জাপানের ইয়ামানাশি জেলার দুর্গম পর্বতের গভীরে দেখা পাবেন নিশিয়ামা ওনসেন কিওনকান নামের এক হোটেলের। এখানকার জাপানের ঐতিহ্যবাহী তাতামি বিছানো মেঝে, কিমোনো পড়া হাসিখুশি কর্মচারী এবং দেয়ালে শোভা যাওয়া হাতে লেখা ক্যালিগ্রাফি দেখলে ভাববেন সময় যেন থমকে গেছে জায়গাটিতে এসে। আর এটি মোটেই কাকতালীয়ভাবে নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো হোটেলের তকমা গায়ে লাগানো নিশিয়ামা ওনসেন কিওনকানের বয়স অবিশ্বাস্য হলেও ১৩০০ বছরের বেশি।
কিংবদন্তি অনুসারে ৭০৫ সালে ওই সময়কার এক অভিজাত পরিবারের সদস্য ফুজিওয়ারা মাহিতো এ এলাকা ভ্রমণে এসে উষ্ণ প্রস্রবণগুলো দেখতে পান। এই উষ্ণ প্রস্রবণ আর চারপাশের মনোরম প্রকৃতি দেখেই এখানে রিওকান বা জাপানের ঐতিহ্যবাহী উষ্ণ প্রস্রবণ হোটেল তৈরির চিন্তা মাথায় আসে। তারপর দ্রুতই তাঁর মন থেকে বাস্তব অস্তিত্ব পায় এটি। গত এক হাজারের বেশি বছরে অনেক অভিজাত ও বিখ্যাত ব্যক্তিই পদধূলি দিয়েছেন এখানে। এমনকি জাপানের বর্তমান সম্রাট নারিহিতোও এই হোটেলের উষ্ণ প্রস্রবণে শরীর ভেজাতে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছিলেন।
এ ধরনের রিওকান বহু বছর ধরেই জাপানে পরিচিত। তবে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছে ২০১১ সালে, যখন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস নিশিয়ামা ওনসেন কিওনকানকে বিশ্বের প্রাচীনতম হোটেলের স্বীকৃতি দেয়। ঘোষণাটি এটিকে বিদেশি পর্যটকদের নজরে নিয়ে আসে। এখন তার ১৩০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখে এই পর্যটকদের মনে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করছে ঐতিহ্যবাহী হেটেলটি।
উষ্ণ প্রস্রবণের এই হোটেলে পৌঁছানো মোটেই সহজ নয়। প্রথমে পর্যটকদের শুজুকা জেলার একই নামের ব্যস্ত স্টেশন থেকে পুবমুখী বুলেট ট্রেনে চড়তে হবে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকবে সবকিছু। ক্রমেই ছোট হতে থাকা স্টেশনগুলোর সঙ্গে চারপাশে গ্রামীণ পরিবেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এমনকি কোনো স্টেশনে এমনকি টিকিট বুথও চোখে পড়বে না।
এক ঘণ্টার ট্রেনভ্রমণে আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিখ্যাত ফুজি পর্বতের পুরোটাকে দেখতে পাবেন অতিথিরা। একসময় নেমে আসবেন কেবল এগারো হাজার জনসংখ্যার মিনোবু নামের একটি গ্রামে। এখানে অপেক্ষায় থাকবেন হোটেলের পাঠানো বাসের জন্য। তারপর আঁকাবাঁকা পথে পর্বতের ক্রমেই ভেতরে ঢুকে পড়বেন। একপর্যায়ে দৃষ্টিসীমায় চলে আসবে হাজারবর্ষী সেই হোটেল।
ঐতিহ্যবাহী কিমোনো পরা কর্মীরা স্বগত জানাবেন অতিথিদের। লবি থেকে হোটেল কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা স্লিপার পায়ে গলাতে হবে। হোটেলটির সাধারণ কামরাগুলোর তিনটি অংশ। দুটো বসবার জায়গা এবং একটি থাকার জায়গা। জানালাগুলি এত বড় যে বাইরের জঙ্গলের দৃশ্যকে মনে হতে পারে দেয়ালে আঁকা ছবি।
নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া একটি বড় নদী এবং বাষ্পের শব্দ উষ্ণ প্রস্রবণের উপস্থিতির আভাস দেয়। মোট ছয়টি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে এখানে। চারটি হোটেল বা রিসোর্টটির বাইরে এবং দুটি ভেতরে। এগুলোতে স্পা করা এই হোটেলের বড় আকর্ষণ।
প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবেন ভেতরেও। মেঝেগুলি স্থানীয় পাথরের তৈরি, স্নানাগার কাঠের তৈরি এবং কৃত্রিম গাছপালা খোদাই করা আছে দেয়ালে। পাঁচ কোর্সের ডিনারে থাকবে ঐতিহ্যবাহী সুসি, তফু, হালকা স্যুপ, স্মোকড মাছ, গ্রিলড মাংস ইত্যাদি।
হোটেলটি বৈচিত্র্যময় নানা ঘটনার সাক্ষী। ১৯০৯ এবং ১৯১৬ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়। এদিকে ১৯২৫ সালে বিশাল এক পাথর হোটেলের একটি বড় দালান ধসিয়ে দেয়। ১৯৮২ সালে আবার প্রলয়ংকরী এক ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়ে এটি। এ কারণে এর প্রধান দালানটির জায়গা বদল হয়েছে তিনবার।
রিওকানের প্রেসিডেন্ট কেনজিরো কাওয়ানো বিশ্বাস করেন যে হোটেলের নির্জন অবস্থান এত বছর ধরে ব্যবসাটিকে টিকিয়ে রেখেছে। অবস্থানগত কারণে বিপুল সাফল্যের পরও একে বিস্তৃত করার সুযোগ নেই। কেবল ২৫ বছর বয়সে হোটেলে যোগ দেওয়া কাওয়ানোর এই হোটেলের প্রধান হয়ে ওঠাটাও আশ্চর্য ব্যাপার। কারণ এর মূল মালিকদের রক্তের সম্পর্কের কেউ ছিলেন না তিনি। তাঁর আগে একই পরিবারের ৫২টি প্রজন্ম হোটেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সমস্যা সমাধানে হোটেলটির মূল শেয়রগুলো কিনে নেওয়ার পাশাপাশি একে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে গড়ে তোলেন।
তাঁর অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে রাইওকানের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা এবং ভ্রমণকারীদের নতুন ঢলের সঙ্গে এটিকে মানানসই করা। কারণ এখনকার পর্যটকদের মধ্যে অনেকেই জাপানের বাইরে থেকে আসছেন। সময়ের সঙ্গে থাকতে এখন এমন কর্মী আছে যারা ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারে।
কাওয়ানো বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে আমাদের অতিথিরা বছরের পর বছর ধরে যত্নের সঙ্গে আগলে রাখা ঐতিহ্যকে যেন অনুভব করতে পারে। আমি মনে করি এই একে বাঁচিয়ে রাখা আমার কর্তব্য। যখন আমি ৫৪তম প্রেসিডেন্টের কাছে রিওকান হস্তান্তর করব, তখন যেন দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছি ভেবে আত্মতৃপ্তি পাই।’