ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে যে ছবিটি সিনেমা হলে একটানা প্রদর্শিত হয়েছে তার নাম দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে যা সিনেমা-প্রেমীদের কাছে যা সংক্ষেপে ডিডিএলজে নামে পরিচিত।
বলিউড কাঁপানো এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর ২৭ বছর ধরে মুম্বাই-এর একটি সিনেমা হলে প্রতিদিন সকালে প্রদর্শিত হয়েছে।
এই ছবিতে অভিনয় করে রাতারাতি সুপারস্টার হয়েছেন অভিনেত্রী কাজল, অভিনেতা শাহরুখ খান এবং পরিচালক আদিত্য চোপড়া।
হাসতে হাসতে কাজল বিবিসিকে বলেছেণ এই ছবিটি যে একদিন এতো বড় ঘটনা হয়ে উঠবে এবং দর্শকদের কাছে এতো বছর ধরে আদৃত হবে সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না।
“আমরা কয়েকজন তরুণ তরুণী মিলে শুধু একটা জনপ্রিয় ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলাম। এটাই ছিল আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। তবে এই ছবিটি নিয়ে পরে যা হয়েছে তা এক বিশাল ঘটনা। আমরা যা করেছি সেটা সত্যিই যাদুকরী, এবং এর পুনরাবৃত্ত সম্ভব নয়,” বলেন তিনি।
হিন্দি সিনেমার জগতে কাজল অত্যন্ত জনপ্রিয় এক তারকা। দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গের সাফল্যের পেছনেও তিনি ছিলেন অন্যতম।
ছবিতে ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা শাহরুখ খানের নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন কাজল। শাহরুখ খান তার ভক্তদের কাছে পরিচিত এসআরকে নামে।
ডিডিএলজে মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালের অক্টোবর মাসে।
এই সিনেমার প্রিমিয়ার হয়েছিল মুম্বাই-এর মারাঠা মন্দির সিনেমা হলে। তার পর থেকে এই ছবিটি সেখানে ২৭ বছর ধরে প্রতিদিন দেখানো হয়েছে। শুধু কোভিড মহামারির সময় এর প্রদর্শনী অল্প কিছু সময়ের জন্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এখনও সেই এতিহ্য অব্যাহত রয়েছে।
কাজল বলছেন, “এই ছবিটির জন্য আমরা যখন শুটিং করতে শুরু করলাম তারপরে কোনো একদিন, এবং পরে যখন মুক্তি দেওয়া হলো, আমরা কখনও ভাবিনি যে এটি এতো বড়ো ঘটনা হয়ে উঠবে।”
“ছবিটি তৈরির জন্য আমরা কৃতিত্ব দাবি করতে পারি, কিন্তু পরে এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এবং এতো দীর্ঘ সময় ধরে হলে দেখানো- আমি মনে করি এটা তাদের কারণেই সম্ভব হয়েছে যারা ছবিটিকে গ্রহণ করেছে, তাদের পরিবারের ঐতিহ্যের অংশ করে নিয়েছে, নিজেদের ছেলে মেয়ে ও নাতি পুতিদের সিনেমাটি দেখিয়েছে, এমনকি বিয়ের প্রস্তাব দিতেও এই ছবিটিকে ব্যবহার করছে।”
দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে ছবিতে দেখা যায় ভারতীয় একদল তরুণ তরুণী ছুটিতে ইউরোপে বেড়াতে আসে। এসময় অপূর্ব এক নৈসর্গিক পরিবেশে সিমরান ও রাজ পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায়।
সিমরান চরিত্রে কাজল এবং রাজের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান।
সিমরানের বাবা যখন বুঝতে পারেন যে তার মেয়ে রাজের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তখন তিনি তার পুরো পরিবার নিয়ে লন্ডন থেকে ভারতে চলে যান তার পছন্দের এক পাত্রের সঙ্গে কন্যার বিয়ে দেওয়ার জন্যে।
কিন্তু রাজ সিমরানকে এতোটাই ভালোবেসে ফেলে যে সে-ও ভারতে চলে যায়।
পরে সিমরানকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নায়ক রাজ সিমরানের বাবা মায়ের মন জয় করার চেষ্টা করে।
“দিন শেষে প্রত্যেক সন্তানই চায় তাদের পিতামাতা তাদের দিকে তাকিয়ে বলুক, তুমি বেশ ভালো করেছ, আমি তোমার সাথেই আছি। আমার মনে হয় এই বিষয়টাই সবাইকে নাড়া দিয়েছে এবং সবাই এর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে,” বলেন কাজল।
ডিডিএলজে মুক্তি পাওয়ার পর প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১১টায় মারাঠা মন্দির সিনেমা হলে ছবিটি দেখানো হতো। টিকেটের দাম ছিল মাত্র ৩০ রুপি।
সিনেমা হলের বাইরের দেওয়াল ছিল উজ্জ্বল কমলা রঙের। সেখানে টাঙ্গানো বিশাল এক বিলবোর্ড যাতে শাহরুখ খান ও কাজলের ছবি।
এসআরকের পরনে সেই হার্লি ডেভিডসন চামড়ার জ্যাকেট। সিমরানকে সে তার কাঁধের উপরে তুলে নিয়েছে। বিলবোর্ডে লেখা: ‘আসুন, আবার প্রেমে পড়ুন।’
দর্শকরা যখন থিয়েটারের ভেতরে প্রবেশ করে, স্পিকার থেকে তাদের কানে ভেসে আসে এই ছবির জনপ্রিয় সব গান। হলের মাঝখানে একটি হিন্দু মন্দির। তার চারপাশ ঘিরে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে লাল সবুজ বাতি।
“সেখানে গেলে মনে হবে যে আপনি অতীতে ফিরে গেছেন। আসনগুলো একই রঙের। মঞ্চটাও একই ধরনের। সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার কুড়িতম বার্ষিকীতে আমরা দুজনেই মারাঠা মন্দিরে গিয়েছিলাম।”
“ওই থিয়েটারে ফিরে যাওয়া দারুণ এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল। সেখানে আমরা প্রথমবারের মতো সিনেমাটি দেখি এবং দেখতে দেখতে আমরা আমাদের অভিনয়ের সমালোচনা করি- এই কাজটা আমরা আরো ভালো করতে পারতাম, ওই কাজটা আরো ভালো হতে পারতো,” বলেন কাজল।
কাজল বলেন লোকজন এখনও সিনেমাটি দেখতে যাচ্ছে। দিনের পর দিন। বিশেষ করে মারাঠা মন্দিরে। সারা দেশ থেকেই লোকজন এখানে আসছে হলে বসে এই সিনেমা দেখতে।
এই ছবি দেখতে যেমন এসেছিলেন ভিজে এবং তার স্ত্রী প্রীতি।
তারা ৫৬০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন এই সিনেমা দেখতে। তাদের বিয়ের সপ্তম বার্ষিকী উপলক্ষে। একটা রোমান্টিক ছবি দেখার মাধ্যমে তারা তাদের বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করতে চেয়েছেন।
প্রীতি এই ছবিতে তার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্যটির কথা বর্ণনা করছিলেন। সেটি হচ্ছে বিখ্যাত সেই ট্রেনের দৃশ্য যখন সিমরানের পিতা তার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন- ‘সিমরান যাও, সিমরান যাও।’
কাজল একটা মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তারা তখন জয়পুরে শুটিং করছিলেন।
“আমরা যে হোটেলে উঠেছি তার একজন শেফ আমার কাছে এসে বললো- ম্যাম, আপনাকে একটা কথা আমার বলতেই হবে- আমি আমার স্ত্রীকে ডিডিএলজে দেখাতে ২৩বার সিনেমা হলে নিয়ে গেছি। এবং তার পরেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেই।”
“আমার তখন মনে হলো, ও মাই গড, এটা তো একটা দারুণ ঘটনা। এই সিনেমা দেখতে যাওয়া নিয়ে লোকজনের নানা ধরনের গল্প আছে। এটা তাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। মারাঠা মন্দিরে সিনেমাটি দেখতে গেলে দারুণ অনুভূতি হবে, মনে হবে আরে..আমি তো এটা দেখেছি, এটা তো সেই একই পপকর্ন, একই পোশাক এবং এটা তো গরুর সেই ঘণ্টিটা।”
গরুর এই ঘণ্টিটা সিমরান সুইৎসারল্যান্ড থেকে সুভ্যেনির হিসেবে সংগ্রহ করেছিল। মারাঠা মন্দিরে একটি কাঁচের বাক্সর ভেতরে এই ঘণ্টিটা রাখা এবং তার পাশেই রাখা সোনার এক ট্রফি।
বলিউড জগতে পরিচালক আদিত্য চোপরার অভিষেক হয় এই দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে ছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। সেসময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। এর আগে ১৮ বছর বয়স থেকেই তিনি তার পিতা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ইয়াশ চোপরার সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন।
কাজল বলেন, “নতুন পরিচালক আদির সঙ্গে কাজ করা আমার জন্য খুব সহজ ছিল। কারণ তাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনতাম। আমরা আসলেই খুব ভাল বন্ধু। ফলে আমরা যখন কাজ শুরু করি কাজটা খুব স্বাভাবিকভাবেই এগিয়েছে।”
“আমরা সবাই খুব আনন্দ করেছি। একজন আরেকজনকে নিয়ে মজা করেছি। আমার জন্য সবচেয়ে মজার ছিল ইউরো রেলে চড়া। আমরা সবাই বাসে করে সারা সুইৎসারল্যান্ডে ঘুরে বেড়িয়েছি। এই ছবির শুটিং করতে গিয়ে আমরা সবাই দারুণ সময় কাটিয়েছি,” বলেন তিনি।
“আমার মনে আছে হিমশৈল ধরনের কোনো একটা জায়গায় আমরা শুটিং করছিলাম। সেখানে আমাকে কাপড় বদলাতে হবে। কৃষকের একটি গরুর শেডে গিয়ে আমাকে শাড়ি পরতে হয়েছিল। আমার পাশেই ছিল একটি গরু। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমি আসলেই সেখানে কাপড় বদলাচ্ছি। খুব দ্রুত শাড়ি পরে ফেললাম। বললাম আমি রেডি, শট দেওয়ার জন্য আমি রেডি।”
এই ছবিতে কাজলসহ আরো অনেকেরেই বয়স ছিল কুড়ির ঘরে।
কাজল জানান ইয়াশ চোপড়া এবং তার স্ত্রী শুটিং এর সময় তাদের ওপর সবসময় কড়া নজর রাখছিলেন। কারণ এই ছবির জন্য তিনি তার ছেলেকে সব অর্থ দিয়েছিলেন।
ডিডিএলজে ছবির গান, যেগুলোতে কাজল ঠোঁট মিলিয়েছেন, তাতে কণ্ঠ দিয়েছেন প্লে ব্যাক কুইন হিসেবে পরিচিত প্রয়াত লতা মঙ্গেশকার।
“এই ছবির সবগুলো গান আমার খুব প্রিয়। এই গানগুলো সর্বকালের। আজকের দিনেও এগুলো আমার প্রিয় গান। তার পরেও আমি বলবো মেন্দি লাগাকে রাখ না আমার সবচেয়ে প্রিয়।”
এই গানটি পরে ভারতে বিয়ের অনুষ্ঠানে খুবই পরিচিত একটি গান হয়ে উঠেছে।
ডিডিএলজে দশটি ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড জয় করেছে। এই ছবি দিয়েই রাতারাতি সুপারস্টার হয়ে ওঠেন কাজল, এসআরকে এবং আদিত্য চোপরা।
কাজল বলেন, “আমি আশা করবো লোকজন এখনও এই ছবি উপভোগ করুক, দেখুক এবং তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ করে তুলুক। এই ছবিটির প্রতি তাদের ভালবাসা অব্যাহত থাকুক।”
সারা বিশ্বে মুক্তিপ্রাপ্ত ডিডিএলজে সেসময় প্রায় দুই কোটি ডলার আয় করেছে যা ছিল ১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যবসা-সফল সিনেমা।
এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বিবিসির রিনা স্ট্যান্টন শর্মা