রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ন

মণিপুরী রাস উৎসবে

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৩

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সবচেয়ে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হলো রাস উৎসব। প্রতি বছর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব হয়। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে মণিপুরী অধ্যুষিত আদমপুর ও মাধবপুরে রাস উৎসব হয়। এ ছাড়াও সুন্দরবনের দুবলার চর, কুয়াকাটা ও কান্তজির মন্দিরে বড় আয়োজনে এই উৎসব উদযাপিত হয়।

এবার আমার ‘ভ্রমণযোগ’ ছিলো মণিপুরীদের রাস উৎসবে যাওয়া। আত্মভোলা ও কবিতার জগতেই বিচরণকারী এক কবি নুরুল হালিমকে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেয়ে যাই। আমি যে সময়টিতে প্রথমবারের মতো মণিপুরীদের রাস উৎসবে গিয়েছিলাম তা আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর পূর্বে। তবে আয়োজনে এবং উদযাপনে রাস উৎসব তার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আজও রক্ষা করে চলেছে।

৫ নভেম্বর, ২০০৬, সকালে সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। দীর্ঘদিন পর রেলযাত্রা অন্যরকম লাগে। পথে যেতে আমি মণিপুরী জাতিসত্তা সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক এ.কে. শেরাম-এর কিছু লেখা পড়ছিলাম। “প্রাচীনকালের সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং এখনকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর এদের আদি বাসস্থান। প্রাচীনকালে মণিপুরী সম্প্রদায় ক্যাংলেইপাক, ক্যাংলেইপাং, ক্যাংলেই, মেইত্রাবাক, মেখালি প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিলো। মনিপুরীদের মেইতেই নামেও অভিহিত করা হতো। মহারাজ গরীব নেওয়াজের (১৭০৯-১৭৪৮) শাসনামলে সিলেট থেকে আগত মিশণারিগণ এই স্থানকে মহাভারতে বর্ণিত একটি স্থান মনে করে এই ভূখন্ডের নাম দেন মণিপুর। এভাবেই এখানকার প্রধান অধিবাসী মেইতেইদের নাম হয়ে যায় মণিপুরী। পরবর্তীকালে অনুসন্ধান করে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এখনকার মণিপুর এবং মহাভারতের মণিপুর একই স্থান নয়। মণিপুরীরা বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ, সংগ্রাম এবং অন্যান্য সামজিক, রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে। এ ধরনের অভিবাসন প্রথম শুরু হয় (১৮১৯-১৮২৫) মণিপুর-বার্মা যুদ্ধের সময়। একটি অনুসন্ধানী গবেষণায় লক্ষ্য করা যায় যে, এই যুদ্ধের আরোও আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং রাজা ভাগ্যচন্দ্রের সময়ে (১৭৬৪-১৭৮৯) উক্ত অভিবাসন শুরু হয়।”

এ পর্যন্ত পড়ে থামি। ততক্ষণে ট্রেন আজমপুর নামক স্টেশনে এসে থেমেছে। এটিই আখাউড়া বাইপাস রেল লাইনের সংযোগকারী স্টেশন। এখানে ট্রেন পাঁচ মিনিট থামবে। মনে পড়ে আখাউড়া স্টেশনের কতো স্মৃতি। নানারকম ফল, বাদাম, চানাচুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্দেশ, শসা, পান-সিগারেট, পত্র-পত্রিকা, সস্তা উপন্যাস, হস্তশিল্পসহ নানা পণ্যের ফেরিওয়ালা হাঁকডাকে সরগরম থাকতো। ফেন্সিডিল ব্যবসায়ী, কালোবাজারী, প্রতিটি বগিতে হঠাৎ করে বিডিআর এর চেকিং, মানুষের ছোটাছুটি, সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেটের ট্রেনের আসা-যাওয়া আখাউড়া ছিলো দারুণ গতিশীল জংশন। এখন আখাউড়ায় আগের সেই ব্যস্ততা নেই।

‘পড়তে পড়তে গন্তব্যে’ একটি ভ্রমণ বিষয়ক পত্রিকার স্লোাগান। আমিও পড়তে পড়তে শ্রীমঙ্গলে স্টেশনে আমাদের গন্তব্যে চলে এলাম। এখান থেকে জীপযোগে যেতে হবে মূল গন্তব্যস্থল কমলগঞ্জের আদমপুরে। শ্রীমঙ্গলের একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সেরে জীপের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ি। হেঁটে হেঁটে চলে যাই শ্রীমঙ্গল পৌরসভার কাছে। এখান থেকে কমলগঞ্জ বা ভানুগাছগামী জীপ যায়। আমরা বেশ ক’জন যাত্রী পরিবহণে সক্ষম বড়সড় জীপে চড়ে বসি। একজন দুইজন করে জীপটি অল্পক্ষেণই ভর্তি হয়ে যায়। আমাদের সাথে ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন মণিপুরী তরুণও একই জীপে আদমপুরের যাচ্ছে। ওদের সাথে বেশ জমে যায় আমার ও হালিম ভাইয়ের আলাপ। এদের মধ্যে সবচাইতে বেশি আড্ডাবাজ স্বপন। স্বপন এবং ওর কমিউনিটির আরো ছাত্ররা মিলে ঢাকার গ্রীনরোডে মেস ভাড়া নিয়ে থাকে।

জীপ ইতোমধ্যে চলতে শুরু করেছে। খুব দ্রুতই ফিনলে চা বাগানের ভেতর চলে এলো। দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান অতিক্রম করে এখন আমরা লাউয়াছড়া বনভূমি অভিমুখে। যেতে যেতে স্বপন জানায়, তারা ভারতের মণিপুর রাজ্যে যেতে চায়। বাংলাদেশ থেকে অনুমতিও পেয়েছে কিন্তু ভারত সরকার ভিসা দিতে টালবাহানা করছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের মধ্যে মণিপুর অন্যতম। মণিপুরীদের মূল ভূমি হচ্ছে মণিপুর রাজ্য। ভারতের মণিপুরীরা বিভিন্নভাবে নিজেদের রাষ্ট্র কর্তৃক শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার। ফলে এখন মণিপুরীরা নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন সময় খবর আসে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক মণিপুরীদের ওপর নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সেভেন সিস্টারস’ বলে পরিচিত রাজ্যগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে জাতিগত অধিকার আদায়ের সংগ্রাম খুব জোরদারভাবে চলেছে দীর্ঘকাল। এখন নানা কারণে কিছুটা স্তিমিত।

স্বপনের সাথে যেতে যেতে অনেক বিষয়ে কথা হয়। মনে হলো সে খুব রাজনৈতিক খবরাখবর রাখে। আমাদের আলোচানয় আসে, যে কোনো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওপর বৃহৎ জাতিসত্তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য অব্যাহত রাখলে অস্থিরতা বিরাজ করাটাই স্বাভাবিক। বৈষম্য ও নীপিড়নের কারণে কখনো কখনো এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপলাভ করে। যেমনটি আমরা বাঙালিরা পাকিস্তান কাঠামোর ভেতর থেকে স্বাধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম, যা এক পর্যায়ে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ লাভ করে। যতো বড়ো পরাশক্তিই হোকনা কেনো গায়ের জোরে কিছুই স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় না।

দেখতে দেখতে চলে এলো মাগুরছড়ার পরিত্যক্ত গ্যাস কুপ। কমলগঞ্জ যেতে হাতের ডানদিকে ফেলে যেতে হয় এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্যাসক্ষেত্রটি। অক্সিডেন্টাল নামক একটি মার্কিনী কোম্পানির খামখেয়ালীপনার শিকার হয়ে মাগুরাছড়ায় আবিষ্কৃত এই মহামূল্যবান সম্পদটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গ্যাস, বনভূমি, পরিবেশ ও তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হিসেব করে বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের মতে, মাগুরছড়ায় ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। আমাদের গ্যাস ও পরিবেশের ক্ষতি করার পরও অক্সিডেন্টাল কোম্পানি আজ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়নি। উপরন্তু তারা তাদের শেয়ার আরেকটি কুখ্যাত মার্কিনী কোম্পানি ইউনিকোলের কাছে বেচে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। ইউনিকোলও এই গ্যাসক্ষেত্রের ক্ষতিপূরণ দেয়নি। এই বিদেশী কোম্পানির সাথে এ দেশের দালাল ও দোসর জড়িত থাকার কারণে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপ নেই বললেই চলে।

লাউয়াছড়া জঙ্গলে ভ্রমণ বা ট্রেকিং-এ একাধিকবার এসেছি। এ ছাড়া গ্যাসরক্ষা ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে যোগ দিতে ব্যক্তিগতভাবে এখানে এসেছি একাধিকবার। মাগুরছড়া পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র পাড়ি দিয়ে একটু সামনে গেলে বামদিকে পড়ে খাসিপুঞ্জী। এখানে খাসি জাতিসত্তার জীবন যাপন, পাহাড়-টীলার ওপর বিশেষ আকৃতিতে তৈরি ঘর ইত্যাদি দেখা যেতে পারে।

আমাদের জীপটি কমলগঞ্জে এসে যাত্রী ওঠানামানোর জন্য কিছুক্ষণ থামে। আমরা আবার চলতে শুরু করেছি আদমপুরের উদ্দেশ্যে। কমলগঞ্জ থেকে আধা ঘণ্টায় মূল গন্তব্যস্থল আদমপুর পৌঁছে যাই। স্বপন ও তার বন্ধুদের কাছ থেকে আপাতত বিদায় নিই। আমরা হাঁটতে হাঁটতে মূল বাজারের দিকে এগোই। আদমপুর একটি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা। তাই বাজার এলাকাটা বেশ বড়। আমরা একটি চায়ের দোকান থেকে চা পান করে উৎসবস্থলের দিকে পা বাড়াই। সম্ভবত অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ঢাক ও ঢোলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমরা।

বেশ বড়ো একটি মাঠে বিশাল প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। মঞ্চের সামনে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা। একটি বাড়িতে বড়ো আকৃতির একটি খোলা মন্দির। সাধারণত মণিপুরী মন্দির যেরকম হয়, মন্দির ঘিরে রয়েছেন পূজারী, নৃত্য পরিবেশকারী ও সাধারণ দর্শকগণ। আমরা সামনে গিয়ে বসি। উপস্থিত একজন মণিপুরী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করি, অনুষ্ঠানগুলোর পর্যায়ক্রমগুলো কী কী? তিনি জানান, ‘একটু পরেই শুরু হবে রাখাল নৃত্য। এই নাচের বিভিন্ন উপস্থাপনা সন্ধ্যে পর্যন্ত চলে শেষ হবে। এরপর আপনারা মাঠের মধ্যে যে প্যান্ডেল দেখছেন সেখানে পরিবেশিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তিনজন বিশিষ্ট মণিপুরী ব্যক্তিত্বকে দেওয়া হবে সম্মাননা। রাত ১২টায় শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান রাসলীলা।’

অনুষ্ঠানের একটা সূচি পাওয়া গেল। হালিম ভাই বেশ আগ্রহভরে একেকজনকে জিজ্ঞেস করে তথ্য জিজ্ঞেস করে সাংবাদিকের মতো নোট নিচ্ছেন। তবে যারা উত্তর দিচ্ছেন তারা কেউই রাখালনৃত্য, রাসলীলা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত নন। সবারই দেখছি ধর্ম-কর্মে তেমন একটা মন নেই। অবশ্য উৎসব পালন করতে এত জ্ঞান অর্জন করে কী হবে?

নিজে থেকে পরিচিত হয় সঞ্জীব নামক এক মণিপুরী তরুণ। তাকে বলি, এই উৎসবে অংশগ্রহণের পেছনে আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি লেখা তৈরী করা। সঞ্জীব বেশ তৎপর হয়ে আমাদের সহযোগিতা করে। সঞ্জীব আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় রাস উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি চন্দ্রকীর্তি দার সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ মণিপুরী সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি। কীর্তিদা আমাদের একেবারে মঞ্চের সামনে রাখা চেয়ারে নিয়ে বসার ব্যবস্থা করেন। তিনি অনুষ্ঠান নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। তারপরও প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেন।

রাখালনৃত্য অনেকক্ষণ হয় শুরু হয়েছে। কৃষ্ণ ছিলেন রাখাল বালক। অবতার কৃষ্ণের সেই রাখাল বেশে কৃষ্ণ ও রাখাল সহচরদের বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কাহিনী তুলে ধরে নাচ পরিবেশন করা হচ্ছে বাদ্যের তালে তালে। নৃত্য দেখতে দেখতে, কখনো সঞ্জীব, কখনো কীর্তিদা, কখনো স্বপন সবার সাথে কথা বলতে বলতে দুপুর গড়িয়ে যায়। এবার পেটে কিছু না দিলেই নয়। আমরা আদমপুরের একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের আহার গ্রহণ করি।

জমজমাট হয়ে উঠেছে আদমপুরের রাস উৎসবের মূলমন্দির। বিকেলে যেনো মণিপুরী নারী-পুরুষ, তরণ-তরুণী, শিশু-কিশোরদের ঢল নামে। স্থানীয় বাঙালীরাও যোগ দিয়েছেন উৎসবে। মাঠসংলগ্ন একটি খোলা জায়গায় নানা ধরণের খাবার ও খেলনা নিয়ে মেলার পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। সবার মাঝে এক উৎসবের আমেজ। ইতোমধ্যে রাখাল নৃত্য সমাপ্ত হয়েছে। পরবর্তী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার প্রস্তুতি চলছে। সঞ্জীব আমাদের নিয়ে যায় বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদের স্টলে। এখানে পরিচয় হয় সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাজকুমার সিংহের সঙ্গে। এখানে বসেছিলেন মণিপুরী ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক মণিহার শোনি। মণিহারদা’র সাথে আমাদের আড্ডা বেশ জমে ওঠে। রাজকুমার জানালেন মনিহারদাসহ তিনজনকে এবার সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। অন্য দু’জন হচ্ছেন বর্তমানে সিলেটের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রানা কুমার সিনহা ও মডেল শানারৈ দেবী শানু।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। মণিপুরী এবং বাংলা আধুনিক, ব্যান্ড এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। বেশ ক’টি গান পরিবেশনার পর শুরু হয় আলোচনা সভা ও সম্মাননা প্রদান পর্ব। আলোচনা সভা শুনতে শ্রোতারা এখন খুব বিরক্ত হন। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে অনুষ্ঠানের ঘোষক বারবার ঘোষণা করছিলেন ‘আলোচনা ও সম্মাননা পর্ব শেষে আবারো শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।’ এ যেন শিশুদের খানিকক্ষণের জন্য ভুলিয়ে রাখার কৌশল!

আলোচনা সভা ও সম্মাননা প্রদান পর্ব শেষ হয়ে এখন আবারো শুরু হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লাঠি নৃত্য, মার্শাল আর্টের ভঙ্গিমায় নৃত্য, রাস নৃত্য দারুণ উপভোগ্য হয়। আমার দারুণ লাগে বাউল শাহ্ আব্দুল করিমের গান ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে, ফুলে বইলা ভ্রমরা, ময়ূর বেশেতে সাজন রাধিকা’ গানটির সাথে নাচ। গানটি ছিলো মেইতেই (মণিপুরী) ভাষায়। এর মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রানা কুমার সিনহা গেয়ে শোনালেন- ‘পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কীরে হায়/সে তো চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সেকি ভোলা যায়…। উপস্থাপকের অনুরোধে রানা কুমার সিনহা এই গানটির ইংরেজিও গেয়ে শোনালেন। অসাধারণ দরদী কণ্ঠ এই শিল্পীর। রানা কুমার সিনহা শুদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার জন্য নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন।

এর মধ্যে আমি ও কবি নুরুল হালিম রাতের খাবারের সমাপ্ত কের ফেলি স্থানীয় রেস্টুরেন্টে। খেতে খেতে অনেক কথাই হয়। বিশেষ করে মণিপুরীদের দুটো বিদ্রোহ তৎকালীন ভারতবর্ষের বর্তমান বাংলাদেশের এই কমলগঞ্জেই ভানুবিল বিদ্রোহ (১৯৩০-৩২) ও মণিপুর রাজ্যে নারীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম নুপিলান বিদ্রোহ (১০৩৯) নিয়ে কথা হয়। নুপিলান দিবসে আমি একবার আমি কমলগঞ্জে এসেওছিলাম।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে। এখন শুরু হবে মূল আকর্ষণ রাসনৃত্য। মণিপুরী কুমারী মেয়েরা রাতব্যাপী পরিবেশন করবে এই নৃত্য, যে নৃত্য নান্দনিকতার জন্য বিশ্বখ্যাত। শুরু হলো আমাদের বহু প্রতিক্ষিত ও রাস উৎসবের সবচাইতে আকর্ষণীয় পর্ব রাসনৃত্য। গোলাকৃতি মঞ্চের সামনের দিকে বসেছে গায়ক ও বাদ্যযন্ত্রীরা। মঞ্চের মূল প্রবেশমুখে বসেছে নৃত্যশিল্পীরা। ফিনফিনে নেটের আবরণ দেওয়া চমৎকার সাজে সজ্জিত নৃত্যশিল্পীরা। চারিদিকে মঞ্চকে ঘিরে রয়েছে হাজারো ঔৎসুক দর্শক। কী কারণে যেন বিলম্ব হচ্ছে। আমি ও হালিম ভাই সামনের দিকে চেয়ারে আরো অনেকের সাথে বসে অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে ফুটফুটে ছোট্ট সুন্দর একটি শিশু মঞ্চে প্রবেশ করল। রাসনৃত্যের রাধা। এরপর আরেকটি শিশু প্রবেশ করে মঞ্চে। সে হচ্ছে কৃষ্ণ। একে একে মঞ্চে প্রবেশ করতে থাকে নৃত্যশিল্পীরা। বাদ্যের তালে তালে তারা তুলে ধরে নানা ভঙ্গিমায় মনিপুরী দ্রুপদী নৃত্যের মুদ্রা।

আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, মণিপুরী নৃত্যে শারীরিক অঙ্গ-প্রতঙ্গ চালনার মাধ্যমে নৃত্য শিল্পীরা বৃত্ত বা উপবৃত্ত সৃষ্টি করে। মণিপুরী নৃত্য লাস্য বা কোমল ধরণের নাচ হিসেবে পরিচিত। চমৎকার পোষাক, শারীরিক ভঙ্গিমা, সৌন্দর্য ও নিবেদনের আকুতি প্রকাশ পায় এই নৃত্যে। সারা রাত জেগে এই নৃত্য উপভোগ করার পরও এতোটুকু ক্লান্তি ভর করেনি আমাদের। সত্যিকার শিল্পের অসাধারণ প্রসাদ গুণ!

মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে আমি ও হালিম ভাই চা পান অব্যাহত রেখেছি। আমাদের সিলেটের বন্ধু জীবনের আসতে অনেক দেরী হয়। গাড়িতে কী সমস্যা ছিলো! যাক তারপরেও দেখা হয়। জীবন বারবার দুঃখ প্রকাশ করে দেরি হওয়ার জন্য। আমরা বলি, চিন্তার কিছু নেই আমরা তো রাসলীলায় আছি!

সারারাত ধরে ছোট্ট দুটো মেয়ে, কয়েকটি কিশোরী ও তরুণী নেচে গেলো রাস নৃত্য। এতোটুকু ক্লান্তি ভর করেনি তাদের মধ্যেও। নৃত্যকলা যতোটুকু উপলব্ধি করতে পারি তার উপর ভরসা রেখে বলতে পারি, এই শিল্পীদের নাচের তাল ও তার প্রকাশভঙ্গির এতোটুকু এদিক সেদিক হয়েছে বলে মনে হয়নি। মাঠজুড়ে মেইতেই-বাঙালি শত শত দর্শকও সারা রাত জেগে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন। এই রাস উৎসব চমৎকার এক রঙিন মিলনমেলায় পরিণত হয় এই সময়। মনে হলো, বিদেশী পর্যটকদের কাছে এটি দারুণ আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য ইভেন্ট হতে পারে। এর ব্যাপক প্রচার হওয়া উচিত। পর্যটকদের যাতায়াত ও থাকার যথাযথ ব্যবস্থা করলে দেশী-বিদেশী অনেকেই এই অনুষ্ঠান দারুণ উপভোগ করতে আসবেন প্রতিবছর।

ভোর হয়ে এলো। এবার আমাদের ফিরতে হবে। রাত জাগার ক্লান্তি জুড়োতে একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। বিকেলে শ্রীমঙ্গল থেকে ট্রেন ধরার কথা। আমরা আদমপুর বাজারে এসে জীপের খোঁজ করি। জীপ এখনো চলাচল শুরু করেনি। একটা মিশুক আসে, সেটাতে চড়ে বসি, ভানুগাছ পর্যন্ত যাবে এটা। ভানুগাছ থেকে জীপ বা বাসে চড়ে শ্রীমঙ্গল যাওয়া যাবে। আমরা যখন ভানুগাছের দিকে রওনা হলাম, তথনো ঢাকের শব্দ আসছিলো অর্থাৎ রাসনৃত্য তখনো শেষ হয়নি। হয়তো একটু পরেই শেষ হবে ধ্রুপদী এই নৃত্যের উৎসব। ভাঙবে বহু মানুষের মিলনমেলা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com