মাতারবাড়ী বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। মাতারবাড়ীর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে মার্চে জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার ভারত সফরের সময়। ওই মাসেই জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ইয়েন (১২০ কোটি ডলার) ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এর আগেই টোকিও ৩ হাজার ৮৮০ কোটি ইয়েন দেওয়ার কথা জানিয়েছিল।
মাতারবাড়ী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি প্রাকৃতিক প্রবেশদ্বার। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সাহায্যকারী হিসেবে জাপান মাতারবাড়ীর কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, আর সে কারণে পাঁচ বছর আগে বন্দরটি উন্নয়নে তারা অঙ্গীকার করে।
গত দশকে জাপান বাংলাদেশের জন্য আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বেশ বাড়িয়েছে। প্রতিবছর জাপানে ইয়েনে যত ঋণ দেয়, বাংলাদেশ তার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পায়। বেশির ভাগ অর্থ খরচ হয় সড়ক, সেতু এবং অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামো তৈরিতে।
পানির গভীরতার দিক থেকে মাতারবাড়ী হবে শ্রীলঙ্কার কলম্বো কিংবা সিঙ্গাপুর বন্দরের সমতুল্য। এখানে থাকবে একটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। হারবার এলাকা খনন করে গভীর করা হবে, যাতে বড় কনটেইনার জাহাজ কিংবা ট্যাংক ভিড়তে পারে। ফলে লোহার আকরিক আমদানি করা বা বড় পরিমাণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি সহজ হয়।
২০২৭ সালে বন্দরের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর মাতারবাড়ী বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাবে। এর বাইরে এটি ভারতের অনুন্নত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য একটি প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে কাজ করবে। চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ভূমিবেষ্টিত এ রাজ্যগুলো ‘সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত।
মাতারবাড়ী বন্দর থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দূরত্ব একশ কিলোমিটারের মধ্যে। আশা করা হচ্ছে, মাতারবাড়ী বন্দর হওয়ার পর এটি চট্টগ্রাম বন্দরের উপর চাপ কমাতে সহায়তা করবে।
নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে নতুন একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে জাপান, যেখানে মূলত নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে রপ্তানির জন্য পণ্য উৎপাদন করা হবে। এ কারণে গভীর সমুদ্রবন্দর ছাড়াও পণ্য সরবরাহের জন্য সেখানকার সার্বিক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে চায় জাপান।
উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যে বাজার তৈরি করেছে সেটিও খুব একটা বড় নয়। তাছাড়া বাংলাদেশ যেসব পণ্য রপ্তানি করে পূর্ব ভারতে জাপানিরা সেগুলো নিয়ে কাজ করে না। তারা সাধারণত হাইটেক – মধ্যম পর্যায়ে শিল্প নিয়ে কাজ করে।
উত্তর-পূর্ব ভারতে বরং যতটা সুযোগ ছিলো বাংলাদেশ তা নিতে পারেনি নানা বাধার কারণে। এখন জাপান শিল্প প্রতিষ্ঠান করলে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাতে সামিল হতে পারবে। আর বাংলাদেশি পণ্যের জন্য যত বাধা সীমান্তে আরোপ করা হয় সেটি জাপানের ক্ষেত্রে হবে না।
শিল্পাঞ্চল গড়ার জাপানি উদ্যোগটি বাংলাদেশের জন্য অমিত সম্ভাবনাময় প্রকল্প। বাংলাদেশে এ মূহুর্তে তিনশরও বেশি জাপানি কোম্পানি কাজ করছে। নতুন শিল্পাঞ্চল নিয়ে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে শিগগিরই অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলতি মাসেই জাপান সফরের কর্মসূচি রয়েছে। সেখানে এসব বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পেতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।