‘থিঙ্কিং মাস’ বললে বাংলার ফেলুদা-ব্যোমকেশ আর বিদেশি শার্লকের ধারেকাছে জনপ্রিয় মনে হয় এখনও কেউ নেই। ঝকঝকে শান দেওয়া দৃষ্টি, ক্ষুরধার মগজ আর আলোর গতিতে ছুটে চলা চিন্তা-ভাবনাই তো মনে ঝড় তুলেছে আপামর বাঙালির। হি-ম্যান টাইপ মাসল সর্বস্ব পুরুষের সেখানে ঠাঁই নেই, আইকিউয়ের ঝকঝকে প্রতিফলনই আসল স্টাইল স্টেটমেন্ট বলে মনে করেন অনেকেই।
সুকুমার রায়ের মতো বলতে গেলে, “আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি ‘ফুটস্কোপ’ দিয়ে, দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে। কোন দিকে বুদ্ধিটা খোলে, কোন দিকে থেকে যায় চাপা”…
সুকুমার রায় ঠিকই ধরেছিলেন, আমাদের মগজের বেশিরভাগটাই ঘিরে রেখেছে মেকি, ভেজাল চিন্তা-ভাবনা, আর যে কারণেই মস্তিষ্কের কুঠুরিগুলো ভরে উঠে টইটম্বুর হয়ে গেছে। এই ভিড়ে ঠাসা কুঠুরি থেকে দরকারি জিনিসপত্র বের করে আনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই যদি এখন স্কুলের ভূগোলের বইয়ের পড়া মনে করতে যাই, তাহলে খাবি খেতে হবে। বোর্ডের পরীক্ষার মুখস্থ পড়া মনে করতে গেলে একেবারে হরিবোল হয়ে যাবে। এটাই হল কারণ, আমরা গাদা গাদা তথ্য জোর করে চেপেচুপে মাথার ভেতরে ভরে রাখি। তারপর কম্পিউটারে মেমোরির মতো তার ওপর পরতে পরতে আরও তথ্য জমা হতে থাকে। তার উপর রোজকার জীবনের নানা বদভ্যাস তো আছেই। সব মিলিয়ে মগজে বুদ্ধির বদলে দুর্বুদ্ধিই বোধহয় বেশি জমা হচ্ছে। ক্ষুরধার বুদ্ধি এখন ক’জনেরই বা হয়!
অ্যালঝাইমার্স অ্যাসোসিয়েশন জার্নাল একটি গবেষণাপত্র ছেপেছে। সেখানে রটম্যান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. লাপলুম দাবি করেছেন, এই যে মানুষের বুদ্ধি কমছে, মস্তিষ্কের বাড়বৃদ্ধি তেমন হচ্ছে না, এর কারণ কিন্তু একটা নয়, বরং একাধিক। এমন কিছু অভ্যাস আছে যা বুদ্ধির বিকাশে বাধা তৈরি করে। এখনকার সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে এগুলোই হল বুদ্ধি কমে যাওয়ার কারণ।
১) মাথায় হাজারও চাপ, মন জুড়ে অবসাদ
আমাদের রোজকার অভ্যাসে এমন কিছু ভুল আছে যা মানসিক চাপের (Mental Stress) কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্ট্রেসময় হয়ে উঠছে জীবন। ক্রমশই বেড়ে চলেছে অবসাদ। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা অবসাদ। স্ট্রেস, স্মৃতিনাশ বা ডিমেনশিয়ার মতো মনোরোগের শিকার এখন অনেকেই। মনের অসুখে বেশি ভুগছেন কমবয়সিরাই। মুড স্যুয়িং, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন এই ডাক্তারি শব্দগুলো এখন চেনা। অবসাদ দিয়ে শুরু হয়, শেষে তা রোগে পরিণত হয়। চরম অবসাদ, স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি মুড ডিসঅর্ডারের (Mood Disorder) কারণ। রোগের বাড়াবাড়ি হলে এবং জটিল পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছলে তাকে ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারও বলা হয়। একই মানুষের মধ্যে যদি কখনও ডিপ্রেশন, আবার কখনও হাইপোম্যানিয়ার পর্ব চলতে থাকে, তাকে বলা হয় বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার। এসবই মগজের ধার কমিয়ে দিতে পারে।
২) নেশাই সর্বনাশা
অতিরিক্ত নেশা মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। লোকজন উল্টোটাই ভাবেন। কাজের চাপ বাড়লে বা উদ্বেগ বাড়লে সিগারেটে সুখটান দিয়ে ভাবেন চাপ কমবে। নিকোটিন কিছুটা সময়ের জন্য মাথা হাল্কা করে দেয় ঠিকই, কিন্তু এটা সাময়িক। তামাকজাত দ্রব্য ব্রেনের চরম ক্ষতি করে। তার ওপর অ্যালকোহলের নেশা থাকলে ফল হয় আরও মারাত্মক। দীর্ঘদিনের নেশার অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদি অবসাদের কারণ হয়ে ওঠে।
৩) ঘুমই হয় না ঠিক করে
আপনার ঘুম কি খুব পাতলা? রাতে বার বার ঘুম ভেঙে যায়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাতভর যদি বার বার ঘুম ভাঙে (Irregular Sleeping) তাহলে সেটা ভাল লক্ষণ নয়। কম ঘুম (Lack of deep sleep) বা অনিদ্রার সমস্যা থাকলে তার থেকেই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে নানা রোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়সকালে ঘুম কমে যায়। কিন্তু এখন কমবয়সিরা এত বেশি সোশ্যাল মিডিয়া আর নেট মাধ্যমে ব্যস্ত যে ঘুমের সময়ই নেই তাদের। রাতভর ল্যাপটপ, মোবাইলে সিনেমা, সিরিজ দেখা, কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনা ঘুমের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্লিপিং ডিসঅর্ডারের সমস্য়া এখন ঘরে ঘরে। ঘুমই যদি না হয়, তাহলে আর বুদ্ধির গোড়ায় হাওয়া-বাতাস খেলবে কী করে।
৪) একলা থাকার অভ্যেস
একা থাকার অভ্যাস, মেলামেশা না করা মানসিক উদ্বেগের (Mental Stress) অন্যতম কারণ। অনেকেই নিজের পরিবারে সকলের মধ্যেও একা থাকতে পছন্দ করেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মেলামেশাও কম। এইসব থেকেই একাকীত্বের বোধ তৈরি হয়। আর এটাই ক্রমে অবসাদের দিকে নিয়ে যায়।
৫) অপুষ্টি
কম ঘুম, ডিহাইড্রেশন, পুষ্টিকর খাবারের অভাব, মূত্রনালীর সংক্রমণ থেকেও নানা রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। ভুলভাল খাওয়ার অভ্যাস, সবসময় জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ইচ্ছা, হজমের গোলমাল সবই মগজাস্ত্রে মরচে পড়ার কারণ।
ভাত, রুটি, দুধ, মাছ, ফল, শাকসব্জি রোজকার খাবারে দরকার। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। স্ট্রেস যেন আপনাকে ঘায়েল করতে না পারে। দরকারে স্ট্রেস ম্যানেজ মেন্ট শিখতে হবে। একাকীত্বে ভুগলে তার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।
৬) নতুন কিছু শেখার ইচ্ছা কম
মনোবিদরা বলছেন, এখনকার প্রজন্মের নতুন কিছু শেখার অভ্যাস কম। বরং অবসর সময়টা কাটছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন সর্বক্ষণ নেগেটিভ খবর ঘোরাফেরা করে। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, দুর্ঘটনা ইত্যাদির খবর ক্রমাগত পড়তে থাকলে মনের ওপরেও চাপ তৈরি হয়। তাছাড়া বাকি লোকজনের লাইফস্টাইল অনুসরণ করতে গিয়ে অজান্তেই নিজের উদ্বেগ বেড়ে যায়। চাহিদাও বাড়ে। আর সেসব পূরণ না হলেই তার থেকে হতাশা, ডিপ্রেশন দেখা দিতে থাকে।
নতুন কোনও কাজ শেখার চেষ্টা করলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে। যে কাজ কখনওই করবেন বলে ভাবেননি, তেমনই কিছু শেখার চেষ্টা করুন। এতে মস্তিষ্কও সক্রিয় থাকবে। রোজ একইরকম কাজ না করে তাতে বৈচিত্র্য আনুন। গবেষকরা বলছেন, কাজে বৈচিত্র্য থাকলে মস্তিষ্কেরও ওয়ার্কআউট হয়। মাথা যত ঘামাবেন ততই তার কাজ করার ক্ষমতা বাড়বে। যেমন, মাথা খাটবে এমন খেলা খেলুন। ভিডিও গেম নয় খেলুন ব্রেন গেম। ইন্টারনেটে ব্রেন গেমের নানা রকম ভিডিও দেখুন। দাবা খেলুন।
যা কিছু পড়বেন চেষ্টা করুন জোরে পড়ার। এতে শব্দগুলো মাথায় গেঁথে যাবে। মনে রাখার ক্ষমতা বাড়বে।
৭) সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে সময় কোথায়!
বর্তমান সময় মনোবিদেরা ‘ব্রেন ফগ’ (Brain Fog) কথাটা খুব ব্যবহার করেন। বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময় ব্রেন ফগের উপসর্গ দেখা দিয়েছিল অনেকেরই। ভুল বকা, ভুলে যাওয়া, চিন্তাভাবনা গুলিয়ে যাওয়া, কিছুই মনে রাখতে না পারার মতো সমস্যা দেখা দিয়েছিল। মন এবং মস্তিষ্কের এমন অবস্থাই হল ‘ব্রেন ফগ’। মানে মস্তিষ্কের ভেতর ধোঁয়াশা তৈরি হওয়া।
ব্রেন ফগ (Brain Fog) কোনও রোগ নয়, একরকম মানসিক অস্থিরতা। ক্লান্তি, বিরক্তি ও অলসতার অনুভূতিকে ব্রেন ফগ বলে। এর কোনও নির্দিষ্ট কারণ নেই। যে কোনও কারণেই হতে পারে। ঘুমের ব্যাঘাত, রাত জেগে কাজ করা, বিশ্রামের অভাব, মানসিক চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি ব্রেন ফগের কারণ হতে পারে। এখনকার সেডেন্টারি লাইফস্টাইলই এর জন্য দায়ী। দিনের পর দিন মস্তিষ্কের অস্থিরতা বাড়লে তার চিন্তাভাবনা করার স্বাভাবিক ক্ষমতা তো কমবেই!
মনোবিদরা বলছেন, ব্যায়াম ও কিছু কিছু অ্যারোবিক্স মস্তিষ্ককে সচল রাখতে সাহায্য করে। অনেক রকম ব্রেন অ্যারোবিক্স আছে। রোজের কাজের মধ্যেই করতে পারেন।
অবসরের সময় হাতে তুলে নিন ক্রশওয়ার্ড বা শব্দছক মেলানোর পাতা। বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে শব্দছক পাওয়া যায়। এতে শব্দের ভাঁড়ার বাড়ে, মস্তিষ্কও খাটাতে হয়। তাতে স্মৃতিশক্তি আরও মজবুত হয়। মেমোরি গেম খেলতে পারেন। পরিবার বা বন্ধুদের আড্ডায় সমালোচনা না করে বরং মেমোরি গেম খেলুন। এতে মনে রাখার ক্ষমতা অনেক বাড়বে। সুদোকু বা পাজল বোর্ড সমাধান করার অভ্যাস তৈরি করুন। নিজের সন্তানকেও এমন অভ্যাস করান। এতে মনে রাখার ক্ষমতা (Boost Memory) যেমন বাড়বে, তেমনই মেধার ধারও বাড়বে।