লিকলিকে গড়নের এই মানুষটির গল্প আর সবার মতো নয়৷ বছর দশেক আগের কথা৷ তখন ২০১৩ সাল৷ টগবগে তরুণ প্রদীপন৷ বয়স তখন ত্রিশ ছুঁই ছুঁই৷ ওই সময় শ্রীলঙ্কার অবস্থাটাও আজকের মতো নাজুক ছিল না৷ খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অবস্থাটাও ছিল তার৷ তবুও ইউরোপে উন্নত জীবনের হাতছানিতে না বলতে পারেননি প্রদীপন৷ তাই জীবন বদলের শুরুটা হয়েছিল সিঙ্গাপুর ভ্রমণ দিয়ে৷ শ্রীলঙ্কার পাসপোর্ট নিয়ে বৈধভাবেই দেশটিতে গিয়েছিলেন তিনি৷
ইনফোমাইগ্রেন্টসকে প্রদীপন বলেন, ‘‘আমি প্রথমে শ্রীলঙ্কার পাসপোর্ট নিয়ে সিঙ্গাপুরে যাই৷ সিঙ্গাপুর থেকে একটি বাসে চড়ে মালেয়শিয়া চলে আসি৷ সেখানে কিছুদিন থেকে মালেয়শিয়ার পাসপোর্ট যোগাড় করি৷ তারপর আমার ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা শুরু হয়৷’’
কিন্তু একজন মানুষ ভিন্ন একটি দেশে ঢুকেই কিভাবে আরেকটি দেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে পারে—এমন প্রশ্নের জন্য অবশ্য প্রস্তুত ছিলেন প্রদীপন৷ ভাবার জন্য মুহূর্ত সময় না নিয়েই বলতে শুরু করলেন, ‘‘একজন আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন৷ তার কারণে পাসপোর্ট পেয়েছিলাম৷ ছবিতে সামান্য একটু ভিন্নতা ছিল, কিন্তু সেটা তেমন কোনো সমস্যা ছিল না৷৷’’
তবে পাসপোর্ট পেতে সহযোগীর বিষয়ে তেমন কিছু বলতে চাননি প্রদীপন৷ কেমন সময় লেগেছিল, এড়িয়ে গেছেন সেই প্রসঙ্গটিও৷
মালেয়শিয়ার পাসপোর্ট হাতে পেয়ে আগের চেয়ে সাহসটা আরেকটু বেড়ে গেল প্রদীপনের৷ মালেয়শিয়া থেকে চলে গেলেন ইরান৷ সেখানে দিন না পেরোতেই আবার চলে আসেন তুরস্কে৷ সেখানে তার ঠিকানা হয় আনাতালিয়া শহর৷
প্রদীপন বলেন, ‘‘তুর্কির আনাতালিয়া থেকে ফ্লাইটে করেই আমি সুইজারল্যান্ডের আসি৷ সেখানে থেকে চলে যাই ফ্রান্সে৷’’
জাল পাসপোর্ট নিয়ে এতটা পথ চলতে কোনো সমস্যা হলো না? উত্তরে খুব জোরের সঙ্গে প্রদীপন জানালেন, ‘‘সমস্যা হবে কেন? ওটা ছিল মালেয়শিয়ার অরিজিনাল পাসপোর্ট৷ আমার কোনো সমস্যা হয়নি৷ কারণ, আমি ইংরেজি জানি৷ সবকিছু ম্যানেজ করে নিয়েছি৷’’
ইনফোমাইগ্রেন্টসের কাছে তিনি দাবি করেছেন, ফ্রান্সে পৌঁছে অন্তত ১০ বার আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন৷ কিন্তু প্রতিবারই তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন ফরাসি আশ্রয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ৷ জীবন ধারণের জন্য কোনোরকম কাজ করে পার করে দিয়েছেন পুরোটা সময়৷
তিনি বলেন, ‘‘আমি ওয়ার্ক পারমিট চেয়েও আবেদন করেছিলাম৷ কিন্তু সেটাও গ্রহণ করেনি ফরাসি কর্তৃপক্ষ৷ সেজন্যই আমি জার্মানি চলে আসতে চেয়েছিলাম৷’’
গেল বছরের নভেম্বরের দিকের কথা৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী জার্মানির উদ্দেশে যাত্রাও করেছিলেন তিনি৷ প্রদীপন বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি আমি নেদারল্যান্ডস-জার্মান সীমান্তে ডাচ পুলিশের হাতে ধরা পড়ি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এমন এক জায়গায় আমি ধরা পড়লাম, সেখান থেকে খুব বড় জোর ১০ মিনিট দূরে ছিলো জার্মানি৷’’
যেহেতু তার কাছে কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই, ফলে ডাচ পুলিশ থাকে থানায় নিয়ে যান৷ সেখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে তুলে দেয়া হয় নেদারল্যান্ডসের অভিবসান বিষয়ক সরকারি সংস্থা ইমিগ্রাতি-য়েন নাতুখালিজাতিদিয়োনস (আইএনডি)-র হাতে৷
তিনি বলেন, ‘‘তারপর তারা আমার ছবি তুললো৷ আঙ্গুলের ছাপ নিল৷ সই নিল৷’’
এখন নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামের সরকারি একটি আশ্রয়কেন্দ্রে তাকে থাকতে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ৷ খাওয়া খরচ বাবদ প্রতি সপ্তাহে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়৷ সেটা নিয়ে বাজার করে নিজে রান্না বান্না করে খান প্রদীপন৷
নেদারল্যান্ডসে শেষ পর্যন্ত তার আশ্রয় জুটবে কিনা বা সেখানে কতদিন তার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে, তা এখন পুরোটাই নির্ভর করছে আইএনডি এর সিদ্ধান্তের ওপর৷
যদি নেদারল্যান্ডস প্রত্যাখ্যান করে তাহলে পরিণতি কী হবে, জানতে চাওয়া প্রদীপনের কাছে৷ উত্তর দেয়ার ধরন দেখে মনে হলো, এখনই নেতিবাচক কোনো চিন্তায় আচ্ছন্ন হতে চান না তিনি৷
ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, ‘‘আইএনডি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, তুমি দশ বছর ধরে ফ্রান্সে আছো, এখানে কেন এসেছো৷ আমিও নিজের মতো করে সব গুছিয়ে বলেছি তাদের৷ বলেছি, ১০ বছর চেষ্টা করেও কিছু হলো না৷ তাই এখানে এসেছি৷’’
বিষয়টি নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করতেই নতুন একটি কারণ তুলে ধরেন প্রদীপন৷ তিনি বলেন, ‘‘আইএনডিকে আমি জানিয়েছি ফ্রান্সে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আমাকে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করেছে৷ তাই আমি এখানে চলে এসেছি৷’’
এ সংক্রান্ত প্রমাণ আইএনডিকে দিয়েছে বলেও দাবি করেছেন প্রদীপন৷ এরমধ্যে আইএনডি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে৷ তারা জানিয়েছে, তার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে৷ এমনকি একথাও তারা জানিয়েছে যে, কোনো কারণে তার আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে, সেকি একা ফ্রান্সে ফিরতে পারবে নাকি তাকে সেখানে ফেরত পাঠাতে কোনো উদ্যোগ নিতে হবে৷
উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘‘আমার কোনো সমস্যা নেই৷ কিন্তু জীবনের ঝুঁকি আছে বলেই আমি এখানে এসেছি৷’’
তবে তার আবেদনটি গ্রহণ করা হবে বলে আশা করছেন প্রদীপন৷ যদি না হয়, তাহলে আবারো ফ্রান্সে চলে যাওয়ার কথাই ভাবছেন তিনি৷ কিন্তু আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে তার জীবনে, তার পুরোটাই অনিশ্চিত৷