তিয়াসকে দেখেই অর্পিতার মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, কোথায় ছিলে তোমরা? অর্পিতা কোথায়, তুমি একা কেন? অর্পিতা কি বেঁচে নেই!’
নানান প্রশ্ন রুফাইদা বেগমের।
হবু শাশুড়ির প্রশ্নের উত্তর জানা থাকা সত্ত্বেও জবাবটা সহজেই দিতে পারছে না তিয়াস। চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে। কীভাবে বলবে অর্পিতা স্রোতের টানে ভেসে গেছে, কথাটা মুখেও আনতে পারছে না তিয়াস।
অর্পিতার মা দুর্যোগের পর থেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন মেয়ে আর হবু জামাতা ফিরে না আসায়। অর্পিতার বাবা মোবাশ্বের আলী লোকমুখে শুনেছেন ছেঁড়া দ্বীপের ভয়াবহতার কথা। হোটেলে এসে ঘটনাটার বিস্তারিত জানিয়েছেনও অর্পিতার মাকে। সব শুনে তিনি ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছে তার, কথাবার্তাও ঠিকমতো বলতে পারছেন না। কেঁপে কেঁপে কথা বলছেন আর মাঝ মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠছেন।
প্রলয়ঙ্করী সুনামির তাণ্ডবলীলার সময় আলী দম্পতি হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। তারা যে হোটেলে অবস্থান করেছেন, সেই হোটেলটা সৈকত সংলগ্ন বিধায় দুর্যোগের হিংস্রতা সরাসরি দেখেছেন। বিশেষ করে যখন জানতে পেরেছেন ছেঁড়া দ্বীপ সেন্টমার্টিন থেকে অনেকটা নিচু এলাকায়, তখনি অমঙ্গলের চিন্তা মাথায় ঢুকেছে। বিষয়টা পরিষ্কার হওয়ার পর থেকেই দু’জনের নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে।
ঘটনার দিন সমুদ্র শান্ত হতেই অর্পিতার বাবা-মা দ্রুত ছেঁড়া দ্বীপ গিয়েছেন অর্পিতাদের খোঁজখবর নিতে। দ্বীপে যাওয়ার পর বোট চালকেরা জানিয়েছে, দুর্যোগের তাণ্ডবে দুই-একজন ছাড়া বাকি সব পর্যটক সাগরে হারিয়ে গেছেন। ওদের কথায় এক প্রকার নিশ্চিত হয়েছেন, তিয়াস-অর্পিতার পরিণতি নিয়েও। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নিশ্চিত করেছে, ছেঁড়া দ্বীপের পর্যটকদের অধিকাংশই নিখোঁজ রয়েছেন। এই নিখোঁজ শব্দের অর্থ আলী দম্পতির অজানা নয়। তারপরও তারা সেন্টমার্টিন ত্যাগ করেননি। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখানে আরও কিছুদিন থাকবেন, যদি কোনো সুখবর পাওয়া যায় সেই প্রত্যাশায়। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও ভালো কোনো খবর পাননি। এখন যে করণীয় কিছু নেই, তাও তারা বুঝতে পেরেছেন। এমতাবস্থায় শোকের সাগরে ভাসতে লাগলেন দু’জন। তার ওপর সিদ্ধান্তহীনতায়ও ভুগছেন দ্বীপে থাকবেন, না কি ঢাকায় চলে যাবেন। কারণ তারা ভালো করেই জানেন, সেন্টমার্টিন ত্যাগ করার মানে হচ্ছে পরবর্তীতে আপডেট কোনো সংবাদ জানতে না পারা। অবশ্য এখানে থাকলেও যে ভালো সংবাদ পাবেন এমনটাও প্রত্যশা করছেন না। তারপরেও সান্ত্বনা তিয়াস-অর্পিতা হারিয়ে গেলেও ওদের কাছাকাছি আছে। এদিকে হোটেলের লোকজন এসেও তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন বারবার। তারা জানিয়েছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে হোটেল মালিকদের জানানো হয়েছে, দুর্যোগের শিকার হয়েছেন এমন পর্যটক পরিবারদের বিনা ভাড়ায় হোটেলে রাখতে। সেই মোতাবেক এখানকার প্রতিটি হোটেলে পর্যটক পরিবারের লোকজন যতদিন খুশি ততদিন থাকার সুযোগ পাবেন। বিষয়টা মাইকিং করেও নিশ্চিত করেছে প্রশাসন।
অর্পিতার বাবা মোবাশ্বের আলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যতদিন পর্যন্ত না নিশ্চিত হচ্ছেন, অর্পিতারা বেঁচে নেই, ততদিনই সেন্টমার্টিন থাকবেন। ভালো-মন্দ যেকোনো সংবাদই হোক না কেন, নিশ্চিত হয়েই সেন্টমার্টিন ত্যাগ করবেন। তাই তিনি ক্ষণে ক্ষণে যোগাযোগও রাখছেন উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে।
আলী দম্পতি যখন শোকে মুহ্যমান, ঠিক তখনই আলো হাতে আঁধারের যাত্রী হয়ে হোটেলে হাজির হলো তিয়াস। ওকে দেখে যতটা না খুশি হয়েছেন হবু শাশুড়ি, তারচেয়ে বেশি নিশ্চিত হয়েছেন অর্পিতা বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে তিয়াসের সঙ্গে মেয়েকেও দেখতে পেতেন।
বারান্দায় কান্নাকাটি শুনে অর্পিতার বাবা রুম থেকে বাইরে এলেন। তিয়াসকে দেখেই তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘আমার মা কোথায়? তুমি একা কেন বাবা!’
কোন জবাব নেই তিয়াসের। সে চুপচাপ থাকতেই মোবাশ্বের আলী নিশ্চিত হয়েছেন অর্পিতা বেঁচে নেই। বিষয়টা বুঝতে পেরে তিনিও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। শোক সইতে না পেরে অর্পিতার মা মেঝেতে কাত হয়ে পড়লেন। আলী দম্পতির অবস্থা বেগতিক দেখে তিয়াস চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আঙ্কেল, আপনারা শান্ত হোন। আমার কথা শুনুন। অর্পিতা বেঁচে আছে, সাগরে ভাসছে এখনো। ওকে উদ্ধার করতে হবে। ’
তিয়াসের কথা শুনে মোবাশ্বের আলী হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। কী বলছে ছেলেটা এসব, ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেন না। মাথা ঠিক আছে তো ছেলেটার! না কি অর্পিতার শোকে ওর মাথাটাও এলোমেলো হয়ে গেছে। এমন বিস্মিত সংবাদ শুনে কিছুক্ষণ তিয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে মোবাশ্বের আলী বলল, ‘কী বলছো যা-তা; তোমার মাথা-টাথা ঠিক আছে তো? গল্প শোনানোর সময় কিন্তু এখন নয় বাবা। সান্ত্বনা দিতে চাচ্ছো ভালো কথা, তাই বলে এমন সান্ত্বনাই দেবে তুমি!’
‘না আঙ্কেল, সান্ত্বনা নয়, যা বলছি সত্যিই বলছি। আগে সব ঘটনা শোনেন। তারপর যা ইচ্ছা বলবেন। তাছাড়া আমি মানসিকভাবেও ঠিক আছি, বানোয়াট কিছু বলছি না। একটু ধৈর্য ধরুন প্লিজ। ’
মোবাশ্বের আলী বুঝতে পারলেন তিয়াস ঠিক আছে, গুছিয়ে কথা বলছে। মানসিক ভারসাম্য হারালে গুছিয়ে কথা বলতে পারত না। ওর কথায় বিশ্বাস রাখা যায়। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘বলো বাবা, জলদি খুলে বলো। আমি জানি তুমি সত্য কথাই বলবে। অর্পিতা যে, সাগরে ভাসছে এখনো ওটা কার কাছে শুনেছো; তুমি কি নিজে দেখেছো?’
‘আমি নিজেই দেখেছি। ও আমার সঙ্গেই ছিল। ’
মোবাশ্বের আলী নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করছেন। এই মুহূর্তে শান্ত হতে না পারলে মাথায় কিছু নিতে পারবেন না। তাই তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি একটু স্বাভাবিক হতেই তিয়াস ধীরে ধীরে সব ঘটনা খুলে বলল। একেবারে সুনামির শুরু থেকে ওর নিজের উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত কিছুই বাদ রাখেনি আর। সবশুনে মোবাশ্বের আলী হতভম্ব হয়ে গেলেন। উন্মাদের মতো আচরণ করতে লাগলেন। অর্পিতা মরে গেলে ভিন্ন কথা ছিল। কিন্তু দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করে বেঁচে আছে এখনো, ব্যাপারটা ভিন্ন রকম লাগছে তার কাছে। বিষয়টা খুশির সংবাদ হলেও শুনে প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গেল মোবাশ্বের আলীর। একে তো কন্যা সন্তান, তার ওপর সমুদ্রে ভাসছে, বিষয়টা তাকে ভীষণভাবে পোড়াতে লাগল। এমতাবস্থায় প্রতি মুহূর্তেই অর্পিতার সমুদ্রে ভেসে থাকার দৃশ্য মোবাশ্বের আলীর চোখের সামনে ভাসতে লাগল।
মোবাশ্বের আলী দরদর করে ঘামছেন। রীতিমতো কাঁপছেন তিনি। এক পর্যায়ে কাঁপতে কাঁপতে উচ্চস্বরে বললেন, ‘লাইফ জ্যাকেট পরা থাকলে অর্পিতা নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। অর্পিতার মা শুনছো, তোমার মেয়ে বেঁচে আছে। ওকে উদ্ধার করতে হবে এখুনি। ’
স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে তিয়াসের উদ্দেশে বললেন, ‘আমার মাথায় কিছুই ধরছে না, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করো অর্পিতাকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়। ’
তিয়াস বলল, ‘আঙ্কেল, আমি একটা পরিকল্পনা করেছি, শুনবেন?’
‘শোনাও। ’
‘যেহেতু অর্পিতাকে দেখেছি চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যেতে। কথাও বলেছে সে আমার সঙ্গে। তার মানে অর্পিতা বেঁচে আছে। আমি নিজে দেখেছি ওকে দক্ষিণ দিকে ভেসে যেতে। আমার বিশ্বাস এভাবে ভেসে গেলে বঙ্গোপসাগরের কোনো না কোনো দ্বীপে সে আছড়ে পড়বেই। অথবা মাছ ধরার ট্রলারেও আশ্রয় পেতে পারে। সমুদ্রের ঢেউ সাধারণত তীরের দিকে আছড়ে পড়ে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, অর্পিতাকে তীব্র ঢেউ কোনো অচেনা দ্বীপের সৈকতে আছড়ে ফেলেছে। তাই আমি পরিকল্পনা করছি ওকে খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিতে। ’
‘তোমার কথায় যুক্তি আছে, প্রস্তাবটাও ভালো। কিন্তু খুঁজবো কীভাবে বলো! বিশাল সাগরে কয়টি দ্বীপ আছে কে জানে, একজন মানুষ খোঁজার মানে হচ্ছে, সাগরে হারিয়ে যাওয়া আলপিন খোঁজার মতো অবস্থা। বিষয়টা কত কঠিন বুঝতে পেরেছো তুমি?’
‘আমি বুঝে শুনেই সব বলেছি। কাজটা যত কঠিনই হোক, ওকে খুঁজতে হবে আমাদের; কারণ আমি বেঁচে ফিরেছি, অর্পিতাও বেঁচে আছে। ও সাগরেই ভাসছে একাকী, বিষয়টা একবার ভাবুন আঙ্কেল। ’
‘চলো আমরা আগে কোস্ট গার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ’
‘কোস্ট গার্ডের কাছে আমি আগেই সব ঘটনা খুলে বলেছি আঙ্কেল। তারা বলেছেন, ওকে পেলে সেন্টমার্টিনের এই ঠিকানায় পৌঁছে দেবেন। তাছাড়া কোস্ট গার্ড খুঁজে পেলে তাদের কাছে নিরাপদও থাকবে অর্পিতা। ’
‘তাহলে কী করব এখন? আমাকে বুঝিয়ে বলো সব। আমার মাথা একদম হ্যাং হয়ে আসছে। আমি মেয়েকে ছাড়া বাঁচব না তিয়াস। ’
‘ধৈর্য ধরুন আমি সব ব্যবস্থা করছি। আগে যোগাযোগ করতে হবে মাছ ধরার ট্রলারের সঙ্গে। ওদের সমিতিতে গিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে কিছু টাকা-পয়সা ওদের হাতে দিয়ে বলব যদি অর্পিতার সন্ধান পায় তাহলে যেন হোটেলে পৌঁছে দেয়। ’
মোবাশ্বের আলী বললেন, ‘তোমার যা মর্জি তাই করো, আমার মেয়েকে চাই; ওকে কেন নিয়েছো দ্বীপে। আমার একমাত্র সন্তান অর্পিতা, তুমি কি তা জানো না?’ কথা শেষ করে ছোটদের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
মূলত অর্পিতাকে ঘিরেই আলী দম্পতির দুনিয়া। অর্পিতা ছাড়া তাদের জীবন অন্ধকারময়, বেঁচে থাকাও অনর্থক। মোবাশ্বের আলী ভেঙে পড়তেই তিয়াস বলল, ‘আপনি এই নিয়ে দুঃচিন্তা করবেন না আঙ্কেল, উপরওয়ালা যদি ওর হায়াত রাখেন, তাহলে যেকোন উসিলায়ই বাঁচবে। দেখছেন তো আমি মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছি। শুধু তাই-ই নয়, হাঙরের কবল থেকেও আমি রক্ষা পেয়েছি। কোস্ট গার্ডের লোকজন আমাকে জানিয়েছেনও ভয়াবহ সেই ঘটনার কথা। ’
মোবাশ্বের আলী চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘আবারো সান্ত্বনা দিচ্ছো আমাকে। বলছি না মিথ্যা সান্ত্বনা দেবে না, যা বলবে সত্য বলবে, আমি নার্ভাস হবো না। ’
‘না আঙ্কেল, সান্ত্বনা দিচ্ছি না। সত্যই বলছি। ইচ্ছে করলে কোস্ট গার্ডের সঙ্গে দেখা করে আমার উদ্ধার সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। ’
মোবাশ্বের আলী নিজকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘কী বলতে কী বলেছি, মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না, মনে কিছু নিও না বাবা। ’
‘আঙ্কেল আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। আমি আপনার মেয়ের বয়সী প্রায়। আমার বয়স আটাশ, অর্পিতার বয়স চব্বিশ। দু’জনের বয়সের ব্যবধান খুব বেশি নয়। আমাদের চেয়ে আপনি অনেক সিনিয়র; বিজ্ঞও। কিন্তু এই মুহূর্তে আপনি নিজকে ধরে রাখতে পারেননি। তাছাড়া আপনার মানসিক অবস্থাও ভালো নয়। সেটাও বুঝতে পেরেছি, তাই আমার অনুরোধ একটু শান্ত হোন আগে। তারপর বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন সবকিছু। আপনার একটা সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। ’
মোবাশ্বের আলী বললেন, ‘আমি কীভাবে শান্ত হবো তিয়াস? আমার মেয়ে সাগরে ভাসছে, ইচ্ছে করলে কি আমি শান্ত হতে পারি? যেভাবে হোক আমি অর্পিতাকে খুঁজে বের করবোই। ’
‘আঙ্কেল, আমিও আপনার সঙ্গে অর্পিতাকে খুঁজতে বেরুব। ওকে ছাড়া আমার দুনিয়াও অন্ধকারময়। অর্পিতাকে উদ্ধার করতে হলে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে সেই পরিকল্পনা করেন। কাজটা কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় করতে হবে, মানসিকভাবে আগে প্রস্তুতি নিন। ’
‘তিয়াস, আমি বহু বছর ধরে জাপানে ব্যবসা-বাণিজ্য করছি। ওখানে আমার ভালো একটা ব্যবসা আছে। প্রচুর আয়-রোজগার করছি। তুমি ভাবতে পারবে না আমার সঞ্চয় সম্পর্কে। সেকথা বলছি এই কারণে, অর্পিতাকে উদ্ধার করতে যত টাকা লাগবে সব ব্যবস্থা করতে পারবো। প্রয়োজনে আমরা সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী বোট ভাড়া করে অর্পিতাকে খুঁজব। ’
‘একটা পরামর্শ দিতে চাই আঙ্কেল, দেবো?’
‘বলো, তোমার পরামর্শ প্রয়োজন আছে। ’
‘আমার পরামর্শ হচ্ছে, আজই আপনারা দু’জন ঢাকার উদ্দেশে রওনা করবেন। তিনটার দিকে টেকনাফগামী একটা জাহাজ আছে। টেকনাফ পৌঁছে মাইক্রোবাস নিয়ে সোজা ঢাকা চলে যাবেন। আর যদি বিমানে যেতে পারেন, তাহলে তো উত্তম। বাসায় আন্টিকে রেখে পর্যাপ্ত টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে সেন্টমার্টিন ফিরে আসবেন। আপনি না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো, অর্পিতাকে ফেলে ঢাকা যাবো না। শুধু আমার মাকে ঘটনাটা জানিয়ে বলবেন, আমি বেঁচে আছি, অর্পিতাকে নিয়েই ঢাকায় ফিরব। ’
‘তুমি কী করতে চাও, আমাকে একটু খুলে বলো তিয়াস। ’
‘আঙ্কেল যেহেতু আপনার টাকা-পয়সা খরচ করার সামর্থ্য আছে, তাহলে আমরা নিজেরাই উদ্ধার অভিযানে নামবো। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকর্মী সঙ্গে নেবো। আর গভীর সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী একটা বোট ভাড়া করবো। যতটা পারি বঙ্গোপসাগরের দ্বীপগুলোতে নেমে খুঁজবো অর্পিতাকে। কারণ অর্পিতা ঢেউয়ের ধাক্কায় কোনো না কোনো দ্বীপে আছড়ে পড়বে, সাগরে তলিয়ে যাবে না; ওর গায়ে লাইফ জ্যাকেট পরা আছে। আমি নিজে পরিয়ে দিয়েছি। আর যদি উদ্ধারকর্মী বা মাছ ধরার ট্রলারে আশ্রয় পায় তাহলে তো সে একদিন সেন্টমার্টিন পৌঁছে যাবেই। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে নির্জন দ্বীপে খোঁজখবর নেওয়া। যে দ্বীপে জনবসতি আছে সেখানে পরে খোঁজ নেবো। এই হচ্ছে আমার মূল পরিকল্পনা। আপনার আপত্তি থাকলে জানাতে পারেন এবার। কারণ এখানে বিশাল বাজেটের ব্যাপার-স্যাপার আছে। ’
‘পরিকল্পনাটা আমারও মনে ধরেছে, তোমার সঙ্গে একমত। কোটি টাকা খরচ হলেও অর্পিতাকে খুঁজবো। মেয়ে না থাকলে আমার টাকা-পয়সা ভোগ করার আর কেউ থাকবে না দুনিয়াতে। আর এই সামান্য টাকার জন্য কারো কাছে ঋণ করতে হবে না। ’
‘তাহলে এটাই ফাইনাল সিদ্ধান্ত। এখুনি ঢাকা রওনা হয়ে যান। কাজ সেরে দ্রুত ফিরে আসুন সেন্টমার্টিনে। আর যদি টাকা-পয়সা কাউকে দিয়ে আনানো সম্ভব হয়, সেটাও করতে পারেন। তাহলে আরও দ্রুত উদ্ধার কাজে নামতে পারবো আমরা। ’
‘না ঢাকা যেতেই হবে। দেখি কক্সবাজার গিয়ে ফ্লাইটে যেতে পারি কি না। আগামীকাল সকালের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে পারলেও কাজ সেরে রাতে মাইক্রোবাস নিয়ে চলে আসব। তাছাড়া ব্যাংকে লেনদেনের বিষয়ও আছে। ’
‘আঙ্কেল আসার সময় দুইটা হাই রেঞ্জের বাইনোকুলার আর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওষুধপত্র নিয়ে আসবেন। ’
‘সবই নিয়ে আসবো, চিন্তা করো না তিয়াস। তুমি সাগরে চলাচলের উপযোগী বোটের ব্যবস্থা করো আগে। আরেকটা কথা তোমাকে বলা হয়নি, আমার এক বাল্যবন্ধু ঢাকায় থাকে, ওর নাম দৌলত আমিন। সে একসময় ‘বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড’-এর শিক্ষা শাখায় চাকরি করত। কয়েক মাস আগে দৌলত আমিন অবসরে এসেছে, ওর সঙ্গেও দেখা করবো। ওর মাধ্যমে কোস্ট গার্ডের সাহায্য নিতে পারবো আশা করি। ’
‘তাহলে তো কথাই নেই। অনেক উপকার হবে আমাদের। আপনি অবশ্যই ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করে আসবেন। আর আসার সময় মনে করে ওনার মোবাইল নম্বরটাও আনবেন। ’
‘নম্বর তো আনবোই, সমস্যা হচ্ছে নেটওয়ার্ক নিয়ে। সেন্টমার্টিনে তো নেটওয়ার্ক নেই। যাই হোক, সেটা পরের ভাবনা। তুমি সেন্টমার্টিনে থাকো, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই টেকনাফের উদ্দেশে রওনা দেবো। টেকনাফ পৌঁছেই মাইক্রোবাস নিয়ে সকালের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে যাবো আশা করি। আমি কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে যাচ্ছি, উদ্ধারের জন্য যা যা প্রয়োজন সব সংগ্রহ করো। বিশেষ করে বোট ভাড়াটা করে ফেলো আজই। নিরাপদ শক্তপোক্ত বোট নেবে কিন্তু; আর চেষ্টা করো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকর্মী সঙ্গে নিতে। আপাতত এই কথাই রইল। আমরা এখুনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করবো। তুমি হোটেলে থাকো বাবা। ’