ভারতের অভ্যন্তরীণ যাত্রাপথে প্রিমিয়াম ইকোনমি সেবা প্রদানকারী প্রথম এয়ারলাইন ভিসতারা । ভিসতারা হিসাবে পরিচালিত হলেও এই বিমান সংস্থাটি মূলত টাটা এসআইএ এয়ারলাইন্স লিমিটেড। ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি টাটা সন্স এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের যৌথ উদ্যোগে ক্যারিয়ারটি দিল্লি-মুম্বাইয়ের উদ্বোধনী বিমানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল।
ভিসতারা এয়ারলাইনসের দুই সংখ্যার (IATA) কোড UK। তাদের কল সাইন হলো ভিসতারা (VISTARA)। ২০১৬ সালের জুন মাসের মধ্যেই এই এয়ারলাইনস দুই মিলিয়নেরও বেশি যাত্রী বহন করেছিল। ২০১৯ সালের মে মাসের তথ্য অনুযায়ী দেশীয় ক্যারিয়ার মার্কেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ শেয়ারের ভাগ নিয়ে ভিসতারা দেশটির ষষ্ঠ আভ্যন্তরীণ এয়ারলাইন্সে পরিণত হয়েছে।
ভিসতারা তথা টাটা এসআইএ লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগের সাধারণ লক্ষ্য হলো ভারতীয় ভ্রমণকারীদের একটি নির্বিঘ্ন এবং ব্যক্তিগত পছন্দসই বিমানের অভিজ্ঞতা প্রদান করা। ভিসতারা ব্র্যান্ড নামটি সংস্কৃত শব্দ ‘ভিস্তার’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘একটি সীমাহীন বিস্তৃতি’।
ভিসতারা নামটি অনুপ্রেরণা আসে সেই বিশ্ব থেকে যেখানে ভিসতারা বাস করে; ভিজ, যার অর্থ ‘সীমাহীন’ আকাশ। ভিসতারা ভারতে ভ্রমণকারীদের উড়ার অভিজ্ঞতাকে রূপান্তর করার লক্ষ্য হিসাবে, তাদের ব্র্যান্ডের ট্যাগলাইনটিকে ‘নতুন অনুভূতি উড়ান’ (Fly the new feeling) হিসাবে নামকরণ করে।
ইতিহাস :
টাটা সন্স এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের (এসআইএ)-মধ্যে একটি যৌথ উদ্যোগ হিসাবে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিমান সংস্থাটি। দুটি সংস্থাই ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে একটি সম্পূর্ণ পরিষেবা বাহক চালু করার জন্য একটি উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করেছিল, যা ভারত সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রক অনুমোদনের বিষয়টিকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১২ সালে ভারত ৪৯ শতাংশ বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগের (এফডিআই) জন্য বিমান সংস্থা খাত চালু করার সাথে সাথে টাটা এবং এসআইএ আবারও ভারতে একটি যৌথ উদ্যোগ নিয়ে বিমান সংস্থাকে দাড় করানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
কম দামের ক্যারিয়ারের অধ্যুষিত ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচলের বাজারে উচ্চ-পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের চাহিদা মেটাতে প্রিমিয়াম পূর্ণ-পরিষেবা বাহক হিসাবে কল্পনা করা হয়েছিল এই যৌথ উদ্যোগ, টাটা এসআইএ এয়ারলাইন্স লিমিটেড (টিএসএল)।
ভারতের বিদেশী বিনিয়োগ প্রচার বোর্ড ২০১৩ সালের অক্টোবরে যৌথ উদ্যোগটিকে অনুমোদন করে, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসকে ৪৯ শতাংশ অংশীদারিত্বের অনুমতি দেয়। দুটি মূল সংস্থা প্রাথমিকভাবে প্রারম্ভকালীন মূলধন হিসাবে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, টাটা সন্সের ৫১ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বাকী ৪৯ শতাংশ মালিকানা রয়েছে।
এই বিমান সংস্থাটি এয়ার এশিয়া ভারতে সংখ্যালঘু অংশীদারিত্বসহ বিমান খাতে টাটা কোম্পানির দ্বিতীয় বড় প্রচারের অংশ ছিল। তাদের প্রথম উদ্যোগ, টাটা এয়ারলাইনস ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পরে জাতীয়করণের পরে পতাকাবাহী এয়ার ইন্ডিয়ায় পরিণত হয়েছিল।
২০১৪ সালের ১১ আগস্ট টাটা এসআইএ এয়ারলাইন্স লিমিটেড (টিএসএল) তাদের ব্র্যান্ড পরিচয় ‘ভিসতারা’ উন্মোচন করে। ভিসতারা ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিভিল এভিয়েশন ডিরেক্টর জেনারেল থেকে এয়ার অপারেটরের সার্টিফিকেট পায় এবং ২০১৫ এর ৯ জানুয়ারীতে কার্যক্রম শুরু করে।
মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল ২-এর বাইরে আভ্যন্তরীণ পরিষেবা পরিচালনার জন্য প্রথম বাহক হয়ে উঠেছে ভিসতারা। ২০১৫ এর ২৪ আগস্ট, ভিসতারা এর ককপিট এবং কেবিন ক্রু, সুরক্ষা কর্মচারী এবং বিমান চলাচল সম্পর্কিত অন্যান্যদের প্রশিক্ষণের জন্য অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থা, এভিয়েশন সুরক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট উদ্বোধন করে।
ইনস্টিটিউটটি নোডাল বডি ব্যুরো অফ সিভিল এভিয়েশন সিকিউরিটির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেয়েছে। পরিচালনার প্রথম মাস থেকে ভিসতারা ধারাবাহিকভাবে ৯০ শতাংশেরও বেশি সময়োত্তর পারফরম্যান্সের রেকর্ড অর্জন করেছিল, যা ভারতের ডমেস্টিক ক্যারিয়ারের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০ আগস্ট ২০১৫-তে, ভিসতারা ঘোষণা করে যে, এটি মাত্র সাত মাসের বেশি অভিযানে অর্ধ মিলিয়ন যাত্রী বহন করেছে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত, ডমেস্টিক ক্যারিয়ার মার্কেটে ভিসতারার ভাগ রয়েছে ২ শতাংশ। ভিসতারা সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (IATA)-এর সদস্যপদ লাভ করেছে, বিশ্বজুড়ে ২৮০টিরও বেশি এয়ারলাইন্স যে সংঘে যোগদান করে। আইএটিএ বিমান সংস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে, নেতৃত্ব দেয় এবং সেবা দেয়। এর সাথে, ভিসতারা আইএটিএ’র সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ভারতের অন্যতম একটি নির্বাচিত বিমান সংস্থায় পরিণত হয়।
বিমান বহর :
জুলাই ২০২০ অনুযায়ী ভিসতারা এয়ারলাইনসের এর বহর মোট ৪৩টি ইন-সার্ভিস বিমান নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে ১৮০ জন যাত্রী বহনক্ষমতা সম্পন্ন এয়ারবাস এ৩২০-২০০ রয়েছে ১৩টি এবং ১৮৬ জন যাত্রী বহনক্ষমতা সম্পন্ন এয়ারবাস এ৩২০নিও রয়েছে ২০টি, এয়ারবাস এ৩২১ নিও রয়েছে ১টি, বোয়িং ৭৩৭-৮০০ রয়েছে টি এবং বোয়িং ৭৮৭-৯ রয়েছে ২টি। এছাড়া তারা আরও ৪০টি এয়ারবাস এ৩২০নিও, ৫টি এয়ারবাস এ৩২১নিও এবং ৪টি বোয়িং ৭৮৭-৯ এর অর্ডার দিয়েছে।
গন্তব্য সমূহ :
ভিসতারা এয়ারলাইন্স ২০২০ সালের আগস্ট মাসের তথ্য অনুযায়ী ৩৫টি গন্তব্যে দৈনিক তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৩০টি অভ্যন্তরীন গন্তব্য (ভারতের ভেতরে) এবং ৫টি আন্তর্জাতিক গন্তব্য রয়েছে।
ভারতের মধ্যে ভিসতারা এয়ারলাইনসের গন্তব্যগুলো হলো আহমেদাবাদ, অমৃতসর, বাগডোগরা, বেঙ্গালুরু, ভুবনেশ্বর, চন্ডীগড়, চেন্নাই, দেরাদুন, দিব্রুগড়, গোয়া, গোয়াহাটি, হায়েদ্রাবাদ, ইন্দোর, জাম্মু, যোধপুর, কোচি, কোলকাতা, লেহ, লখনৌ, মুম্বাই, নিউ দিল্লী, পাটনা, পোর্ট ব্লেয়ার, পুনে, রায়পুর, রাঁচি, শ্রীনগর, থিরুভানান্থাপুরাম, বারানসি ও উদয়পুর। আন্তর্জাতিক গন্তব্যস্থান গুলো হলো কাঠমুন্ডু, সিঙ্গাপুর, কলম্বো, ব্যাংকক ও দুবাই।
সেবা সমূহ :
ভিসতারা এর ককপিট এবং কেবিন ক্রু, সুরক্ষা কর্মচারী এবং বিমান চলাচল সম্পর্কিত অন্যান্যদের প্রশিক্ষণের জন্য নিজস্ব এভিয়েশন সুরক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে। যার ফলে তাদের বিমানবালাসহ সকলেই অভিজ্ঞ, দায়িত্বশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ।
বিজনেস শ্রেণীতে একটি পূর্ণ সেবাদানকারী বাহক হিসেবে ভিসতারা ১৬টি বিজনেস শ্রেণীর আসন প্রদান করে । বিজনেস শ্রেণীর আসনগুলো ৪২ ইঞ্চি উঁচু এবং ২০.১২ ইঞ্চি চওড়া । বর্তমানে কোনও আসনের সাথে এলসিডি স্ক্রীণ সংযুক্ত নেই কিন্তু এই শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য ট্যাবলেট ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে।
ভিসতারা ভারতের প্রথম এয়ারলাইন যা দেশীয় বাজারে প্রিমিয়াম ইকোনমি শ্রেণী চালু করে ৷ বর্তমানে এটি ৩৬টি প্রিমিয়াম ইকোনমি আসন সুবিধা প্রদান করে ৷ প্রিমিয়াম ইকোনমির প্রতিটি আসন ৩৩ থেকে ৩৬ ইঞ্চি উঁচু এবং ১৮ ইঞ্চি চওড়া ৷
২০১৬ সালের মার্চ হতে ভিসতারা একমুখী ওয়াইফাই সংযোগ সুবিধার মাধ্যমে সরাসরি বিনোদনমূলক অডিও, ভিডিও কিংবা অন্যান্য ফাইল যাত্রীদের ব্যক্তিগত ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে (ট্যাবলেট এবং স্মার্ট ফোন) প্রদান করা শুরু করেছে ৷ বিজনেজ শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য বিনোদন বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ ট্যাবলেট সুবিধা প্রদান করা হয় ৷
ভিসতারা এয়ারলাইনসে ভ্রমণাবস্থায় যে খাবার পরিবেশিত হয়, তা তাজসেটস এয়ার ক্যাটারিং দ্বারা প্রস্তুত করা হয় ৷ এর দায়িত্বে রয়েছেন শেফ অরুণ বাত্রা, পূর্বে যিনি তাজ হোটেল গ্রুপ এর একজন শেফ হিসেবে কাজ করেছেন৷ ভিসতারা প্রতিটি কেবিনের জন্য দিনের বিভিন্ন সময়ে ব্রেকফাস্ট, জলখাবার, লাঞ্চ এবং ডিনার এই খাবারগুলো পরিবেশন করে । আমিষ কিংবা নিরামিষ দু-ধরনের খাদ্যই পরিবেশন করা হয়ে থাকে । এছাড়াও যাত্রীদের চাহিদা ও অর্ডার অনুসারে স্পেশাল নাস্তা প্রদানের সুবিধাও রয়েছে।
পুরস্কার অর্জন :
শীর্ষস্থানীয় এয়ারলাইনস (২০১৬, ২০১৭) : ট্রিপঅ্যাডভাইজার
শ্রেষ্ঠ ডমেস্টিক এয়ারলাইন (২০১৬, ২০১৭) : রিডার্স পোল বাই ট্রাভেল ও লেইজার ইন্ডিয়া এ্যান্ড সাউথ এশিয়া
শ্রেষ্ঠ ডমেস্টিক এয়ারলাইনস, ২০১৭ : আন্তর্জাতিক পর্যটন ও সমঝোতা স্মারক
জনপ্রিয় ডমেস্টিক এয়ারলাইনস (২০১৮, ২০১৯) : কন্ডে নাস্ট ট্রাভেলার রিডার্স ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডস
শ্রেষ্ঠ এয়ারলাইনস, ২০১৮ : স্কাইট্র্যাক্স
ট্রাভেলার্স চয়েজ উইনার (ইকোনমি ক্লাস), ২০১৮ : ট্রিপঅ্যাডভাইজার ট্রাভেলার্স চয়েজ অ্যাওয়ার্ডস
শ্রেষ্ঠ এয়ারলাইনস – ডমেস্টিক, ২০১৯ – টাইমস ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডস