সীমাবদ্ধতার মধ্যে ক্লান্তিবোধ নেমে আসে; তাই তো গৃহকোণে আবদ্ধ না থেকে ঘুরতে যেতে হবে। ভ্রমণ মানুষের মনের পরিধিকে বিস্তৃত করে। ভ্রমণ প্রসঙ্গে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন, ভ্রমণ স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য জানায় এবং আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। প্রফুল্ল মন ও শারীরিক সুস্থতার জন্য ভ্রমণ খুবই উপকারী।
মহামারি করোনা ও অন্যান্য প্রতিকূলতার কারণে বেশ ক’দিন ভ্রমণ বিরতি। তাই এবারের চট্টগ্রাম ভ্রমণ অনেকটা হঠাৎ করেই। আগে থেকে দিনক্ষণ ঠিক করা ছিল না। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা (১৪ জানুয়ারি ২০২২)। অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই সহকর্মী সাদ্দাম হোসেন রবিনের ফোন- চট্টগ্রাম থেকে ঘুরে যেতে। ভ্রমণের লোভ সংবরণ করতে না পেরে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেওয়া। রাত প্রায় আড়াইটার সময় পৌঁছলাম সীতাকুণ্ড। কালবিলম্ব না করে ঘুমিয়ে পড়লাম; কারণ খুব সকালে উঠতে হবে।
ঘুম থেকে উঠেই খেজুরের রস ও চট্টগ্রামের স্থানীয় বিভিন্ন পিঠা দিয়ে সকালের নাশতা সেরে নামারবাজারের উদ্দেশে সিএনজিতে চড়ে বসলাম। নামারবাজার নেমে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারও সিএনজিতে উঠে পড়লাম। গন্তব্য গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত। প্রায় দীর্ঘ এক যুগ পর যাচ্ছি; মন আন্দোলিত হচ্ছে স্বভাবতই। অল্প সময়ের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছলাম। অপরূপ-অনিন্দ্য সুন্দর গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতকে সাজাতে প্রকৃতি যেন কোনো কার্পণ্য করেনি। একদিকে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের জলরাশি, অন্যদিকে কেওড়া বন ও কেওড়া গাছের শ্বাসমূল সৈকতকে করেছে অনন্য। রয়েছে সোয়াম্প ফরেস্ট ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পরিবেশ।
গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত নির্দিষ্ট একটা সময় অতিবাহিত করার পর উপজাতিদের জীবন-বৈচিত্র্য অবলোকন করার জন্য রওনা দিলাম সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পল্লিতে। সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় ত্রিপুরা পল্লি। কয়েকটা পাহাড়ের সমন্বয়ে এদের বসবাস। নালার মতো আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে হেঁটে চলছি। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘ছড়া’। পাহাড়ি ঢল থেকে নেমে আসা পানি প্রবাহিত হয় এই ছড়া দিয়ে। পাহাড়ের নিচ থেকে দেখলে মনে হয় ছোট ছোট ঘর। বেয়ে ওপরে উঠতেই ভিন্নরকম এক অনুভূতির সৃষ্টি। নিরিবিলি ও পরিচ্ছন্ন ত্রিপুরা পল্লি দেখে মনে হলো কিছুটা জনমানবহীন। দূরে কিছু মানুষ দেখা গেল, যারা কিনা ঝুমচাষে ব্যস্ত। শিশুরা সাবলীল চিত্তে নিঃসংকোচে পাহাড়ের নিচে নামছে ও উঠছে। হয়তো এমনটাই তাদের আনন্দের জীবন।
মধ্যাহ্নভোজ সারলাম সহকর্মীর আত্মীয়ের বাসায়। আতিথেয়তায় চট্টগ্রামের মানুষ বরাবরই সেরার ছাপ রাখেন, সেটা আরেকবার দেখলাম। শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় তড়িঘড়ি বাড়ৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের পথে যেতে লাগলাম। কেননা, দিনের বাকি সময় খুব একটা অবশিষ্ট নেই। উদ্যানে খুব একটা সময় অতিবাহিত না করে মহামায়া লেকের দিকে ছুটছি। সময় তখন বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিট। অনেক দিনের শখ, লেকে কায়াকিং করব।
যেই কথা সেই কাজ। ৩০ মিনিটের জন্য ২০০ টাকা ভাড়ায় বৈঠা হাতে লম্বা-ছোট্ট বোটে চেপে বসলাম। লেকের স্বচ্ছ জল আর পাহাড়ি গুহা এবং রয়েছে ঝরনা। এই লেকে দেখা মিলবে অসংখ্য দেশীয় ও পরীযায়ী পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীর। পশ্চিম আকাশে সূর্যের বিদায়লগ্নে কায়াকিং শেষ করি, যদিও মন ছুটি চাচ্ছে না কিন্তু সময়কে যে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। কায়াকিংয়ের জন্য এখানে আগমন ঘটে অসংখ্য ভ্রমণপ্রেমীর। চাইলে এখানে রাতে ক্যাম্পিং করেও থাকার ব্যবস্থা আছে। আর সেটা যদি হয় পূর্ণিমার চাঁদরাতে, তা আনন্দ বেড়ে কয়েকগুণ। সত্যিই এমন পরিবেশ যেন খুঁজে পাওয়া যায় অপার্থিব প্রশান্তি।