌন্দর্যের টানে এবং ফিরে যাবে অপূর্ব সবুজ বনরাজি আর বর্ণময় সমুদ্রের স্মৃতি নিয়ে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com