আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ ছিলো ভারতের কলকাতা আর চেন্নাই শহর (তৎকালীন মাদ্রাজ শহর)।১৯৯৬ সালে। বড় ভাই বাবু ভাইয়ের অপারেশন পরবর্তী চেক-আপের জন্য কলকাতা ও মাদ্রাজে যাওয়ার দরকার ছিলো। সে সফরের সফরসঙ্গী হলাম আমি। মোট ১৮ দিনের ট্যুর। কলকাতা আর মাদ্রাজে সমান সময় থাকা। বাবু ভাই আগেই কলকাতা থেকে অপারেশন করিয়ে এসেছিলেন। কলকাতায় সব কিছু চিনতেন, জানতেন। ডাক্তারের সাথে এ্যাপযেন্টমেন্ট করে, ফিরে আসার ফ্লাইট কনফার্ম করে আমরা বাংলাদেশ বিমানে চেপে কলকাতা চলে গেলাম। সে যাত্রাটি ছিলো আমার জন্য ভয়ানক উত্তেজনা আর আগ্রহের। কারন কলকাতা তখন আমাদের স্বপ্নের জায়গা। বাংলাদেশের তরুণ সমাজে তখন কলকাতার বইয়ের জয়জয়কার। সুনীল, শীর্ষেন্দু আর সমরেশের নায়ক-নায়িকাদের আমরা বাস্তবের চরিত্রের মতো আপন মনে করতাম। অনিমেষ, ধ্রুব, জয়িতার মতো উপন্যাসের চরিত্রদের মনে হতো অতিপরিচিত কেউ। যাদের জীবনের গল্পকে নিজেদের গল্পই মনে হতো অনেকটা। সেসব উপন্যাস পড়তে পড়তে কোলকাতার অনেক জায়গার নামও তখন মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রিট, গড়ের মাঠ, গঙ্গার পার, এসপ্লানেড বা শহীদমিনার, ইডেন গার্ডেন সব যেন চেনা।
সেই যাত্রায় আমরা উঠেছিলাম ধর্মতলার মোড়ের একটা হোটেলে। বাবু ভাইয়া আগেও এই হোটেলে থেকেছিলো, তাই মোটামুটি পরিচিত হোটেল। একদম কলকাতার মতিঝিল টাইপ কেন্দ্রীয় জায়গায় বলে ভাড়াটা খুব বেশি, তবে হোটেলের রুমটা ছিলো বিশাল, আর ছাদটা যেন আকাশ ছোয়া। কলকাতার কড়কড়া গরমেও ঘরটায় ছিলো আরামদায়ক ঠান্ডা। ভাড়া ৩০০ টাকা। ৩০০ টাকা মানে কিন্তু অনেক ভাড়া। সেসময় মানুষ ৪/৫ হাজার টাকায় সংসার চালাতে পারতো। কলকাতায় ৪০-৫০ টাকার হোটেলও ছিলো। যাক, সেই শতবর্ষ পুরোনো হোটেল বিল্ডিংয়ে প্রথম কলাপসিপ্যাল গেটের লিফট্ দেখলাম। লিফট্ না বলে কপিকল বলা ভালো। চারিদিকের দেয়াল দেখা যায়। লিফট ম্যানের সাথে বাবু ভাইয়ের আগের পরিচয়। শুনলাম কোন এক সময় সেই হোটেলে ভারতীয় ক্রিকেটার চেতন শর্মা উঠেছিলো। তখন ক্রিকেটে শারজাহ কাপ বিখ্যাত টুর্নামেন্ট, সারজাহ কাপের ফাইনালে ভারত পাকিস্তানের উত্তাজনময় ফাইনাল হয়েছিলো। ভারতীয় চেতন শর্মার ওভারের শেষ বলে ৩ না ৫ রান যেন দরকার ছিলো পাকিস্তানের। সেই শেষ বলে পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াদাদ ছক্কা মেরে জিতিয়েছিলো পাকিস্তানকে। চিরশত্রুর কাছে এমন পরাজয়ে চেতন শর্মার ক্যারিয়ারের ইতি হয়ে গেছিলো সেই ম্যাচ থেকেই। হোটেলে উঠার পর লিফটম্যান নাকি জিজ্ঞেস করেছিলো চেতন শর্মাকে ঐ বলটা করার সময় কি চিন্তা করেছিলেন, চেতন শর্মা হাসতে হাসতে বলেছিলো, ‘শালে গান্ডু মেরা ক্যারিয়ার খারাপ কার দিয়া’। আমরা লিফটম্যানের কাছে সেই ঘটনা শুনে খুব হেসেছি। জাভেদ মিয়াদাদের শারজাহ কাপের শেষ বলের ফিনিশিং তখন আমাদের কাছে ইতিহাস। মজা পেয়েছি চেতন শর্মার থেকে যাওয়া একই হোটেলে থাকতে পেরে, যেন আমরাই সেই ইতিহাসের অতি ক্ষুদ্র অংশ হয়ে গেলাম।
হোটেলের দেয়াল ছিলো খুব পুরু, সেজন্য জানালা বন্ধ থাকলে রাস্তার শব্দ খুব কম শোনা যেতো, কিন্তু জানালা খোলার সাথে সাথে বাহিরের প্রচন্ড শব্দ যেন রুমের মধ্যে ঝাপিয়ে ঢুকে পড়তো। কলকাতার বিশাল আকৃতির ভাঙ্গাচোরা বাসগুলো ম্পিডব্রেকারের উপর দিয়ে ব্রেক না চেপে যাওয়ায় বিকট ধরাম শব্দে হোটেলের তিন তালার রুম থেকে চমকে উঠতে হয়েছে অনেকবার।সাথে প্রচুর হর্ণের শব্দে কান ঝালাপালা। জায়গাটা ছিলো ধর্মতলার মোড়। কলকাতার সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গা বলা যায়। কলকাতায় তখন ট্রাফিক পুলিশ হাত দিয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতো। মজার ব্যাপার বাংলাদেশে তখন ট্রাফিক লাইটের মাধ্যমে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা হতো ঢাকা শহরে। কলকাতার সবচেয়ে ব্যাস্ত রাস্তার মোড়ে প্রগৈতিহাসিক ট্রাফিক ব্যাবস্থা দেখে আমরা হাসাহাসি করেছিলাম বেশ। আর বাসগুলোর তখন সেকি ছিরি! টুটাফাটা রঙচটা বডি নিয়ে গর্তে পরলে বা স্পিড ব্রেকারে পরলে গদাম শব্দ, এখনও মনে পরে চমকে উঠি। সেসব ভাঙ্গাচুরা বাস দেখে হেসেছিও অনেক।কিন্তু এখন কলকাতায় অত্যাধুনীক ট্রাফিক ব্যাবস্থা, আর বাংলাদেশের ট্রাফিক সিস্টেম ফিরে গেছে মান্ধাতার আমলে। হাত দিয়ে গাড়ি আর দড়ি দিয়ে মটোরসাইকেল আটকাতে ব্যাস্তো ট্রাফিক পুলিশরা।
কলকাতার পুরোনো স্থ্যাপত্যসমৃদ্ধ বিল্ডিংগুলো ছিলো দেখার মতো। আমাদের হোটেলের জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যেতো সামনে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার পুরোনো অফিসের জানালার কার্নিশে বিশাল চিল (পাখি) বসে আছে। আমি অবাক হয়ে সেই চিলগুলো আর তাদের গতিবিধি দেখতে দেখতে অনেক সময় কাটিয়েছি। পুরো ধর্মতলা মোড়ে পুরোনো অনেক প্রসাদপ্রম বিল্ডিং ছিলো। বিল্ডিংগুলো যদিও তখন ছিলো জরাজীর্ন অবস্থায়, কিন্তু ঐসব বিল্ডিংয়ের অতীত যে প্রচন্ড সমৃদ্ধ ছিলো সেটা বিল্ডিংগুলোর আকার আয়তন দেখে আন্দাজ করা যেতো। বহু পরে আবার যখন কলকাতায় গিয়েছি, তখন দেখেছি সেইসব ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিংগুলো সংস্কার করে ঝাঁ চকচকে করে ফেলা হয়েছে। এদিকে আমাদের ঢাকা শহরের কত যে পুরোনো বিল্ডিং আমরা ভেঙ্গে ফেলেছি, তার ইয়াত্তা নাই।
কলকাতায় বিকালে চা খেতে ইচ্ছা করলে বেল টিপে হোটেলের বেয়ারাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম চা খাওয়া যাবে কিনা? লোকটা জানতে চাইলো, পেসাল না চালু। আমি মাথা মুন্ডু কিছু না বুঝে সরি বলেছিলাম মনে হয়। আরও জিজ্ঞাসা করেছিলাম এগুলো কি জিনিস। বলে পেসালের দাম বেশি, চালুর কম। পরে বুঝলাম পেসাল মানে স্পেশাল। আর চালু মানে রেগুলার। চালু চা ই খেলাম, তবে আমার কাছে চালু চায়ের স্বাদও স্পেশাল ই লেগেছিলো।
পিছনের রাস্তায় যেতাম অষুধ আর টয়লেট্রিজ কিনতে। কলকাতায় চেষ্টা করতাম ওখানকার এ্যাকসেন্টে কথা বলতে। খারাপ হতোনা মনে হয়। সেই অষুধের দোকানে যেয়ে ‘দাদা এটি দিনতো, ওটি দিনতো’ বলে গেছি প্রথম ১৬দিন কিছু বুঝেনি দোকানি। কলকাতায় ব্যাবহার করার জন্য ছোট টুথপেষ্ট, সাবান কিনেছি সেই দোকান থেকে। বাংলাদেশে আসার আগে সাবান, টুথপেস্ট নিতে গেছি বেশি করে, কারন তখন কোলগেট টুথপেষ্ট, ডাভ সাবান বাংলাদেশে পাওয়া যেতো না। সবার জন্য নিয়ে যেতে হবে বলে বেশ কয়েকটা করে কিনতে গেছি। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা কোলগেট টুথপেষ্ট আছে, দোকানদার বলে, আছে, ৫০গ্রাম দিবো দাদা? আমি বললাম, না আড়াইশো দিন। দোকানদার অবাক চোখে বড় টুথপেষ্টের টিউব বের করছে, আমি সাথে যোগ করি, পাঁচটি দিন। দোকানদারের মুখ হা। টুথপেষ্ট শেষে বললাম ডাভ সাবান আছে? দোকানদার বললো, আছে। আমি বললাম ১০ টি দিন, পাঁচটা সাদা, পাঁচটা গোলাপী। এবার দোকানীর মুখে হাসি, দাদা বুঝি বাংলাদেস থেকে এছেচেন? আজ্ঞে, আমি ভাব নিলাম। গত ১৬ দিন থেকে দেখছে, কথা বলছে, কিন্তু বুঝতে পারে নাই আমি বাংলাদেশের, বেশি কেনাকাটা দেখে বুঝে গেলেন। আহা, বাংলাদেশের মানুষ চেনার মেথড্ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
কলকাতায় বেশ অনেকদিন থাকতে হবে বলে আমাদের সময় কাটানো কঠিন হয়ে পড়েছিলো। আমরা একদিন মেট্রো সিনেমায় শাহরুখ খান আর কাজলের সেই বিখ্যাত দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে সিনেমা দেখেছিলাম। হিন্দি সিনেমা হলে বসে দেখতে এমনিতেই অনেক ভালো লাগে, তারপর আবার শাহরুখ কাজলের আইকনিক সিনেমা, সিনেমাটা মনে খুব দাগ কেটেছিলো। কলকাতায় আমরা সব মিলিয়ে ৪টা সিনেমা দেখি। ভারতে যদি বেড়াতে যান তবে সেখানে সিনেমা দেখা একটি অবশ্যকরর্নীয় বিষয়। বেশ মজাই লাগে সিনেমা দেখতে। যেহেতু আমি সেবার প্রথম ভারতে গিয়েছিলাম, সে জন্য উন্নত সিনেমা হলে প্রথম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আমাকে প্রভুত আনন্দ দিয়েছিলো।
কলকাতার মেট্রোরেল তখন নতুন হয়েছে। আমাদের হোটেলের সামনেই একটা স্টেশন, স্টেশনের নাম চাঁদনি।ওরা বলতো চান্নি। রাস্তার উপর থেকে সিড়ি বেয়ে মেট্রো রেলের স্টেশনে নামার পর মনে হয়েছিলো আমি উন্নত কোন দেশে চলে এসেছি। জীবনের প্রথম কোন পাতাল রেলে চড়ার অভিজ্ঞতা আসলেই দারুণ ছিলো। আরও মজা পেয়েছি, কলকাতার ময়লা নোংড়া রাস্তা থেকে কয়েক সেকেন্ডে যেন ইউরোপের উন্নত কোন শহরে চলে যাওয়ার মতো চমকপ্রদ ব্যপার ছিলো মেট্রোরেলে চড়াটা। আমি বাবু ভাইকে হোটেলে রেখে চাদনী স্টেশন থেকে একদিন দমদম, আরেকদিন শিয়ালদহ ঘুরে এসেছিলাম। অর্থ্যাৎ মেট্রোলাইনের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলে চাঁদনী স্টেশনে নেমে টিকিট কেটে স্টেশনের অপর মাথা দিয়ে বেড়িয়ে কাজ সেরে আবার টিকিট কেটে স্টেশনের প্লাটফর্ম পার হয়ে হোটেলের সামনে বেরিয়েছি। ২০ রুপি খরচ হয়েছে, তবে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়নি। এমনকি কাজ না থাকলে মেট্রো স্টেশনে ঢুকে ঘুরাঘুরি করতেও ভালো লাগতো বেশ।
কলকাতায় গিয়ে ডাক্তার দেখানোর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মাদ্রাজে যাওয়ার ফাঁকে দুইতিন দিন বাড়তি থাকাতে আমরা বাবু ভাইয়ের বন্ধু হামজু ভাইয়ের খালাতো ভাইকে খুজতে কলকাতা থেকে চব্বিশ পরগোনা জেলার বশির হাটে রওনা দেই। সেই ছেলের নাম ছিলো প্রিন্স। বাবু ভাই প্রিন্সকে দুষ্টুমি করে প্রিন্স মামা বলতো। ফোনে যোগাযোগ করে আমরা প্রিন্স মামাকে খুঁজতে বশির হাটে রওনা দেই। ভাংগাচোরা লক্কড়ঝক্কড় বাসে ৪-৫ ঘন্টা লাগিয়ে দুপুরের পরে বশিরহাটে পৌছেছিলাম। প্রথমবারে ইন্ডিয়াতে গিয়েই পশ্চিম বাংলার গ্রাম ও গ্রামের মানুষ দেখার সৌভাগ্য লাভ করায় নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিলো। যদিও বশিরহাট জায়গাটা আমাদের সাতক্ষিরা জেলার বর্ডারের একদম কাছাকাছি ছিলো, সেজন্য আমাদের বাংলাদেশের সাথে সব কিছুর সাথেই বশিরহাটের অনেক মিল ছিলো। আবার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনেক অমিলও ছিলো। জায়গাটা মুসলমান প্রধান। হাসির ব্যপার ভারত পাকিস্তান খেলা হলে তখন বশিরহাটসহ কলকাতার মুসলমানেরা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করতো। আমরা যাওয়ার কিছুদিন আগেই ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের ভারত পাকিস্তানের বিষ্ফোরক ম্যাচ হয়েছিলো। যেখানে আমির সোহেল ভেংকটেস প্রসাদের দৈরথ ছিলো দেখার মতো। প্রিন্স মামা হাসতে হাসতে গল্প করলো যে সেই নাকি বশিরহাটের দুইচারজন ভারতীয় সাপোর্টারের মধ্যে একজন, তবে কোয়ার্টার ফাইনালে জিতে যাওয়ার পর নাকি আত্মীয়স্বজনদের বেশ কথা শুনিয়েছিলেন। এখন হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবে না। কিন্তু ব্যপারটা আসলেই সত্যি।
প্রিন্স মামা আমাদের নিয়ে বিকালে বশিরহাটের কোন একটা প্রত্নতাত্বিক জায়গায় গিয়েছিলেন। জায়গাটা ছিলো মহস্থানগড় টাইপ, তবে সেভাবে খনন কাজ সম্পন্ন করা হয়নি তখন পর্যন্ত। সবকিছু তখনও মাটির নিচে। শুধু দেয়ালের কিছু অংশ মাটির উপরে দেখতে পেয়েছিলাম। প্রিন্স মামা আমাদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখালেন। তারপর বাজারে নিয়ে গেলেন বন্ধুদের আড্ডায়। বড় বড় চায়ের দোকানে দেখলাম আড্ডাবাজ ছেলে ছোকড়াদের ভীর। আমাদের পরিচয় করে দিলেন বন্ধুদের সাথে। মনে হলো ওরা অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন। গলা মোটা করে সবাই উচ্চমার্গীয় আলাপসালাপ করছিলো স্থানীয় ও দেশীয় রাজনীতি নিয়ে। মাইরী টাইরি টাইপ ভাষাও শুনলাম, কলকাতায় আসা যাওয়া আছে মনে হলো অনেকের।তবে আমাদের বেশ আন্তরীক ভাবে গ্রহণ করেছিলো সবাই। তবে মনে লেগে থাকার মতো ব্যপার ছিলো সেই আড্ডাগুলো।
রাতে খাওয়ার সময় একটা হাসির ঘটনা ঘটলো। প্রিন্স মামার মা, মানে গিয়ে হামজু ভাইয়ের খালা আমাদের জন্য বেশ অনেক পদের রান্নাবান্না করেছিলেন। খেতে বসার পর উনি উঠিয়ে দেয়ার জন্য এক একটা তরকারী নিয়ে বলছিলেন, বাবা তোমাকে একটু দেই? আমি হয়তো তখন মাছ খাচ্ছি, তাই মুরগী দিতে চাচ্ছে বলে, না খালাম্মা বলে থামিয়েছি। পরে দ্বিতীয়বার ঐ পদ আর সাধেনি। ৫ পদের তরকারির দুই পদ খেয়ে আর তিন পদ দেখে দেখে খাওয়া শেষ করেছিলাম। বুঝেছিলাম, আমাদের মতো জোর করে খাওয়ানোটা ওরা কখনও প্রাকটিস করেনি। ছোট্ট ভুলবোঝাবুঝিতে উনার বাকি তিন পদের তরকারির প্রতি অবিচার করা হয়ে গিয়েছিলো। তবে সব মিলিয়ে বশিরহাটের অভিজ্ঞতা খারাপ ছিলো না। আমরা তার পরের দিন পাতি মাস্তান টাইপ প্রিন্স মামাকে নিয়ে কোলকাতায় ফিরে আসি।
প্রিন্স মামাকে নিয়ে কোলকাতায় ফিরে ঘুরাঘুরির গতি প্রচুর বেড়ে গিয়েছিলো। এরপর বাবু ভাইকে হোটেলে রেখে আমরা কোলকাতার আলিপুরে চিড়িয়াখানা, কোলকাতা জাদুঘর ঘুরে আসি। হেটে হেটে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে গড়ের মাঠ বা ময়দানে ঘুরাঘুরি, গ্রান্ডহোটেলের সামনে দিয়ে নিউ মার্কেটে চলে যেতাম প্রায়ই। পায়ে হেটেই চলে গিয়েছি পার্ক স্ট্রিটে, ফিরেছি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দিক দিয়ে ময়দান হয়ে এসপ্লানেড বা শহীদ মিনার হয়ে। প্রতি পদে পদে মনে হয়েছে কোলকাতা যেন আমার খুব পরিচিত, আগে থেকেই। কারন সব জায়গার নাম আমার খুব পরিচিত।
প্রিন্স মামাকে সাথে নিয়েই আমরা মাদ্রাজ যাওয়ার ট্রেনের টিকিট করে নেই একদিন। কোলকাতায় দুরের বাহন বলতে হলুদ এম্বাসেডর ট্যাক্সি। সেটা করেই আমরা হাওড়া স্ট্রেশনে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজ দেখার অভিজ্ঞতাও মনে গেথে আছে। কত হাজারবার যেন পড়েছি হাওয়া ব্রিজের কথা।
নিচ দিয়ে প্রবাহিত সেই বিখ্যাত গঙ্গা নদী। আমরা তখন গঙ্গার চেয়ে ওটাকে ভাগীরথি বলতে পছন্দ করতাম। ট্রেনের টিকেট করতে হাওড়া স্ট্রেশনে গিয়েতো মাথা নষ্ট। রেল স্টেশনে যে এতো মানুষ হতে পারে সেটা তখন পর্যন্ত আমার ধারনা ছিলো না। ভারতে তখন রেলের কনফার্ম টিকেটের খুব আকাল ছিলো। টিকেট কিনে ধন্যা দিয়ে বসে থাকতে হতো। টিকেট কনফার্ম হওয়ার পর যাত্রিদের লিষ্ট ঝুলিয়ে দেয়া হতো। আমরা টুরিষ্ট কোটায় টিকেট কাটতে টুরিষ্টদের জন্য নির্ধারিত রুমে গিয়ে বসি। সেই রুমে সাদা চামড়ার আমেরিকান আর ইউরোপিয়ান যাত্রিদের সংখ্যাই বেশি ছিলো। মজা লেগেছিলো এক আমেরিকান মধ্যবয়সির কান্ড দেখে। ভদ্রলোক তার বিশাল ব্যাগ কুলিদের মতো করে মাথায় তুলে রুমে ঢুকে ধপাস করে ব্যাগটা ফেলে ব্যাগে বসে হাপাচ্ছিলো। যে লোক টিকেট করছিলেন, তিনি ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাবেন, আমেরিকান লোকটা চিৎকার করে বললেন, ফুরিইই্। আমি হেসে প্রিন্স মামাকে বললাম, মামা ব্যাটাকে জিজ্ঞাসা করেন পুরি খাবেন, নাকি যাবেন?
আমাদের টিকেট খুব সহজেই পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। কনফার্ম টিকেট।
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আমরা তিনজন মিলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালেও গিয়েছিলাম একদিন।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে আমি এতো মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, কোলকাতার যে কোন জায়গা থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিলাম দেখা গেলেই আমি সেই আমলের ফিক্সড্ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করেছি। প্রচুর ফিল্ম নষ্ট করে কাঁপাকাঁপা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ফটোগ্রাফ তুলেছিলাম অনেক।
কলকাতায় সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজ।
মান্না দের গানের কফি হাউজের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ আগে থেকেই ছিলো। তবে কফি হাউজে যাওয়ার পর কফি হাউজের আকার-আয়তন ও গমগমে ভাবটায় আকর্ষণ আরও বেড়েছিলো। পুরো ব্যাপারটাই অনুভুতির! কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, গানটা কেউ যদি না শুনে থাকে আর সে কফি হাউজে যায়, তবে তার জন্য কফি হাউজ বিশাল আকৃতির অতি বাজে খাবারের রেস্তরা ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। যদিও আমার কফি হাউজের উর্দি পরা বেয়ারাদেরও খুব ভালো লেগেছিলো। কেমন যেন একটা ঐতিহ্যবাহী একটা বিষয় আছে। অতি অখাদ্য কাটলেট আর চা খেয়ে মনে মনে মান্নাদের গানটা আওড়ে গিয়েছিলাম পুরাটা সময়।
কলকাতা তখন ঢাকার চেয়েও ব্যাস্ত আর জনবহুল নগর । রাস্তাঘাটে হাজার মানুষের নিরন্তর হেটে চলা দেখে অবাক হয়েছি। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কলকাতা তখন হয়তো অর্থনৈতিক ভাবে একটু পিছিয়েই ছিলো। গোড়ালির কাছে চেপে আসা চোঙ্গা প্যান্ট পরা কলকাতার ছেলেরা আমাদের কাছে একটু হাসির পাত্রই ছিলো। রাস্তায় হেটে চলা মানুষের মলিন জুতা দেখলেই বোঝা যেত ওদের হাটার অভ্যাস আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। কলকাতায় তখন খাবার দাবার অতি সস্তা ছিলো। আর নিউমার্কেটের কাছে থাকাতে চিকেন চাওমিং আর এগ রোল ১০ টাকায় ভরপেট খাওয়া হয়ে যেতো। গ্রান্ড হোটেলের সামনে মাদ্রাজ টিফিন নামে একটা দোকান পেয়েছিলাম, ওখানে দক্ষিণ ভারতের খাবার দাবার পাওয়া যেতো। সব মিলিয়ে খাওয়ার কষ্ট পাইনি একদম।
সেই ট্যুরে আমরা ট্রেনে করে ৩৬ ঘন্টায় মাদ্রাজে গিয়েছিলাম। সেটাও ছিলো একটা বিরাট অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা না হয় আরেকদিন বলা যাবে।
লেখক: আনিসুল কবীর