সপ্তাহ ফুরাতে না ফুরাতেই মনটা আনচান করে ওঠে শহর থেকে দূরে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে। আজকের ভ্রমণগল্প আমাদের দেশের অসাধারণ সুন্দর ভাসমান পেয়ারাবাজার নিয়ে। ভাসমান বাজার বা ফ্লোটিং মার্কেট বললেই মাথায় আসে ফিলিপাইনের কাবিয়াও বা থাইল্যান্ডের ড্যামনোয়েন সাদুয়াক বাজারের নাম। কিন্তু সারি সারি নৌকাসজ্জিত আমাদের বরিশালের ভাসমান বাজারের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম এই পেয়ারবাজার গড়ে উঠেছে ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুর—এই তিন জেলার সীমান্তে। ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই ভাসমান পেয়ারাবাজার বসে এখানে।
ঝালকাঠি ও পিরোজপুর সীমারেখায় অবস্থিত ছোট্ট গ্রামের নাম ভিমরুলি। আটঘর, কুড়িয়ানায় রয়েছে স্বরূপকাঠি পেয়ারাবাজার। কীর্তিপাশা খালের পাশে এর অবস্থান। অনেকে একে গোয়াইয়ার হাটও বলে থাকে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে ভরপুর পেয়ারার মৌসুম। চাষিরা সরাসরি বাগান থেকে এনে নৌকায় ভরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন স্তূপ করা সবুজ পান্নার মতো এই পেয়ারা।
সব মিলিয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় বছরে ২৪ হাজার থেকে ২৫ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়, যার কেনাবেচায় ৪৬-৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। দেশে উৎপাদিত মোট পেয়ারার প্রায় ৮০ শতাংশই উৎপাদিত হয় এ অঞ্চলে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানকার পাইকারেরা পেয়ারা কিনতে আসে। শত শত সারবাঁধা নৌকা একসঙ্গে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। অবশ্য পেয়ারার পাশাপাশি লেবুও পাওয়া যায় এখানে।
সাত-আট বছর ধরে ঢাকার বাইরে থেকে অনেক ভ্রমণপিপাসু মানুষ চলে আসেন এই ভাসমান পেয়ারাবাজার ঘুরে দেখতে। ভাসমান পেয়ারাবাজারে চাইলে অনেকভাবেই যেতে পারবেন। নৌ, স্থল, এমনকি আকাশপথেও যাওয়া যায়। স্থলপথে যেতে চাইলে ঢাকার গাবতলী থেকে সাকুরা পরিবহনের এসি বাস যায় বরিশাল পর্যন্ত। ভাড়া ৮০০ টাকা। এ ছাড়া হানিফ, ঈগল, সুরভী ও সাকুরা পরিবহনের নন-এসি বাসও যায়, যেখানে ভাড়া ৩৫০-৪৫০ টাকা। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বরিশালে যাওয়ার জন্য রয়েছে ‘সুগন্ধা’ পরিবহনের বাস। তবে সবচেয়ে ভালো হয় নদীপথ, অর্থাৎ লঞ্চে যাওয়া।
সে জন্য প্রথমে সদরঘাট থেকে উঠতে হবে বরিশালগামী লঞ্চে। বিলাসবহুল সুন্দরবন-২ করে গেলে তা হতে পারে আপনার জন্য দারুণ অভিজ্ঞতা। ভিআইপি কেবিনের জন্য ৫ হাজার-৭ হাজার টাকা, সেমি ভিআইপি কেবিন ৪ হাজার-৪ হাজার ৫০০ টাকা, ফ্যামিলি কেবিন ২ হাজার ৫০০-৩ হাজার ৫০০ টাকা, ডাবল কেবিন ১ হাজার ৭০০-১ হাজার ৮০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ৯০০-১ হাজার টাকা ও ডেকে জনপ্রতি ২৫৫ টাকা খরচ পড়বে।
লঞ্চ থেকে নামার পর সিএনজি বা অটোতে করে যেতে হবে বানারীপাড়া লঞ্চঘাটে। সেখান থেকে ট্রলার বা নৌকা ভাড়া করে পৌঁছাতে হবে ভিমরুলি গ্রামে। এখনকার আবহাওয়ার মতো হুট করে বৃষ্টি নামলে অন্য রকম একটা আবহ সৃষ্টি হয় সেখানে। পেয়ারাবাজারের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ারাও মিলবে তরতাজা।
বরিশালের রান্না দারুণ মজাদার। সকালের নাশতায় এখানকার পথের ধারের দোকানের রসগোল্লা আর পরোটা না খেলে সত্যিই মিস করবেন। দুপুরে ফিরে ঘাটের কাছেই পাবেন হোটেল। সেখানে পাবেন একদম তাজা মাছ ভুনা আর ভর্তা-ভাত, যা আপনার স্বাদকোরকে এক দারুণ স্মৃতি হয়ে থাকবে। বিকেলে দুর্গাসাগর ঘুরে যেতে পারেন আর সেই সঙ্গে গুঠিয়া মসজিদ। বরিশাল শহরের ভেতরে অক্সফোর্ড মিশন চার্চ দেখে ফেলতে পারেন।
সেই সঙ্গে চেখে দেখা যায় অসাধারণ সুস্বাদু হকের মিষ্টি, ঘাটের সামনে মুরগির মাংস দেওয়া চটপটি আর মসজিদ রোডের ভুঁড়ি ভুনা দিয়ে রুমালি রুটি। ফেরার পথে নিজামের বিরিয়ানি অবশ্যই রাতের খাবারে রাখতে পারেন। এ ছুটিতে চটজলদি প্ল্যান করে ক্লান্ত জীবনে প্রশান্তির খোঁজে হারিয়ে যেতে পারেন এই মৌসুমের অন্যতম জনপ্রিয় এ ভ্রমণ গন্তব্যে।