কোভিডে সৃষ্ট মহামারীতে উৎপাদন বন্ধ থাকায় দুদর্শায় কেটেছে মনিপুরী তাঁত শিল্পীদের দিনকাল। সেই লোকসান কাটিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টার মধ্যে সুতা, রংসহ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে।
তার পরেও ক্রেতাদের আগ্রহের কথা ভেবে আকর্ষণীয় শাড়ি, থ্রি পিস, চাদর, পাঞ্জাবিসহ রকমারী পোশাক তৈরি হচ্ছে মনিপুরীদের ঘরে ঘরে। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর এই লড়াইটাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চান শিল্পীরা।
শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা মনিপুরী তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। এ অঞ্চলের তাঁতিদের নিপুণ হাতে তৈরি বিভিন্ন নকশাখচিত হরেক রকম তাঁত বস্ত্র ঈদ, পূজা-পার্বনে ফ্যাশন সচেতন মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। পাশপাশি পর্যটকদের কাছেও এসব পোশাকের কদর অনেক।
মনিপুরী কাপড় ব্যবসায়ী রাধাকান্ত সিংহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সামনেই ঈদ; সংগত কারণেই ব্যস্ততায় কাটছে তাঁত পল্লীর সময়। ঈদ ছাড়াও পূজা-পার্বনে এসব পোশাকের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। অনলাইনেও ব্যবসায়ীরা এখান থেকেই পোশাক সংগ্রহ করেন।
“মনিপুরীদের একটা ঘর মানেই একটা তাঁত শিল্পের কারখানা।”
তিনি বলেন, “এই শিল্পের সঙ্গেই জড়িত রয়েছে জেলার দুই উপজেলার হাজার হাজার মনিপুরী। বিশেষ করে মনিপুরী নারীরা এটি বুনেন আর পুরুষেরা তা বিপণন এবং কাঁচামালের রসদ জোগাড় করে দেন।”
শ্রীমঙ্গল উপজেলার রামনগর মনিপুরী পাড়া, টিকরিয়া মনিপুরী পাড়া, কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর, আদমপুর, তেতই গাঁও, ঘোড়ামারা ও তিলকপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে মনিপুরী সম্প্রদায়ের বসবাস। এসব এলাকায় এক সময় শতকরা ৯০ ভাগ পরিবারেই তাঁত ছিল। বর্তমানে বিকল্প জীবিকা ও পুঁজির অভাবে ২০ থেকে ৩০ ভাগ পরিবার এ পেশা থেকে সরে গেছে বলে উল্লেখ করেন ব্যবসায়ী রাধাকান্ত।
শ্রীমঙ্গল রামনগর মনিপুরী পাড়ার তাঁত শিল্পী সবিতা সিনহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছর আমাদের ব্যবসা হয়নি। শাড়ি তৈরি করলেও ক্রেতা আসেনি। ঘরে দুই-তিনটা তৈরি শাড়ি রেখে অনেকে নতুন করে আর শাড়ি বুনেননি। বলা চলে, মহামারীর সময়ে এ পেশায় একটা ধ্স নামে।”
মনিপুরী কাপড় ব্যবসায়ী বিপুল সিংহ জানান, মহামারীর কঠিন সময়ে সরকার অনান্য পেশার মানুষকে প্রণোদনা দিলেও তাদের ভাগ্যে তা জোটেনি। পাশাপাশি বতর্মানে সুতা, রংসহ শাড়ি তৈরির আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
মনিপুরী কমিউনিটির নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ বলেন, নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে মনিপুরী তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাদের কমিউনিটির উদ্যোক্তারা কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে গত দুই বছর ধরে মহামারীর কারণে অনেকটা হুমকির মুখেও যে এ শিল্প ঠিকে আছে তা তাদেরই অবদান।
তিনি বলেন, “ললিতকলা একাডেমির ট্রেনিং সেন্টারগুলো বন্ধ রয়েছে। এগুলো আবার চালু করা প্রয়োজন। তাছাড়া মাধপুরে নির্মিত আধুনিক ট্রেনিং সেন্টারে এখনও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়নি। বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ডিজাইনের সন্নিবেশে কাপড় তৈরি করলে এর চাহিদা বাড়বে। বিশেষ করে মনিপুরী জামদানি শাড়ি তৈরিতে আরও উদ্যোগী হওয়া যাবে।”
এ শিল্পের উদ্যোক্তা ভবন সিংহ বলেন, “এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে বিনাসুদে প্রণোদনা কিংবা আর্থিক সহযোগিতা জরুরি। তা না হলে নিজস্ব উদ্যোগে তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।”
মনিপুরী কমিউনিটির নারী নেত্রী জয়া শর্মা বলেন, “একটি সাধারণ শাড়ির কাঁচামাল সংগ্রহে খরচ পড়ে এক হাজার টাকা। আর উন্নত সুতা দিয়ে তৈরি করলে সে খরচ পড়ে দুই হাজার টাকারও অধিক। আর মনিপুরী জামদানি তৈরি করলে তার খরচ পড়ে প্রায় চার হাজার টাকা।
“আধুনিক প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পেলেই এ শিল্প দিয়ে যেমন এ পেশার মানুষগুলো বেঁচে থাকতে পারবে। তেমনি সরকারও পাবে রাজস্ব।”
তিনি জানান, একজন নারী একদিনে দুটি শাড়ি তৈরি করতে পারেন। আর জমিনে কাজ করা (ডিজাইন) মনিপুরি জামদানি শাড়িগুলো প্রস্তুতে দুইজন তাঁত শিল্পীর প্রয়োজন হয়।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এই অঞ্চলে মনিপুরী তাঁত শিল্পের ব্যাপক প্রসার রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও এর চাহিদা রয়েছে। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কাজ করছে। এরই মধ্যে কমলগঞ্জে প্রশিক্ষণ সেন্টার করা হয়েছে। ছোট পরিসরে হলেও শ্রীমঙ্গলে একটি প্রশিক্ষণ সেন্টার তৈরির জন্য তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন