প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গে কোকিলের ডাকে । নাহ কোকিলটা এখন প্রথম দিনের মতো বেসুরো গলায় গান গাচ্ছে না। খুব সুরেলা কণ্ঠে গান শুনিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। সকালে কোকিলের ডাক, হোটেল থেকে বের হলেই অন্য হাজারো ফুলের সঙ্গে কৃষ্ণচুড়ার সারি। কোকিলের ডাক ,কৃষ্ণচূড়া ফুল, সাগরের ঢেউ , আর সাগরের একদম পাশে দাঁড়িয়ে টকটকে লাল সূর্যটা অস্ত যাবার দৃশ্য । এই চারটি জিনিসের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা , বিশেষ ভালোবাসা । আমি হারিয়ে যাচ্ছি ভালোবাসার স্রোতে । ক্ষণে ক্ষণে গেয়ে উঠছি রবিঠাকুরের গান,” কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা “…।
আমার স্বামী আজ সিধান্ত নিয়েছে অন্য দিকে একটু যাবার । এতো সুন্দরের মাঝে একটু জায়গা কি আছে যা অসুন্দর? আজ আমরা বেড়িয়েছি অসুন্দরের খোঁজে। গাড়ী ছুটে চলেছে। অনেকটা পথই পেরিয়ে এলাম। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম, রাস্তার দুপাশে ক্যাকটাস গাছের চাষ । বেশ বেড়ে উঠা ক্যাকটাস গাছগুলো দেখে আমার মনে হলো কোন এক ডাইনি বুড়ি দাঁত বের করে কুৎসিত ভাবে হাসছে। ক্যাকটাস এর বাগান পার হতেই অন্য রকম একটি দৃশ্য চোখে পড়লো । রাস্তার পাশে বড় এক্টি ছাতার নিচে বসে আছে একজন বয়স্ক মহিলা, তার সামনে একটি ছোট টেবিল ।
ব্যাপারটা কি জানার বড় আগ্রহ জাগলো । গাড়ী থামিয়ে আমরা নেমে পড়লাম । দেখে মুগ্ধ হলাম মহিলার সামনের টেবিলটি জুরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন আয়তনের ঝিনুকের মালা, কানের দুল আংটি। তাছাড়াও নানা রকমের সামুদ্রিক জিনিসের ওপরও সাজানো হয়েছে গহনাগুলো । বেশ একটা শৈল্পিক পরিবেশ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে জায়গাটিতে । মহিলাটির একটা সাক্ষাৎকার নেবার সাধ জাগলো আমার। এটাও আমার কোনো কোনো ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহের প্রকাশ। মহিলা কতদিন থেকে এই ব্যবসা করছে।, বেচা কিনি কেমন হয় ? গহনাগুলো কে তৈরি করে। ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করলাম।
মহিলাটি মহা আনন্দে আমার সব প্রশ্নের জবাব দিলো । নির্জন রাস্তায় একা একা ক্লান্তিময় অবস্থায় বসে থেকে থেকে আমাকে পেয়ে যেনো তার আনন্দ উপচে পড়লো । বুঝে নিলাম কেউ আসে না তার কাছে গল্প করতে। কারো কিছু কেনার ইচ্ছে হলে গাড়ী থামিয়ে কিনে নিয়ে চলে যায় । মহিলাটির নাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তার নাম ‘ কালিনী ‘। কালিনী নামের অর্থটা জানা হয়নি মহিলাটির কাছে। এখন আফসোস হচ্ছে কেন জানলাম না? হয়তো স্থানীয় কোনো নাম হবে । কালিনী জানালো সে নিজেই তৈরি করে গহনাগুলো । তার ছেলে তাকে যোগার করে এনে দেয় নানা রকমের সামুদ্রিক জিনিস। আর সে নিজের তুলির টানে পছন্দ মতো সাজায় গহনাগুলো নানা আকারের ঝিনুক দিয়ে। ছোট ছোট ঝিনুক দিয়ে তৈরি করা একটি সবুজ রঙের মালা মোটা মুটি পছন্দ হোল । জিজ্ঞেস করলাম মালাটির দাম কতো? জবাব দিল পাঁচপান্ন ডলার ।
দাম শুনে ঘাবড়ে গেলাম। বলে কি মহিলা? কয়েকটি ঝিনুক দিয়ে তৈরি করা মালার দাম পাঁচপান্ন ডলার। হয়তো জিবনে আমি কখনো এই মালাটি পরবো ওনা । অন্য গহনাগুলি একটু নেড়েচেড়ে কালিনীকে ধনবাদ জানিয়ে গাড়িতে ফিরে এলাম। গাড়িতে স্টার্ট দিতেই কালিনী আমাদের গাড়ির জানালার কাঁচে টোকা দিলো । কাঁচ নামালে জিজ্ঞেস করলো তোমার কাছে কতো ডলার আছে ? কি অদ্ভুত প্রশ্ন । বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম কেন ? জবাব দিলো তোমার কাছে যা আছে তাই দাও , বলে মালাটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো । আমি কিছু চিন্তা না করেই বললাম দশ ডলার আছে। কালিনী বললো অসুবিধা নেই তাই দাও। আমি দশ ডলার দিয়ে মালাটি নিয়ে নিলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো । যদি দশ ডলারে মালাটি দিতে পারে তাহলে কেনো পাঁচপান্ন ডলার চাইলো ? আমি যদি বলতাম আমার কাছে পাঁচ ডলার আছে তাহলে সে কি বলতো ? আমাকে পর্যটক ভেবে কি এতটা ঠকাতে চাইলো । যাক গে সে চিন্তায় আর বেশী ক্ষণ আটকে থাকলাম না। আমরা চলে গেলাম আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনায়।
আমার স্বামী গাড়ি ঘুরালো আরেকটু অন্য দিকে। সেদিকে যেতে যেতে মনে হোলো এই এলাকাটিতে বিত্তবানদের বাস সেরকম নেই। মাঝারি আয়তনের সাধারন ঘর বাড়ি । বাড়ির সামনে সারি সারি কলা গাছ। গাছ গুলোতে ঝুলে আছে থোকা থোকা কলা বাড়ির উঠোনে এপাশ থেকে অপাশ পর্যন্ত দড়ি টেনে কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। স্মৃতি আমাকে একটানে নিয়ে গেলো বাংলাদেশের কোনো এক মফস্বলে । অন্য রকম এক ভালোলাগা আমাকে ঘিরে রাখলো বেশ কিছুক্ষণ ।
আমরা আজ বিকেলে যাবো সান সেট ডিনার ক্রুজে । সূর্য অস্তের রক্তিম আভা উপভোগ করতে করতে আমরা সম্পন্ন করবো আমাদের নৈশভোজ । গাড়ী থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস আমাদের এলোমেলো করে দিলো । বাতাসের সঙ্গে জরাজরি করে আমরা কুরুজের সামনে এসে দাঁড়ালাম । আমরা সব যাত্রী ডিনার করার উপযুক্ত সাজগোজ করে এসেছি । আগেই বলে দেয়া হয়েছিলো আমরা সবাই যেনো কিছুটা উষ্ণ কপড় চোপড় সঙ্গে রাখি । রাতে সমুদ্রে অনেক ঠাণ্ডা লাগবে। সবাই সে ভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলো । কিছু লোক ছাড়া। ক্রুজের সামনে একজন ক্যামেরা ম্যান বড়সড় ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ক্রুজে উঠার আগেই ছবি তুলে নেয়া হচ্ছে সকলের।
যারা যুগল তাদের যুগল ভাবে, যারা একা তাদের একা ভাবে , যারা গ্রুপে তাদের গ্রুপ ছবি তোলা হচ্ছে। ভেবে নিলাম হয়তো নিরাপত্তার কারনে এই ব্যবস্থা। যদি কেউ পানিতে পড়ে যায় কিংবা কোন দুর্ঘটনা যদি ঘটে তাহলে যেনো ছবি দেখে যাত্রীদের খুঁজে বের করা যায় । তারপর অবশ্য আমাদের এই ধারনা ভুল পরিনত হোল । পরে বুঝলাম বাধ্যতা মুলুক ছবি তোলাটা একটা ব্যবসা । পরে সবার কাছে সে ছবি গুলো বিশ ডলার করে বিক্রি করা হলো । কিছুটা লজ্জায় পড়েই সবাইকে ছবি কিনতে হলো । আমরাও কিনলাম । ঠাণ্ডা বাতাসে বসে সূর্য অস্ত দেখতে দেখতে অখাদ্য ধরনের নানা ধরনের কিছু খাবার দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলাম। সমুদ্রের মাঝে বসে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখতে অপূর্ব লাগলো । একজন যাত্রী খুব উৎসাহ সহকারে সূর্য অস্তের সামনে আমাদের ছবি তুলে দিতে চাইলো ।
আমরা খুশী হলাম তার আন্তরিকতার। প্রচণ্ড বাতাসে বাইরে বেশীক্ষণ বসা গেলো না। আমরা ভিতরের ছাউনি দেয়া জায়গাতে এসে বসলাম । সেই একই যাত্রীটি আমাদের তার পাশে আমাদের বসার জায়গা করে দিলো । ক্রুজের ভেতরে চলছে একজন গায়কের প্রানবন্ত সরাসরি গান। যাত্রীরা তার গানের সুরে আনন্দে হৈ চৈ করে উঠছে । কেউ কেউ নেচে যাচ্ছে ক্লান্তিহীন ভাবে। সেই একই যাত্রী অস্থির হয়ে উঠলো আমাকে নিয়ে নাচার জন্য। হাত-পা কোমর দুলিয়ে শেখাতে লাগলো হাওয়াইয়ান নাচ। আমি খুব বিরক্ত অনুভব করলাম। সেও নাছোড় বান্দা আমার সঙ্গে তার নাচতেই হবে। আমি চোখের ইশারায় আমার স্বামীর অনুমতি চাইলাম। সেও আমাকে চোখের ইশারায় বললো যাও । নাচতে গিয়ে দেখলাম ছোট চুল ,পুরুষালি কণ্ঠ , পুরুষালি পোশাক এতক্ষণ যাকে বিরক্ত অনুভব করেছিলাম সে আসলে একজন মহিলা। নিমিষে আমার বিরক্তি ও অস্বস্তি কেটে গেলো । আমিও মজা করে ওর সঙ্গে হাত কোমর দুলিয়ে হাওয়াইয়ান নাচ নাচলাম।
ভ্রমন শেষে ক্রুজটি তীরে ভিড়ল । আমরা সব যাত্রীরা একে অপরের কাছে বিদায় নিয়ে ক্রুজ চালককে ধন্যবাদ নামিয়ে পড়লাম । তখন বাতাস প্রবল বেগে বইতে শুরু করেছে। আমার মনে হচ্ছিলো আমাদের ছোট গাড়ীটি নিশ্চয়ই বাতাসের বেগে উড়ে চলে গেছে। আমরা বাতাসের সাথে সংগ্রাম করতে করতে গাড়ীটির পাশে এসে পৌঁছালাম । নাহ্ বাতাস আমাদের গাড়ীটি উড়িয়ে নিয়ে যায়নি । বাতাসের উদারতায় স্বস্থি পেলাম।
জায়গাটির নাম আইএও ভ্যালি ।পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে ভ্যালিটি । আইএও ভ্যালী আজ আমাদের গন্তব্য । পাহাড়ের পাশ দিয়ে গাড়ী চালিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম আইএও ভ্যালিতে । হেঁটে কিছুটা ওপরের দিকে উঠে যেতে হোলো আমাদের। দু’ পাশে রেলিং দিয়ে বানানো হয়েছে হাঁটার ব্রিজ। নিচে বয়ে যাচ্ছে ঝরনার পানি। ব্রিজ পেরিয়ে অন্য পাশে অপেক্ষা করছে মনোরম দৃশ্য । সরু কাঁচা পথ একেঁবেঁকে চলে গেছে বহুদুর। কোনো দিকে অসংখ্য সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। আবার কোথাও অগনিত সিঁড়ি উঠে উপরের দিকে। প্রথমে আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে গেলাম। পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ঝরনা ধারা। বেগে ঝরনার সে জলধারা কলকল গান করে নেমে চলেছে সমতলের দিকে। ঝরনার পদদেশে বড় বড় পাথরের ভিড় , পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে ঝরনা যেনো গান ধরেছে নতুন সুরে। ঝরনার একেবারে পাশে গিয়ে হাত ডুবিয়ে দেয়া যায় পানিতে। ঝরনার পাশে, সিঁড়িতে ওঠা নামার পথে, সরু রাস্তার দু’পাশে পেয়ারা গাছ, কুল গাছ, কলা গাছ, আপেল গাছ, আঙ্গুর গাছ হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাচ্ছে সব। অরন্যের নানা রঙের ফুল ফুটে আছে এলোমেলো ভাবে। বনফুলের সুবাসে মৌ মৌ চারপাশ দেখে মনে হয় প্রকৃতি ছিটিয়ে ফেলে দিয়েছে কিছু তুলির রং।