কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন৷ পেশায় রঙমিস্ত্রী আহমেদের দুর্ভোগ তখনও শেষ হয়নি৷ তিনি আবিষ্কার করলেন আরো আট জনের সঙ্গে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে গ্রিক পুলিশ৷ তাদের সবাই মিশরীয়৷ সবাইকে মানবপাচারকারী হিসাবে সন্দেহ করছিল পুলিশ৷ বলা হচ্ছিল, তাদের কারণেই হয়েছে ইতিহাসের এই ভয়াবহ অভিবাসী দুর্ঘটনা৷
সেই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে আজীবন কারাগারেই থাকতে হতো আহমেদ ও আরো আট মিশরীয় নাগরিককে৷
রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘‘যখন ওরা আমাকে একটা রুমের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, তখনই আমার মনের মধ্যে ভয় ধরে যায়৷ আমি শুধু ভাবছিলাম কী ব্যাপার? কী হয়েছে? আমি কি কিছু করেছি?’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘তারা আমাদের বলছে যে আমরা চোরাচালানকারী৷ পাচারকারী? না, না, না, না – ব্যাপারটা এমন নয়৷’’
তাদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থাগুলো৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছিল, গ্রিক উপকূলরক্ষীরা নিজেদের দায় এড়াতে অভিবাসীদের বলির পাঁঠা বানাচ্ছেন৷ তাদের বিরুদ্ধে মামলার কোনো যুক্তি নেই৷
নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের সুযোগের অপেক্ষায় ১১ মাস বিচারপূর্ব কারাগারে কাটাতে হয়েছে আহমেদ ও আরো আট অভিযুক্তকে৷ গত মাসে তাদের আদালতে আনা হলে আদালত তাদের সবাইকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়৷ এমনকি তাদের মুক্তভাবে চলাফেরার অনুমতি দিয়েছে আদালত৷
রয়টার্সের সঙ্গে আলাপকালে খুবই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন আহমেদ৷ তার অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে কথা বলছিলেন তিনি৷
এই নয় জনের বিরুদ্ধে অভিবাসীবাহী নৌকাটি চালানো ও পরিচালনার অভিযোগও আনা হয়েছিল৷ তবে অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন তারা৷
তিনি বলেন, ‘‘আমি এসব করিনি৷ আমি কাউকে একফোঁটা পানিও দিইনি, আমি নৌকা মেরামতও করিনি বা ইঞ্জিনঘরেও নামিনি৷’’
২০২৩ সালের জুনে গ্রিসের পাইলোস উপকূলে ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে গভীরতম অঞ্চলে সাত শতাধিক অভিবাসনপ্রত্যাশী নিয়ে ডুবে যায় আদ্রিয়ানা নামের মাছ ধরার একটি ট্রলার৷
গোটা বিশ্বকে নাড়া দেয়া ওই দুর্ঘটনায় মাত্র ১০৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল৷ আর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল ৮২ জনের৷ ট্রলারে থাকা আর কারো খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ উদ্ধার করা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্য থেকে নয়জন মিশরীয় নাগরিককে মানবপাচার ও অবেহলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে গ্রেপ্তার করে গ্রিক পুলিশ৷
লিবিয়ার উপকূল থেকে ছেড়ে আসা আদ্রিয়ানা নামের ওই ট্রলারে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বেশিরভাগই ছিলেন পাকিস্তান, সিরিয়া ও মিশরের নাগরিক৷
দারিদ্র্যের কারণে মিশরের সাদাত শহর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন আহমেদ৷ তিন সন্তানের বাবা তিনি৷ ফুসফুসে জটিলতা নিয়েই জন্মেছেন তার ছোটো সন্তান৷ তবে রোগটি সারিয়ে তোলা সম্ভব৷ কিন্তু চিকিৎসার খরচ যোগানোর সামর্থ্য তার ছিল না৷ মিশরে চাকরি করেও কোনো কিনারা করতে পারছিলেন না৷ তাই ইটালিতে থাকা ভাইয়ের কাছে যেতে পারলে একটা গতি হবে মনে করেছিলেন আহমেদ৷ সেজন্য বন্ধুর কাছ থেকে এক লাখ ৪০ হাজার মিশরীয় পাউন্ড ধার করে আদ্রিয়ানা ট্রলারে উঠেছিলেন৷
কিন্তু কারাবন্দি জীবন তাকে আশাহত করে তুলেছে৷ সন্তানের বেড়ে উঠা দেখতে পারেননি বলে খুব আক্ষেপ করেন৷
তিনি বলেন, ‘‘যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিল তা হলো, আমি যখন কারাগারে ছিলাম তখন ওমর (ছোটো সন্তান) আমাকে ‘বাবা’ বলে ডেকেছে৷’’
আহমেদ আরো বলেন, ‘‘১১ মাসের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল, যখন আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলাম সেইদিনটি৷’’
আহমেদ এখন গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে আছেন৷ তার আশ্রয় আবেদনটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে৷ কিন্তু কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েও নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত মনে করেন না তিনি৷
আহমেদ বলেন, ‘‘আমি সত্যিই এই দেশে নিয়মিত হতে চাই৷’’ এবং ‘‘সবার কাছে প্রমাণ করতে চাই, আমরা উরোপে আমাদের ভাগ্যবদলাতে এসেছি৷’’