এ ধরণের শখের পেশার একটা তালিকা বানালে বেশ দীর্ঘ-ই হয়ে যাবে। আমার ধারণা সবাই কৈশোরে নিজেকে নানা ভূমিকায় কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হয়েছেন। স্কুল জীবনে ক্লাস পরীক্ষায় অনেকেই ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখেছেন। কিন্তু বাস্তবে কতজন-ই বা তাদের স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছতে পেরেছেন!
সত্তর দশকের কথা। স্কুলে পড়ি। সেই সময়কার আর দশজন দুরন্ত বালকের মতো ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলি, ঘুড়ি উড়াই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই। সঙ্গে একের পর এক স্বপ্ন মাথায় এসে ভর করতে থাকে। এরকম পর্যায়ে নতুন এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হই। তার নামটা বলার আগে তার কর্মক্ষেত্রটা বলি। তিনি ছিলেন একজন অভিনেতা। কুংফুর জনক বলা হয় তাকে।
নামটা হয়তো অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছে। ঠিক তাই, আমি বলছি ব্রুস লির কথা। তিনি অভিনয় করেছেন, হলিউড ও হংকং-এ নির্মিত ছায়াছবিগুলোতে। বিষয়বস্তু ঘুরে ফিরে একই হতো। প্রতিপক্ষ তার একজন কিংবা দশজন হোক, তিনি নিখুঁতভাবে কুংফুর নানা কৌশল প্রয়োগ করে তাদের একের পর এককে ধরাশায়ী করতেন।
সে সময়ে ইন্টারনেট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। হাতেগোণা পাড়ার কিছু বাসায় টিভি ছিল। তাও আবার সাদা-কালো। তবে সিনেমা হলে ইংরেজি ছবি আসতো। টিকিটের দাম ছিল পাঁচ টাকা। কয়েকজন বন্ধু হলে গিয়ে ব্রুস লির একটা চলচ্চিত্র দেখে আসতো। তারপর অন্য বন্ধুদের কাছে আসর জমিয়ে নায়কের নানা কসরত বর্ণনা করতো। এতে আমি নিজেও ব্রুস লির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলাম।
অনেক কষ্টে টাকা যোগাড় করে সরেজমিনে ছায়াছবিটা দেখে বন্ধুদের বর্ণনা মিলিয়ে এলাম। কিশোর মনটা একেবারে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ঠিক করে ফেললাম আত্মরক্ষা ও দুষ্টুদের শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে একেবারে ব্রুস লির মতো তরিৎকর্মা হতে হবে। কিন্তু সেরকম হতে হলে আগে তো কুংফু শিখতে হবে! কিন্তু সেটাই বা কী করে সম্ভব?তখন আমার আবাস বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। এখন যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা চলছে, তার সূত্রপাত সেই আমলেই। তবে এতো ব্যাপক আকারে ছিল না। কিছু বার্মিজ ক্যাম্প ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে কাজকর্ম নিয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন কুংফু কারাতে পারদর্শী ছিলেন। তারা শহরের কয়েকটা জায়গায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে বসলেন। আমার মতো যারা ব্রুস লি হওয়ার স্বপ্ন দেখতো, তারা কুংফুতে দীক্ষা নেওয়া আরম্ভ করল।
এসব প্রশিক্ষকদের অনেকটা চীনা কায়দায় ‘ওস্তাদ’ বলে সম্বোধন করা হতো। এসব ওস্তাদদের কপাল দিয়ে আঘাত করে ইট ভাঙ্গা কিংবা প্রজাপতির মতো উড়ে গিয়ে ফ্লাইং কিক করা এবং আরও নানা কৌশল আমাদের বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এতো বছর পর ব্রুস লির কথা কেনো বলছি। মাত্র কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহর ঘুরে আসলাম। শুনলাম শহরটার উপকণ্ঠে ব্রুস লির সমাধি। কথাটা শোনামাত্র মনে পড়ল কৈশোরে ফেলে আসা সেই সোনালি দিনগুলোর কথা। সিদ্ধান্ত নিলাম সেখানে যাবো। যিনি একসময়ে কিশোর মনগুলোকে আত্মরক্ষার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাকে সম্মান জানাব।
ধরে নিয়েছিলাম তার কবর খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবে। কারণ ইদানিং পত্রপত্রিকায় কিংবা সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে ব্রুস লির নাম কিংবা কর্মকাণ্ডের উল্লেখ দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। তাছাড়া তিনি মারা গেছেন আজ থেকে ৪৮ বছর আগে, ১৯৭৩ সালে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩২। আমার চিন্তাটা ভুল প্রমাণিত হলো। সমাধিস্থলে যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হলো। প্রচুর ভিড় না হলেও মানুষজনের আনাগোনা ছিল।
যখন তার কবরের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ এলো, তখন কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে আমার শ্রদ্ধা জানালাম। মৃত মানুষের সঙ্গে কথা বলার উপায় থাকলে তাকে জানাতাম- তার মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর তার সম্পর্কে আমি জানতে পারি। তার অভিনীত বেশ কয়েকটা সিনেমা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। তার প্রবর্তিত কুংফুতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তার মতো পরোপকারী যোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করেছি। বলতে গেলে জীবনের একটা সময় সে আমার আইডল ছিল। তখন তার বড় একটা পোস্টার আমার শোবার ঘরের দেওয়ালে শোভা পেতো। দিনের বেশিরভাগ সময়ই ছিল সে আমার সঙ্গী।
হলিউডে অভিনয় জীবন আরম্ভ করলেও তিনি ব্যাপক খ্যাতি পান হংকং-এ নির্মিত ছায়াছবিগুলোর মাধ্যমে। ‘দ্য বিগ বস’ (১৯৭১) এবং ‘দ্য ওয়ে অব দ্য ড্রাগন’ (১৯৭২) এশিয়ার বাজারে তুমুল ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছিল। তার অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ হলিউডের বিখ্যাত ওয়ার্নার ব্রস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও সারা বিশ্বে মুক্তির ব্যবস্থা করে। চারদিকে তাকে নিয়ে প্রচুর হইচই পড়ে যায়। কিশোর ও যুবক সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ব্রুস লি তার এ খ্যাতি ও সম্মান নিজে দেখে যেতে পারেননি। কারণ তিনি ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বেশ কয়েকটা স্থানে কুংফু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিলেন। তখনকার কিছু সেলিব্রেটি তার থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন স্টিভ ম্যাককুইন। ব্রুস লির ঠিক পাশেই আরেকজন চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তিনি হলেন তার পুত্র ব্র্যান্ডন লি। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও একজন অভিনেতা হয়েছিলেন।
বাবার মতো তার জীবনও সংক্ষিপ্ত হয়েছিল, ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫- ৩১ মার্চ ১৯৯৩। ‘দ্য ক্রো’, ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে অভিনয় করার সময় তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। তার সহঅভিনেতার বন্দুকের ম্যাগজিন থেকে সহযোগীরা ভুল করে বুলেট বের করে রাখেনি। ফলে শুটিং চলার সময় ট্রিগার চাপলে আসল গুলি গিয়ে ব্র্যান্ডনের গায়ে লাগে।
জিমি হেন্ড্রিক্স এর সমাধি
প্রথমে সেটের লোকেরা বুঝতেই পারেননি আসলে কী হয়েছে। ফলে হাসপাতালে নিতে দেরি হয়ে যায়। সেখানে পৌঁছানোর পর ডাক্তারদের আর কিছু করার ছিল না। ব্র্যান্ডনের বাবা ব্রুস লির মৃত্যু ব্রেন এডেমা থেকে হয়েছিল। হঠাৎই তার প্রচণ্ড মাথাব্যথা আরম্ভ হয়। হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যথানাশক ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে এরকম অবস্থা হয়েছিল।আজও বিরাট সংখ্যক ভক্ত বাবা-পুত্রের অকাল মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের বিশ্বাস পরিবারটার উপর অভিশাপ আছে, না হলে এরকম করুণ মৃত্যুর ঘটনা কীভাবে পুনরাবৃত্তি হয়! সিয়াটল সফরে আরও একটা সমাধিতে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে শায়িত আছেন জিমি হেন্ড্রিক্স। এই প্রজন্মের অনেকে হয়তো তার নাম শুনেননি। তিনি ছিলেন রক অ্যান্ড রোলের ইতিহাসে সেরা বাজনাবাদক। তিনি গান লিখতেন ও সুর করতেন। কিন্তু তার যাদু ছিল গিটার বাজানোতে।
সেই সময়ে সারা বিশ্বে যে পপ সঙ্গীত জনপ্রিয় হয়েছিল, জিমি হেন্ড্রিক্স ছিলেন তার-ই একজন ধারক ও বাহক। বাজনাকে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাধ্যমে আকর্ষণীয় ও উচ্চমাত্রায় পরিবেশনা করার কৌশল তারই আবিষ্কার। শুধু তার গিটার বাজানো উপভোগ করতে হাজার মানুষ কনসার্টে হাজির হতো। উনার জীবনও সংক্ষিপ্ত হয়েছিল, ২৭ নভেম্বর ১৯৪২ – ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭০। তার মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছিল এক ঘুমের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরও ভক্তরা তাকে মনে রেখেছে। এখনও সমাধিতে এসে সম্মান জানিয়ে যাচ্ছে।
আমিও কিছুক্ষণ নীরবে ভক্তিভরে সেখানেও দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানাতে চেয়েছিলাম- তিনি যে পপসঙ্গীত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছিলেন তার জোয়ার সত্তরের দশকে বাংলাদেশেও গিয়ে লেগেছিল। সেই সময়কার বাংলাদেশের পপ তারকারা আমাদের সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তী হয়ে আছেন। চট করে ফিরোজ সাঁই, আজম খান, লাকি আখন্দ, জিঙ্গা শিল্পী গোষ্ঠীর নাম মনে এলো।
আজ আমরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতায় বসবাস করছি। এই উন্নতির মুখ্য অবদান আমাদের আগে যারা পৃথিবীতে বসবাস করে গেছেন তাদের সবার। তারা হয়তো কেউ নতুন কিছু আবিষ্কার করেছেন এবং অন্যরা সেটা ব্যবহার অথবা প্রয়োগ করে সমৃদ্ধি এনেছেন। আমরা তারই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলেছি। আমরা ভালো করেই জানি, বিশ্বের প্রতিটা মানুষ কোনো না কোনোভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এ ধারাবাহিকতা ও নির্ভরশীলতা সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে মানব সভ্যতাকে। সেই হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই প্রতিটা মৃত ও জীবিত মানুষের কাছে ঋণী, তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো আমাদের কর্তব্য।
কাজী হাসান, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস থেকে