মেদা হোসাইনি নভোচারী হতে চেয়েছিল এবং এজন্য এমনকি নাসার কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল।
আফগানিস্তানের ১৭ বছরের এক তরুণীর জন্য এটি ধরা-ছোঁয়ার বাইরের স্বপ্ন বলেই মনে হবে, কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা ছিল আকাশ-ছোঁয়া।
এমনকি ২০২১ সালে যখন তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিল এবং তার পরিবারকে ইরানে পালিয়ে যেতে হলো, তখনও মেদা নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন ছাড়েনি।
ইউরোপে পৌঁছে লেখাপড়া শেষ করবে, এটাই ছিল তার লক্ষ্য।
মেদা স্থলপথে তুরস্ক গিয়ে সেখান থেকে সাগর পথে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
মেদার মা এ নিয়ে সাংঘাতিক উদ্বিগ্ন ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে রাজী করায় সে।
“আমি তাকে বললাম, তুমি যাও, আল্লাহই তোমাকে রক্ষা করবে”, বলছিলেন মাহতাব ফরোগ। “ও খুব আত্মবিশ্বাসী ছিল। আমি ওর মা, আমি ওকে বড় করেছি।”
প্রায় দুশো মানুষ নিয়ে তুরস্ক থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি যে কাঠের নৌকাটি যাত্রা শুরু করে, মেদাও ছিল সেই নৌকায়। চারদিন পর ইতালির ক্রোটোন উপকুলের কাছে এটি ডুবে যায়।
“হ্যালো মা, আশা করি ঠিকঠাক আছো। আমিও ভালোই আছি, এখনো নৌকায়। আর তিরিশ মিনিট পর আমরা তীরে ভিড়বো”- এটাই ছিল মায়ের ফোনে রাখা মেদার শেষ ভয়েস মেসেজ। ওর গলার পেছনে নৌকার ইঞ্জিন এবং সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
এর অল্প পরেই এলো একটি সংক্ষিপ্ত টেক্সট মেসেজ।
“প্রাণপ্রিয় মা, আমি প্রায় ইতালি পৌঁছে গেছি। শীঘ্রই নামবো। সুস্থ এবং ভালো আছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।”
কম বয়সী মেয়েদের একাকী ভ্রমণ করার ঘটনা বেশ বিরল, কারণ এতে অনেক বেশি ঝুঁকি। কিন্তু মাহতাব জানান, তার মেয়ে ছিল বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এর সাত মাস আগে মেদা যখন ইরান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে তুরস্কে ঢোকে, তখন তার পায়ে গুলি লেগেছিল। তার পায়ের ভেতরে যে ১০ দিন ধরে একটা গুলি রয়ে গিয়েছিল, সেটা তাকে থামাতে পারেনি।
মেদার পরিবার জানায়, এর আগেও মেদা ইউরোপে পৌঁছানোর জন্য বেশ কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।
“আমি ওকে নিয়ে খুব চিন্তা করতাম। আমি ওকে ইরানে ফিরে আসতে বলেছিলাম” , বলছিলেন মেদার মা মাহতাব। “আমি ওকে বলেছিলাম, এভাবে ভিনদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে তোমার হয়রান লাগে না?”
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অন্তত ৭০ জন মারা গেছে। মেদার দেহ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যেসব আফগান ইউরোপে পৌঁছাতে চায়, তারা মূলত তুরস্ক হয়ে যায়। এরা হয় তুরস্ক হতে বলকান দেশগুলোর ভেতর দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে, অথবা সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির মতো কোন দেশে গিয়ে নামে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে এবং সুইজারল্যান্ড ও নরওয়েতে ২০২২ সালে যত মানুষ আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে, তাদের ১৩ শতাংশই আফগান।
একজন ইরানি শেষ মূহুর্তে এই বিপদজনক যাত্রায় শরিক হতে চায়নি।
সামান, যেটি তার আসল নাম নয়, জানালো তাদেরকে বলা হয়েছিল নৌকাটিতে ৬০ বা ৭০ জন লোক থাকবে।
“কিন্তু যে রাতে আমাদের ইস্তাম্বুল থেকে একটি লরিতে চেপে ইজমির যাওয়ার কথা, সেদিন আমরা বুঝতে পারলাম, সেখানে অন্তত ১১৭ জন মানুষ আছে, যাদের বেশিরভাগই আফগান পরিবার।”
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা থেকে সামান রক্ষা পেয়েছেন, কিন্তু এটি এখনো তাকে তাড়া করছে।
তিনি বলেন, “এটা ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মতো। আমি এখনো এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এখন আর কিছুতেই বিশ্বাস রাখতে পারছি না। জীবন আসলে অর্থহীন।”
বেঁচে যাওয়া দুজন মানুষ বিবিসিকে জানিয়েছেন, নৌকাটি তুরস্কের উপকূল ছাড়ার অল্প পরেই ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়।
মানব পাচারকারীরা এরপর আরেকটি নৌকা পাঠায় এবং সবাইকে সেটিতে তোলে।
বেঁচে যাওয়া এক আফগান, যাকে এখানে আমরা মেরাজ বলে উল্লেখ করছি, জানিয়েছেন, সমুদ্র বেশ উত্তাল ছিল। তবে তীরের কাছাকাছি আসার পর তারা ছিলেন বেশ উৎফুল্ল।
“এরপর আরেকটা নৌকা আমাদের দিকে আসলো এবং সেটির আলো আমাদের নৌকার ওপর ফেললো। তখন আমাদের নৌকার ক্যাপ্টেন ভয় পেয়ে গেল এবং দ্রুত নৌকার দিক পরিবর্তন করার চেষ্টা করলো”, বলছিলেন তিনি।
“আমাদের নৌকা একপাক ঘুরলো, তারপর আবার আরেক পাক। তৃতীয় বার ঘোরার সময় এটি শক্ত কিছুতে ধাক্কা খেলো, তারপর ভেঙ্গে পড়লো। নৌকার নীচের ডেকে ছিল শিশুসহ পরিবারগুলো, আর ওপরের ডেকে পুরুষরা এবং একা যাচ্ছে এমন অভিবাসীরা”, বলছিলেন তিনি।
“আমার মনে আছে, নৌকায় পানি ঢুকছিল। এক পর্যায়ে পানি আমার ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছালো। তখন আমি তেলের গন্ধ পেলাম এবং জ্ঞান হারালাম। এরপর কী ঘটেছিল আমার মনে নেই।”
মেরাজ ভেসে এসেছিলেন সাগরতীরে। তিনি বেঁচে যাওয়া ৮০ জনের একজন। তার যেসব আত্মীয়-পরিজন ঐ নৌকায় ছিলেন, তাদের ভাগ্য কী ঘটেছে, এখনো জানা যায়নি।
ইতালির কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে তাদের একজন তুর্কি পুরুষ, দুজন পাকিস্তানি। এরা ডুবে যাওয়া নৌকাটির নাবিক বলে মনে করা হয়। ই
তালির পুলিশের ধারণা, এই নৌকায় করে ইতালি আসার জন্য জনপ্রতি প্রায় সাড়ে আট হাজার ডলার করে নেয়া হয়েছিল।
মনিটরিং গ্রুপগুলোর অনুমান, ২০১৪ সালের পর হতে এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে এভাবে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা গেছে।
এই নৌকাডুবির খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার-পরিজনরা দক্ষিণ ইতালিতে এসে জড়ো হতে শুরু করে। এরা তাদের নিখোঁজ আত্মীয়দের সন্ধান করছিল।
লাইলা টিমোরি (৪৭) জার্মানি থেকে এক নাগাড়ে গাড়ি চালিয়ে এসেছেন।
“আমি ভেবেছিলাম, বহু বছর পর আমার ভাইকে দেখতে পাবো। ওকে দেখার জন্য আমি সাত বছর অপেক্ষা করেছি।”
লায়লা আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশ থেকে পালিয়ে আসেন ২০১৫ সালে। ভাই জাবিহ এর সঙ্গে বিদায় বেলার স্মৃতি এখনো তার মনে আছে।
“ভবিষ্যতে আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে এই ভেবে আমরা পরস্পরকে মাফ করে দিতে বলেছিলাম।”
জাবিহ টিমোরি (৩৩), তার স্ত্রী মিনা (২৩) এবং তাদের ছেলে হাসিব, আরিফ এবং আকিফ ছিলেন ঐ নৌকায়।
লায়লা জানান, জাবিহ ছিলেন একজন আইনজীবী। এর আগের আফগান সরকারগুলোর সঙ্গে কাজ করেছেন। তালেবান তার ক্ষতি করতে পারে বলে আশংকায় ছিলেন তিনি।
“আমি যখন ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালাম, তখন প্রথমেই চোখে পড়লো আমার ১৮ মাস বয়সী ভাগ্নে হাসিবের দেহ”, বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।
“ইতালির কর্তৃপক্ষ আমাকে একটা রুমে নিয়ে কিছু ছবি দিল শনাক্ত করার জন্য। মৃত মানুষদের ছবি, হাসপাতালে ভর্তি করা মানুষের ছবি, এবং ক্যাম্পে রাখা বেঁচে যাওয়া মানুষদের ছবি। কিন্তু আমি আমার পরিবারের বাকীদের দেখতে পাইনি।”
লায়লা এরপর সাগর সৈকতে গিয়ে তাদের খুঁজতে থাকেন।
“আমি তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমি নৌকার ধ্বংসাবশেষ দেখেছি, কাপড়-চোপড় দেখেছি। আমার মনে হচ্ছিল আমার ভাই হয়তো বালির নীচে চাপা পড়ে আছে। ও হয়তো আমার সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছে”, বলছিলেন তিনি।
“আমি কেবল ওর জুতো জোড়া খুঁজে পেয়েছিলাম। পরে আমি একটা জাম্পার এবং ওর স্ত্রীর ব্যাগ খুঁজে পাই।”
ওদের আর কোন চিহ্ণ খুঁজে পাননি লায়লা এবং তার মেয়ে। তাদের একমাত্র আশা- কোন একদিন হয়তো ওদের দেহ ভেসে আসবে তীরে।
“এটা খুবই কষ্টের। আমরা শুনেছি নৌকার অর্ধেক লোক পানিতে ডুবে মারা গেছে, সাগরে তলায় পড়ে আছে। কিছু কিছু মানুষের দেহ চেনাই যাচ্ছে না এত দীর্ঘ সময় পানিতে থাকার কারণে,” বলছেন লায়লা।
“আমরা শুধু চাই আমাদের প্রিয়জনদের দেহ যেন অন্তত পাওয়া যায়। যেন ওদের কবর দেয়ার জন্য দেশে ফেরত পাঠাতে পারি, যেন তারা শান্তিতে চিরদিনের জন্য ঘুমাতে পারে।”
এদিকে ইরানে মেদার বাবা-মা এখনো একটা ভালো খবরের অপেক্ষায় আছেন। তারা যেহেতু ইরানে আফগান শরণার্থী হিসেবে থাকেন, তাই ইতালিতে এসে মেয়েকে খোঁজার জন্য ভিসা পাননি তারা।
“আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি,” বলছিলেন মেদার মা মাহতাব। “আমি এখনো কাউকে ওর জানাজা পড়তে দেইনি। কাউকে এখনো পর্যন্ত ওর জন্য শোক করতে দেইনি।”
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা নেয়ার পর অনেক মেয়ে তাদের শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
বয়স ১৮ হওয়ার আগেই মেদা চেয়েছিল ইউরোপে পৌঁছাতে। আশা করেছিল পরে তার বাবা-মা এবং ভাই-বোনরা তার সঙ্গে যোগ দিতে পারবে।
“ও সবসময় আমাকে বলতো, মা, দয়া করে আমাকে তোমার মতো অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিও না” বলছিলেন মাহতাব।
“ও বলতো, আমি অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। আমি জানি আমার বাবা একজন সাধারণ শ্রমিক এবং তিনি বেশি কিছু করতে পারবেন না। তাই সফল হওয়ার জন্য আমাকে বিদেশে যেতেই হবে।”
বিবিসি