বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা শেখা এবং বাংলাদেশে পড়াশোনার জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন শিক্ষার্থীরা। ভাষা আন্দোলনের মাসে বাংলা ভাষা শেখা ও বাংলাদেশে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা জানালেন ২০২২ সালে বাংলা ভাষা শেখার জন্য সুদূর চীন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে পড়তে আসা শিক্ষার্থী ইয়াং মেই ফ্যং।
গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এই চীনা ছাত্রী। ইয়াং মেই ফ্যং বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে অবস্থিত একটি দেশ, তার দীর্ঘ ইতিহাস, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং অতিথিপরায়ণ মানুষের জন্য পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বেশি সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী অনন্য সাংস্কৃতিক পরিবেশ অনুভব করতে এবং উচ্চমানের শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে অধ্যয়ন করতে বেছে নিয়েছে। ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, চীনে দুই বছর বাংলা অধ্যয়ন করার পর, অবশেষে আমি আমার স্বপ্নের সোনার দেশে প্রবেশ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাঁচ মাস ধরে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা আমার মনে পড়েছিল, যা গভীরভাবে অঙ্কিত এবং যা অপসারণ করা যাবে না।
তিনি বলেন, প্রথমে যেহেতু আমি একা এখানে এসেছিলাম এবং বাংলা ভাষার জ্ঞান খুবই সীমিত ছিল, সেই সঙ্গে আমার অন্তর্মুখী এবং ধীরে গরম হওয়া স্বভাবের কারণে, আমি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভয় পেতাম এবং অপরিচিত জায়গায় একা যেতেও ভয় পেতাম। কিন্তু বাংলাদেশিদের আতিথেয়তা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ খুব দ্রুত আমার সব চিন্তা এবং উদ্বেগ দূর করে দেয়। যখনই আমি কোনো সমস্যায় পড়তাম, আমার চারপাশে সব সময় কিছু না কিছু সাহায্যকারী বাংলাদেশি থাকত, এমনকি আমরা একে অপরকে চিনতাম না, তবু তারা আমার বিদেশি পরিচয় নিয়ে কোনো সমস্যা করেনি, বরং আমাকে আন্তরিকভাবে সাহায্য করেছে, আমার বাংলাদেশ ভ্রমণকে রঙিন ফুলে ভরে দিয়েছে।
শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ আমার শিক্ষকদের কাছে। তাঁদের অত্যন্ত পেশাদার শিক্ষাদানের দক্ষতা ছিল, তাঁরা আমাকে জ্ঞান দান করেছেন, আমার সন্দেহ দূর করেছেন এবং আমাকে বাংলা ভাষা, কবিতা, উপন্যাস, সংগীত, ইতিহাস এবং সাহিত্যের সৌন্দর্য অনুভব করতে সাহায্য করেছেন। একই সময়ে তাঁরা আমার চিন্তাগুলো বুঝতে পেরে আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাষা শেখার সময় ভুল বলা ভয়ানক নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো বেশি বলা’। তাঁরা আমাকে আমার অন্তর্মুখিতা এবং ভয় কাটিয়ে উঠতে উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা আমার সঙ্গে বাংলা ভাষা অনুশীলন করেছেন, আমাকে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতি অনুভব করতে সাহায্য করেছেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন, যা বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার বাস্তব ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁরা আমাকে অত্যন্ত সাহস এবং আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন, যা আমাকে বাংলা ভাষা শেখার পথে সম্ভাব্য বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে সাহায্য করেছেন এবং বাংলা ভাষা শেখার পথে অটল থাকতে সাহায্য করেছেন। আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে আমি এমন অসাধারণ শিক্ষকদের পেয়েছি, যাঁরা আমার বাংলা ভাষা শেখার পথে একটি আলোর মতো, আমাকে ক্রমাগত উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশিদের পোশাক ও খাবার নিয়ে ইয়াং মেই বলেন, বাংলাদেশে এসে রাস্তায় হাঁটার সময়, চারপাশের মানুষের পোশাক সত্যিই চোখে পড়ার মতো। ছেলেদের প্রধান পোশাক হলো পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, টি-শার্ট এবং জিন্স। মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো শাড়ি, যা বিভিন্ন সুন্দর কানের দুল, হার এবং ব্রেসলেটের সঙ্গে পরা হয়। কেউ কেউ ট্রি-পিস পরেন (কামিজ, সালোয়ার এবং ওড়না) এবং কারও হাতে সুন্দরভাবে ডিজাইন করা মেহেদির নকশা থাকে, যা খুবই সুন্দর দেখায়। ক্লাস শেষে বন্ধুরা আমাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার এবং রাস্তার খাবার খুঁজে বের করতে নিয়ে যায়, স্থানীয় বিশেষ খাবার যেমন বিরিয়ানি, খিচুড়ি, কারির মাংস, বিভিন্ন রকমের নান রুটি এবং মিষ্টি ছাড়াও রাস্তার খাবার যেমন ফুচকা, ঝালমুড়ি, মসলার সঙ্গে ফল মিশ্রণ ইত্যাদির জায়গায়। এগুলোর স্বাদও অসাধারণ। অবসর সময়ে, বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তার ধারে চা পান করতে যাওয়া। মনে হয় যে সুন্দর জীবন আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বাংলাদেশিদের আতিথেয়তা ও স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পড়াশোনার সময়টি যদিও দীর্ঘ ছিল না, তবু এটি আমাকে স্থানীয় মানুষের আতিথেয়তা অনুভব করার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেখানে মানুষের আচরণ সরল, জীবন সহজ কিন্তু পরিপূর্ণ। এখন যখন আমি সেই সময়ের কথা মনে করি, তখনো আমার শিক্ষক এবং বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশোনা এবং আড্ডার দৃশ্যগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দেশে ফিরে আসার পর প্রতিদিন আমার শিক্ষক এবং বন্ধুদের খুব মনে পড়ে এবং তাঁদের প্রত্যাশা নিয়ে আমি অবিরামভাবে বাংলা ভাষা শেখা চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে আমি বাংলা ভাষা শেখার পথে আরও এগিয়ে যাব।