অবৈধ অভিবাসী বহিষ্কারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়নে ট্রাম্প প্রশাসন প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করছেন। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রচলিত আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে ইচ্ছেমতো আইনের ব্যাখ্যা করছেন, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ অমান্য করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী অভিবাসীদের পরিবার এবং তাদের মার্কিন আইনজীবীরা।
চলতি সপ্তাহে, ১৭৯৮ সালের ‘বিদেশি শত্রু আইন’ পুনরুজ্জীবিত করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এই আইনটি আমেরিকার ইতিহাসে এর আগে মোট তিনবার ব্যবহার করা হয়েছে এবং প্রতিবারই যুদ্ধকালীন সময়ে, শান্তিপূর্ণ সময়ে কখনো নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে এই আইন কার্যকর করেছেন। এই আইনের ‘গ্রে এরিয়া’র মারপ্যাচে কথিত ভেনেজুয়েলান গ্যাং সদস্যদের বহিষ্কার করা হয়েছে। অবশ্য এই কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন একজন মার্কিন বিচারক। বহিষ্কার করা অভিবাসীদের ফেরত আনার নির্দেশ দিলেও ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে তাদের এল সালভাদরে পাঠিয়ে দিয়েছে। বিচারক বোয়াসবার্গ তার আদেশে লিখেছেন, ‘যে কোনো ফ্লাইটে এই ব্যক্তিরা থাকলে, তা বাতিল করতে হবে বা আকাশে থাকলে যেভাবেই হোক তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।’ তবে ট্রাম্প প্রশাসন এই আদেশ সত্ত্বেও বহিষ্কার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে, দাবি করেছে যে ফ্লাইটগুলো আদেশ জারির আগেই যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমা পার হয়ে গিয়েছিল। উপরন্তু, হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বিচারকের আদেশের সমালোচনা করে বলেছেন, ফেডারেল আদালত প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। লেভিট আরও বলেন, ‘তদ্ব্যতীত, সুপ্রিম কোর্ট বারবার স্পষ্ট করেছে যে—ফেডারেল আদালত সাধারণত প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রনীতি, বিদেশি শত্রু আইন অনুযায়ী তার ক্ষমতা, এবং মার্কিন মাটি থেকে বিদেশি সন্ত্রাসীদের অপসারণ বা ঘোষিত আক্রমণ প্রতিহত করার সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।’ যদিও ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে যে বহিষ্কার কার্যক্রম ‘বিদেশি শত্রু আইন’ অনুসারে বৈধ, তবে আইনি চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে। বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে বোয়াসবার্গের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের বিদায়ী বছরে পৃষ্ঠপোষকতা প্রক্রিয়ার অধীনে কিউবা, হাইতি, নিকারাগুয়া এবং ভেনেজুয়েলা থেকে আগত মোট ৫৩২,০০০ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সুরক্ষা (প্যারোল) দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তা স্থগিত করা হয়। এদের বৈধতা আগামী এপ্রিলের শেষের দিকে বাতিল হবে বলে ফেডারেল সরকার কর্তৃক প্রকাশিত এক নোটিশে জানানো হয়েছে। এদিকে মার্কিন ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান মোতাবেক, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম সাত সপ্তাহে ২৮,০০০-এর কিছু বেশি নির্বাসন কার্যকর করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতাগ্রহণের পর বিগত ২০ জানুয়ারি থেকে ১১ মার্চের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এলাকা থেকে ২৮,৩১৯ জনকে অপসারণ করা হয়েছে, যা গড়ে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩,৮৮৭ জন বা প্রতিদিন ৫৫৫ জনের সমান। কিন্তু, ভুক্তভোগী অভিবাসীদের পরিবার এবং তাদের আইনজীবীরা অভিযোগ করছেন যে, চলমান নির্বাসন প্রক্রিয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন নির্বাসিতদের পূর্ণাঙ্গ বিচারিক প্রক্রিয়া বা ডিউ প্রসেস-এর সুযোগ দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসকারী অনেক অভিবাসী, বিশেষ করে অস্থায়ী ভিসা এবং গ্রিনকার্ডধারীরাও ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন যে তাদের নথিপত্র যেকোনো সময় বাতিল হতে পারে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে, প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন নীতি পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছেন এবং বহু পুরনো অভিবাসন আইন ব্যবহারের ওপর নির্ভর করছেন, যা দীর্ঘদিন ধরে হয়তো খুব বেশি প্রয়োগ করা হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন যে, তিনি সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রতি সমর্থন দেখানো অথবা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ মতামত পোষণকারী ব্যক্তিদের ভিসা বাতিলের জন্য পদক্ষেপ নেবেন। গত রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সিবিএস টেলিভিশনের ‘ফেইস দ্য ন্যাশন অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রতিদিন আমরা এখন ভিসা বাতিল অনুমোদন করছি।
ইমিগ্রেশন আইন মোতাবেক, পররাষ্ট্র দপ্তর ভিসা অনুমোদনের আগে পটভূমি যাচাই করে, কিন্তু যখন একজন ভিসাধারী বা অভিবাসী সীমান্তে পৌঁছান, তখন মার্কিন ‘কাস্টমস ও বর্ডার প্রটেকশন’ কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং কর্মকর্তারা যাচাই করেন কোনো সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে কিনা। এটি এমনকি পর্যটন ভিসাধারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। কেউ যদি শুরুতে বলে যে সে দুই সপ্তাহের জন্য ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড ভ্রমণে এসেছে, কিন্তু পরে সীমান্ত কর্মকর্তাকে জানায় যে সে আরও দীর্ঘ সময় থাকতে চায় এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরবে, তাহলে সন্দেহ তৈরি হতে পারে এবং এটি ভবিষ্যতে সমস্যার কারণ হতে পারে।
বিদ্যমান ইমিগ্রেশন আইনে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা যেকোনো ব্যক্তির—এমনকি যারা বৈধ অভিবাসন মর্যাদা ছাড়াই রয়েছেন—সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত কিছু অধিকার রয়েছে, যেমন মুক্তভাবে মতপ্রকাশের অধিকার এবং নিয়মতান্ত্রিক বিচারপ্রক্রিয়ার অধিকার, যার মাধ্যমে তাদের মামলা আদালতে শোনার সুযোগ পাওয়ার কথা। তবে, যেহেতু অভিবাসন বিষয়টি পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এ বিষয়ে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫০ এর দশকের ‘রেড স্কেয়ার’ সময়কার পুরনো বহিষ্কার আইনগুলোর ব্যবহার করতে বেশি আগ্রহী। রেড স্কেয়ার বলতে এমন একটি সময়কে বোঝায় যখন যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিজম বা সাম্যবাদ নিয়ে ব্যাপক ভয় ও সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ে, এবং দুই দফায় (১৯১৯-১৯২০) ও (১৯৪৭-১৯৫৭) সময়কালে এখনকার মতো নিরপরাধ মানুষও ভয়, আতঙ্ক এবং দমন-পীড়নের শিকার হন, বিশেষ করে এমন ব্যক্তিরা যারা খোলাখুলিভাবে মতপ্রকাশ করেন। এখন দেখার বিষয় হলো আদালত এগুলোকে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বাতিল করে কিনা, নাকি সংবিধানের পরেও আদালত সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রেসিডেন্টের তাদের বহিষ্কারের অধিকার রয়েছে।
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক কয়েকটি ইমিগ্রেশন ল ফার্ম থেকে জানা গেছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন আইনের অপব্যবহার করছেন। আইন অনুসারে, গ্রীনকার্ডধারীদের অবশ্যই একজন বিচারকের সামনে হাজির হওয়ার নোটিশ দেয়া উচিত, কিন্তু এই প্রশাসন আদালতের অনুমোদন ছাড়াই নির্বিচারে তাদের স্থায়ী বসবাসের মর্যাদা কেড়ে নিচ্ছে। আইনজীবীরা মনে করছেন এই প্রশাসন আইন নিজ হাতে তুলে নিয়েছে এবং বিচার বিভাগের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা দেখাচ্ছে।
সম্প্রতি রাসা আলাওয়িহ নামের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির একজন সহকারী অধ্যাপক ডিভাইস তল্লাশির শিকার হয়েছেন। তিনি একজন হিজবুল্লাহ নেতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান ও সমর্থনের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করায় এবং নিজের ফোনে হিজবুল্লাহ নেতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছবি রাখার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি পাননি। তাকে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হয়।আরেকটি বড় ঘটনা হলো গ্রিনকার্ডধারী কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্র মাহমুদ খলিলকে আটক করা। তিনি ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ চলাকালে তাঁর ক্যাম্পাসে প্রো-প্যালেস্টাইন বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্মকর্তা বেকহ্যাম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘যে কোনো বিদেশি নাগরিক যারা চরমপন্থী মতবাদ প্রচার করে বা সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রচারণা বহন করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুপযুক্ত—এটি সহজ ও পরিষ্কার নীতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি ভিসা থাকলেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিশ্চিত হয় না, বরং ‘সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থা’ চূড়ান্ত নিরাপত্তা যাচাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেয়।’
এদিকে আইনজীবী ও সাবেক অভিবাসন কর্মকর্তারা বলছেন, অভিবাসন কর্মকর্তারা এখন অভিবাসী এবং পর্যটকদের আরও কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করছে, তাদের ভিসা গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে এবং পূর্বের তুলনায় বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে আটক করছে, যা আগের নীতির থেকে একটি বড় বিচ্যুতি।
সাধারণত, ভিসা সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা অতিরিক্ত কাগজপত্র আনতে বলতেন বা বহিষ্কার কার্যক্রম শুরু করতেন। তবে তুলনামূলক ছোটখাটো লঙ্ঘনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে আটক করা খুবই বিরল ছিল। কিন্তু, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম দিনের নির্বাহী আদেশের পর ‘চরম যাচাই-বাছাই’ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে ভিসা ও গ্রিনকার্ড আবেদনকারীদের পাশাপাশি পুনরায় প্রবেশকারী অভিবাসীদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। আইনজীবীরা বলছেন, এই নির্দেশনার ফলে কর্মকর্তাদের ওপর আরও বেশি লঙ্ঘনকারী খুঁজে বের করার চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যাতে দেশটিতে প্রবেশের শর্ত কঠোর করা যায়। ট্রাম্প প্রশাসন বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা হচ্ছে।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটির মুখপাত্র ট্রিসিয়া ম্যাকলাফলিন বলেছেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন আইন প্রয়োগ করছে—যা আগের প্রশাসন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। যারা এই আইন লঙ্ঘন করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে, আটক করা হবে এবং প্রয়োজনে বহিষ্কার করা হবে।’ এই ধরনের ঘটনার ফলে মার্কিন ভিসাধারীরা ভ্রমণের বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন, বলছেন আইনজীবীরা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিদেশি নাগরিকরা কাজ করেন, তারা এখন তাদের কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের যথাযথ পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাউন ইউনিভার্সিটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছে যেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ভ্রমণ না করে, কারণ সম্প্রতি তাদের একজন অধ্যাপক লেবানন সফরের পর ফেরার সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছেন। এছাড়া, কর্মকর্তারা এখন অভিবাসন আবেদনকারীদের কাছ থেকে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য চাচ্ছেন এবং বিমানবন্দরে মোবাইল ফোন তল্লাশির হারও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক অনিয়মিত অভিবাসী যারা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বা বৈধতা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন, তারা ‘স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ’ করতে চাইছেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নিরা বলছেন, আইনজীবীর পরামর্শ ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেয়া কারো উচিত নয়। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করলে দীর্ঘমেয়াদি পুনঃপ্রবেশ নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে এবং ভবিষ্যতে অভিবাসন আবেদন জটিল হয়ে উঠতে পারে।