বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা হোম অফিসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে ভুক্তভোগীদের শনাক্ত ও রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ ‘ন্যাশনাল রেফারেল মেকানিজম’ (এনআরএম) গত বছর রেকর্ড ১৯ হাজার ১২৫ জন ভুক্তভোগীকে আধুনিক দাসত্বের সম্ভাব্য শিকার হিসাবে নথিভুক্ত করেছে৷ এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৭ হাজার৷
আধুনিক দাসত্বের মধ্যে মানবপাচার, দাসত্ব, যৌন নিপীড়ন, গাড়ি পরিষ্কার, জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করার মতো বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ বিশ্লেষকেরা বলছেন, দারিদ্র্য, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অভিবাসনের কারণে বিশ্বজুড়ে আধুনিক দাসত্ব বাড়ছে৷ এর শিকার হচ্ছেন লাখো মানুষ৷
যুক্তরাজ্য আধুনিক দাসত্বের নানা ধরন রয়েছে৷ দেশটিতে পুরুষ, নারী কিংবা শিশুদের মাদক বা যৌন ব্যবসা, গাড়ি ধোয়া, সেলুন, ব্যক্তি মালিকানাধীন ঘরের গৃহস্থালি কাজ এবং সামাজিক পরিচর্যায় শোষণমূলক কাজে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে৷
ব্রিটেনের দাসত্ববিরোধী ইনডিপেনডেন্ট কমিশনার ইলিয়ানর লিয়ন্স বলেন, ‘‘এই পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়৷ এগুলো ভুক্তভোগীদের কথা, তাদের কথা সরকারের শোনা উচিত৷’’
তিনি বলেন, ‘‘একটি আন্তঃসরকার আধুনিক দাসত্ব কৌশল প্রয়োজন, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এই অপরাধ মোকাবিলায় অগ্রাধিকার দেবে৷’’
মানবাধিকার সংস্থা অ্যান্টি-স্লেভারি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে আধুনিক দাসত্বের শিকার মানুষের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার৷
আধুনিক দাসত্বের সম্ভাব্য শিকার ছয় হাজার শিশু
এনআরএম আধুনিক দাসত্বের সম্ভাব্য শিকার হিসাবে যাদের নথিভুক্ত করেছে, তাদের মধ্যে ২৩ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক৷ এছাড়া ১৩ শতাংশ নাগরিক নিয়ে তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে আলবেনিয়ার নাম৷ তৃতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনামিদের সংখ্যা ১১ শতাংশ৷
শঙ্কার বিষয় হলো, এনআরএম-এর ডেটা অনুযায়ী আধুনিক দাসত্বের সম্ভাব্য শিকারদের মধ্যে ৩১ শতাংশ বা ছয় হাজার শিশু রয়েছে৷
মোট ভুক্তভোগীর ৭৪ শতাংশ পুরুষ৷ আর অপরাধের ধরনে শীর্ষে রয়েছে শ্রম শোষণ৷ কারণ, ৩২ শতাংশ ভুক্তভোগী কর্মক্ষেত্রে শোষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন৷
অভিযোগকারীদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাজ্যের ভূখণ্ডে আধুনিক দাসত্বের শিকার হয়েছেন৷ আর ৪৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাজ্যের বাইরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷
যুক্তরাজ্যের বাইরে যে দেশগুলোতে অভিযোগকারীরা আধুনিক দাসত্বের শিকার হয়েছেন, সেখানে শীর্ষে রয়েছে লিবিয়ার নাম৷ এরপরেই আছে আলবেনিয়া ও ভিয়েতনাম৷
লিয়ন্স বলেন, ‘‘প্রতিটি ঘটনায় একেকজন মানুষের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার কথা উঠে আসে৷’’
দাতব্য সংস্থা ও আইনপ্রণেতারা ব্রিটেনকে আধুনিক দাসত্ব মোকাবিলায় তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে৷ শ্রম আইনের শক্তিশালী প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে নজর দিয়ে অভিবাসন নীতি সংস্কারেরও দাবি জানিয়েছে আইনপ্রণেতারা৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আশয়প্রার্থী বা অনিয়মিত অভিবাসীরাও যুক্তরাজ্যে আসার পর এনআরএম-এর কাছে যেতে পারবেন৷
মূলত ভুক্তভোগীদের কথা শুনে এনআরএম একটি সিদ্ধান্ত দেয়৷ সেই সিদ্ধান্তের আলোকে হোম অফিস আরেক দফা সিদ্ধান্ত দেয়৷ যেসব ভুক্তভোগীরা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পান, তাদেরকে অস্থায়ী বাসস্থান ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে যুক্তরাজ্য সরকার৷
গত মাসে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে হাজার হাজার মানুষ আধুনিক দাসত্বের জালে আটকা পড়ছে এবং ডিপোর্ট বা নির্বাসিত হওয়ার ভয়ে তারা সামনে এসে অভিযোগও করতে পারছে না৷
লিয়ন্স বলেন, ‘‘(আজকের) পরিসংখ্যান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে৷ তা হলো, আধুনিক দাসত্ব একটি অপরাধ এবং এটিকে অভিবাসন সংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা উচিত নয়৷’’
এনআরএম-এর কাজকে আরো গতিশীল করতে সংস্থাটিতে আরো কিছু সংখ্যক কর্মী নিয়োগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার৷ সরকারি তথ্য বলছে, গত বছরের শেষে ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন৷
সুরক্ষা চেয়েও মিলছে না প্রতিকার
এদিকে, যুক্তরাজ্যে আধুনিক দাসত্ব আইনের অধীনে সুরক্ষা চেয়ে আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার বেড়েছে৷ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এই হার ব্রিটেনের নাগরিকদের চেয়ে অনেক বেশি৷ অভিবাসী আইনের কড়াকড়ির কারণে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ হাজিরের বাধ্যবাধকতায় বিপাকে পড়েছেন তারা৷
২০১৯ সালে আধুনিক দাসত্ব আইন কার্যকর করে ব্রিটেন৷ সেসময় এই উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল৷ বিশেষ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরবরাহ চেইনের দাসত্ব প্রতিরোধ এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তির জন্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে আইনটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷
কিন্তু অনিয়মিত অভিবাসন রোধে ২০২৩ সালে কার্যকর হওয়া আইন এই প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার ব্যবস্থার সদস্য এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স৷
সাক্ষাৎকার দাতাদের মতে ব্রিটেনের কঠোর অভিবাস আইনের কারণে হাজার অভিবাসী আধুনিক দাসত্বের ফাঁদে পড়ছেন৷ বিপদে পড়ে একদিকে সহায়তা যেমন পাচ্ছেন না তারা, অন্যদিকে ডিপোর্ট বা প্রত্যাবাসনের ভয়ে অনেকে এ বিষয়ে অভিযোগ জানাতেও ভয় পাচ্ছেন৷
রয়টার্স