মালেশিয়া থেকে ফিরে: ঘুম জড়ানো চোখে বিমানের জানালায় তাকিয়ে দেখি আধো আলো, আধো অন্ধকার। শান্ত, ঘুমন্ত এক শহর। শুরু হলো এনাউন্সমেন্ট। “ভুমি থেকে ৩৬০০ফিট উপরে, এয়ার এশিয়ার ফ্লাইট AK70 এই মূহুর্তে মালেশিয়ার সীমানায় প্রবেশ করেছে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা পৌছে যাবো দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুরে। আবহাওয়া পরিস্কার। বিমান অবতরনের সময় সিট বেল্ট লাগিয়ে ফেলুন, বন্ধ রাখুন সব ধরনের ইলেক্ট্রোনিক্স ডিভাস। এয়ার এশিয়ায় ভ্রমনের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আশা করছি আবারো দেখা হবে”। পরিচ্ছন্ন ইংরেজীতে কথাগুলো বলছিলেন ভারতীয় বংশদ্ভুত এয়ার এশিয়ার বিমানবালা ‘মেঘা’ ।
অবতরন শেষ, ভালভাবেই ভূমিস্পর্শ করলাম আমরা। বিমান থেকে বেড়িয়ে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ২’এর লম্বা লবিতে হাটছি। সব কিছু অচেনা। আমার লাগেজটাও সাথে নেই।এক নিরাপত্তা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করলাম, লাগেজটা কোথায় পাবো। ইংরেজিতে বলেছি, সে ঠিক বুঝেছে কিনা জানিনা। উত্তরে সে বললো, দিস ওয়ে ইমিগ্রেশন। বুঝতে পেলাম আগে ইমিগ্রেশন শেষ করতে হবে। হাটতে হাটতে দু’চার জন সহ যাত্রীকে দেখতে পেলাম। আমরা একই দেশ থেকে একই বিমানে এসেছি। এবার তাদের পিছু পিছু হাটছি। নিয়ম কানুন কিছুই জানিনা। এ দেশে আচার-আচরন কোনটি ভাল, কোনটি খারাপ তাও জানিনা। এই আমার আতংক। ইমিগ্রেশনে দাড়িয়েছি। এখানেও আতংক আমার পিছু ছারছেনা। আমার সারির পেছনে শ্রমিক গোছে দু’তিন জন বাংলাদেশিকে নিয়ে গেল ইমিগ্রেশন পুলিশ।তাদের অন্য সারিতে দাড় করানো হয়েছে। সবুজ পাসপোর্ট ধারিদের এভাবে কেন আলাদা করা হচ্ছে, এই মুহুর্তে শধু এটাই আমার প্রশ্ন। সে প্রশ্ন কাকে করবো, কে এর যোগ্য উত্তর দিতে পারবে, তাই খুজছি। পেলামা না। কিন্ত আত্ম সন্মানের কথা ভেবেই এক ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তাকে ডাকলাম। বিনয়ের সাথে কথা বললাম তার সাথে, “ক্ষমা করবেন অফিসার। আমি একজন বাংলাদেশি। এদেশে ঘুরতে এসেছি। এটিই প্রথম বিদেশ সফর। আমার জন্য কি কোন নির্দেশনা রয়েছে?” আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে পুলিশ্ কর্মকর্তা বললো, না। কিন্তু কেন আপনি এ প্রশ্ন করলেন?” আমি বাংলাদেশি সহযাত্রীদের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। “তাদের ব্যাপারে আমাদের কিছু জানার আছে এজন্য তাদের আলাদা করা হয়েছে, দয়া করে আপনি ইমেগ্রেশন শেষ করুন। মালেশিয়ায় আপনাকে স্বাগতম”। হাসি মুখে পুলিশ অফিসার বিদায় নিলেন।
ইমেগ্রেশন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কম বয়সি মহিলা পুলিশ। অনেক চেষ্টা করেও মুখে কাঠিন্য ধারন করতে পারছেন না তিনি। আমি খুব একগাল হেসে বললাম “শুভ সকাল”। সে কথায় পাত্তা না দিয়েই মুখ কঠিন করে বললেন, “পাসপোর্ট”। আমি পাসপোর্ট এগিয়ে দিয়ে তার আঙ্গুলে থাকা আংটিটির প্রশংসা করলাম। এবার ঠোটের কোণায় হাসি দেখা গেলো। ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া জন্য বললেন তিনি। প্রথম বার দিয়েছি হয়নি। আরো শক্ত করে দাও। আমি আরো শক্ত করে দিয়ে বললাম, আমি এর চেয়ে বেশি শক্ত পছন্দ করতে পারিনা। মেয়ের দাত এতোক্ষনে দেখা গেল। এক গাল হাসি দিয়ে পাসপোর্ট আমার হাতে ফিরেয়ে দিল। বললো, ইমিগ্রেশন কমপ্লিট, থেঙ্কইউ। আমি বললাম, তোমাকেও। সামান্য বিনোদন। কিন্তু আমার স্নায়ুচাপ মোটামুটি কেটে গেছে। লাগেজটাও সহজেই পেয়ে গেলাম। এবার একটা মোবাইল সিম কিনতে হবে। তার পর ফোন করে উঠতে হবে এক আত্মিয়ের বাসায়।আপাতত এতোটুকুই কাজ।
ঠিকানা বুঝে এয়ারপোর্ট থেকে বাসে উঠেছি। প্রসস্থ একমুখি রাস্তায় ছুটে চলেছে গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে চোখে পরছে পাম গাছ। উচু এক বিলবোর্ড দৃর্ষ্টি আকর্ষন করলো। এখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির নারী পুরুষদের পাশাপাশি দাড় করিয়ে লিখা আছে, সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষদের মালেশিয়ায় স্বাগত জানাই। এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে প্রায় ২০ মিনিট বিরামহীন ছুটে চলেছে গাড়ি। একটি বসত বাড়িও চোখে পরলো না। ঢাকার মতো ঘন বসতিতে থাকা এক নাগরিকের জন্য এটি আশ্চোর্যের।
পরিপাটি পথঘাট আর নিয়ন্ত্রিত যান চলাচল আমাকে মুগ্ধ করলো। কেএল সেন্টারে নেমে ট্যাক্সি নিলাম। ট্যাক্সিচালক মালেশিয়ার নাগরিক, মোটামুটি ইংরেজি পারে। বেশ কিছুক্ষন কথা হলো তার সাথে। জানতে চাইলাম, দিনযাপনে কতটুকু খুশি সে? বলল, পরিবার নিয়ে বেশ ভালই থাকে। মাঝে মাঝে তার কাজে না গেলেও হয়। তার পরিবারও উপার্জন করে। আমার সাথে কথা বলে সেও বেশ খুশি। একদম আনাড়ি ঘোছের কোন মানুষকে কিছু শিখাতে পারলে যেমন মজা পাওয়া যায় ট্যাক্সি চালক এখন সে আনন্দই উপভোগ করছে। তারা কোনটি পছন্দ করে কোনটি করেনা জানার চেষ্টা করলাম। ড্রাইভারের নাম ইব্রাহিম। নির্দেশনা মত একটি হোটেলের সামনে এসে আমাকে বিদায় জানালো সে। এবার খুজে খুজে বেড় করলাম কাংখিত ঠিকানা। ফ্লাট নাম্বর অনুযায়ী গিয়ে দেখি আমার জন্য দরজা খুলে রাখা হয়েছে। ভেতর থেকে ডাক এলো, “ভাইগনা আসো। তোমার পরীক্ষা নিলাম। তুমি পাশ করছো”।যাক এতোক্ষনের দুশ্চিন্তার অবসান। তবে ভীনদেশী শহরে আগুন্তুক আমি অনিশ্চয়তার এই সময়টুকু বেশ ভালই উপভোগ করেছি।
আফজালুর রহমান