বিমানবন্দর পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর অন্যতম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কোনো একটি সময়ে গড়ে ৯ হাজার ৭০০টির বেশি বিমান প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী নিয়ে ওঠানামা করে। বিমানবন্দরগুলো দক্ষভাবে বিমান চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সরবরাহ করে। কিন্তু সব বিমানবন্দরই নিরাপদ নয়। কিছু বিমানবন্দরকে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বিশেষ করে দুর্গম ভৌগোলিক অবস্থান বা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে।
ব্রিটিশ জাতীয় দৈনিক দ্য ডেইলি এক্সপ্রেস বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ১০টি বিমানবন্দরের তালিকা করেছে। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
নেদারল্যান্ডসের ক্যারিবীয় দ্বীপ সাবায় হোয়ানচো ই. ইরাউসকুইন বিমানবন্দর অবস্থিত। এটি অত্যন্ত ছোট ও সংকীর্ণ রানওয়ের জন্য পরিচিত, যার দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে শুধু একাংশ ব্যবহারযোগ্য। এই রানওয়ে বিমান ওঠানামা করার কাজে ব্যবহৃত রণতরির চেয়ে খুব বেশি বড় নয়। বিমানবন্দরটির রানওয়ের চারপাশ খাড়া পাহাড়ে ঘেরা। ফলে নিরাপদে ওঠানামা করতে হলে বৈমানিকদের অত্যন্ত দক্ষ হতে হয়। রানওয়েটি সাবার একমাত্র সমতল ভূমিতে নির্মিত। এটির উভয় পাশে সাগরের দিকে খাড়া ঢাল রয়েছে।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে ম্যাকমার্ডো আইস রানওয়ে অবস্থিত। মহাদেশটিতে ছোট বিমান অবতরণের একমাত্র রানওয়ে এটি। বরফাচ্ছন্ন অবস্থা ও মাত্র ৫৫৭ মিটার দীর্ঘ হওয়ায় এটিকে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
গ্রীষ্মকালীন গবেষণা মৌসুমে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টার্কটিক কর্মসূচির প্রধান রানওয়ে হয়ে ওঠে ম্যাকমার্ডো আইস রানওয়ে। প্রতিবছরের শুরুতে বরফের ওপর অস্থায়ী রানওয়ে তৈরি করা হয় এবং ডিসেম্বরের শুরু পর্যন্ত এটি ব্যবহার করা যায়, যতক্ষণ না সাগরের বরফ গলতে শুরু করে।
নেদারল্যান্ডসের অধীন ক্যারিবীয় দ্বীপ আরুবার দক্ষিণে অবস্থিত এই বিমানবন্দর সংকীর্ণ রানওয়ে ও উত্তাল বাতাসের জন্য পরিচিত। বাতাসের কারণে বৈমানিকদের জন্য এই রানওয়েতে বিমান ওঠানামা করানো বেশ কঠিন। এটি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের কিছু দেশে ফ্লাইট পরিষেবা দিয়ে থাকে। বিমানবন্দরটির নামকরণ করা হয়েছে নেদারল্যান্ডসের সাবেক রানি বিয়াট্রিক্সের নামে, যিনি ১৯৮০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সিংহাসনে ছিলেন।
কুরচেভেল বিমানবন্দর ফ্রান্সের আল্পস পর্বতমালায় অবস্থিত। এটির রানওয়েতে অবতরণের পর বৈমানিককে তীব্র বাঁক নিতে হয়। চারপাশে খাড়া পাহাড়ের কারণে এই রানওয়েতে অবতরণ ব্যর্থ হলে আবার ঘুরে এসে অবতরণের সুযোগ নেই। রানওয়েটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৫৩৭ মিটার। সে হিসাবে এটি বিশ্বের অন্যতম ছোট রানওয়ে। এ রানওয়েতে কুয়াশা বা মেঘাচ্ছন্ন অবস্থায় অবতরণ করা প্রায় অসম্ভব। বিমানবন্দরটি মূলত ছোট বিমান ও হেলিকপ্টার ওঠা–নামার কাজে ব্যবহৃত হয়।
ভুটানে হিমালয় পর্বতমালায় পারো বিমানবন্দর অবস্থিত। চারপাশে উঁচু পাহাড়চূড়ার কারণে সেখানে বিমান ওঠা–নামা বেশ কঠিন। বিমানবন্দরটি ভুটানের পারো শহর থেকে প্রায় ৩ দশমিক ৭ মাইল দূরে এক গভীর উপত্যকায় নদীর ধারে অবস্থিত। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে অত্যন্ত অল্পসংখ্যক বৈমানিক এই বিমানবন্দরে অবতরণের অনুমোদন পান। এখানে শুধু অনুকূল আবহাওয়া ও দিনের বেলায় ফ্লাইট পরিচালনা করা যায়। ঝোড়ো বাতাসের মৌসুমে বিমান ওঠানামার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
এটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট বাণিজ্যিক বিমানবন্দর। এর দৈর্ঘ্য মাত্র ৫৪৯ মিটার। জিব্রাল্টার পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ বিমানবন্দরের রানওয়ে ছোট এবং সীমিত দৃষ্টিসীমার কারণে সেখানে বিমান ওঠানামা করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পাহাড়ের চারপাশ ও সাগরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত আড়াআড়ি বাতাসের কারণে এই বিমানবন্দর অনেক বিপজ্জনক। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন রানওয়েটি জিব্রাল্টার রাজকীয় বিমানবাহিনী পরিচালনা করে। আর বেসামরিক টার্মিনাল পরিচালনা করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষ। বিমানবন্দরটির ভেতর দিয়ে চলে গেছে গাড়ি চলাচলের একটি সড়ক। প্রতিবার বিমান ওঠানামার সময় সড়কটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পর্তুগালের কাছে একটি ছোট্ট দ্বীপে মাদেইরা বিমানবন্দর অবস্থিত। এটির রানওয়ের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৭৮১ মিটার। তীব্র বাতাস ও পার্বত্য ভূখণ্ডের কারণে বৈমানিকদের এখানে অবতরণের জন্য বেশ দক্ষ হতে হয় এবং অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
মাদেইরা ভৌগোলিকভাবে একটি অস্বাভাবিক ধরনের বিমানবন্দর, যা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে থাকা একটি ভূখণ্ডে অবস্থিত। রানওয়ের শেষে রয়েছে পাহাড় ও খাড়া পাহাড়ি ঢাল, যার ফলে এখানে সরাসরি যন্ত্রনির্ভর অবতরণব্যবস্থা ব্যবহার করে উড়োজাহাজের অবতরণ সম্ভব নয়। ফলে বিমানকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে রানওয়েতে অবতরণ করতে হয়।
ক্যারিবীয় দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের নেদারল্যান্ডস অংশে অবস্থিত বিখ্যাত মাহো সমুদ্রসৈকতের সামনে এই বিমানবন্দরের সংকীর্ণ রানওয়ে অবস্থিত। এটি কুখ্যাত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত। কারণ, এর উচ্চতা খুবই কম। সেখানে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়নের জন্য অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও নির্ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। স্থানীয় বিমানবন্দরের নিয়ম অনুযায়ী, ১৫০ মিটারের (৫০০ ফুট) নিচে উড়োজাহাজ ওড়া নিষিদ্ধ। পর্যটকেরা প্রায়ই বিপজ্জনক এ বিমানবন্দরের সমালোচনা করেন।
হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুসিগালপায় অবস্থিত টনকন্টিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে বিশ্বের দ্বিতীয় বিপজ্জনক বিমানবন্দর হিসেবে ধরা হয়। এটির রানওয়ে খুবই ছোট এবং এটি ১ হাজার ৫ মিটার উচ্চতায় পাহাড়ঘেরা এলাকায় অবস্থিত। বিশেষ করে খারাপ আবহাওয়ার সময় এখানে উড়োজাহাজের অবতরণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে সবচেয়ে বড় যে উড়োজাহাজ অবতরণ করে, সেটি সাধারণত অ্যাভিয়াস্তা এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৩৭-২০০ মডেলের বিমান। বিমানবন্দরটির রানওয়ে এতই ছোট যে অনেক বিমান অবতরণের সময় রানওয়ের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে ফেলে, যা নিষিদ্ধ।
নেপালে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত লুকলা বিমানবন্দর তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দর নামেও পরিচিত। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিমানবন্দর বলে মনে করা হয়। দুই পর্বতের মাঝখানে অবস্থিত এ বিমানবন্দরে মাত্র ৪৫৭ মিটার দীর্ঘ রানওয়েতে উড়োজাহাজ ওঠানামা করার জন্য বৈমানিকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। ঝোড়ো বাতাস, ঘন মেঘ ও হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এখানে প্রায়ই ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বিত হয়। মাউন্ট এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে অভিযান শুরু করার জন্য এ বিমানবন্দর বেশ জনপ্রিয়। প্রথমে বিমানবন্দরটি সমতল জমিতে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু কৃষকেরা জমি ছাড়তে না চাওয়ায় ১৯৬৪ সালে এটি বর্তমানে যেখানে অবস্থিত, সেখানেই নির্মিত হয়।